স্টিমাচের আস্থা অর্জনের পর মনবীরের সামনে ফেরান্দোর ভরসা হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ
লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের মতো ক্ষিপ্র গতির ফুটবলারকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে কেন মনবীরকে নামিয়েছিলেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই মনবীরই গোল করে ভারতকে বহু প্রতীক্ষিত জয় এনে দেন।

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে একাধিকবার তিনি গোল করে দলকে জেতালেও গত বৃহস্পতিবারের ম্যাচের আগে তাঁর গোলে শেষ কবে ভারতীয় দল জিতেছে, তা অনেক স্মৃতি হাতড়েও বের করা কঠিন।
বৃহস্পতিবার কুয়েত সিটিতে বিশ্বকাপ ২০২৬ বাছাই পর্বের প্রথম ম্যাচে কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচের ৭৫ মিনিটের মাথায় যে গোলটি করেন মনবীর, সেই গোলেই জয় পায় ভারত। ভারতীয় দলের একাধিক জয়ে তিনি গোল করে অবদান রেখেছেন, এটা ঠিকই। কিন্তু বৃহস্পতিবারের ম্যাচের মতো তাঁর গোলেই ভারত জয় সুনিশ্চিত করেছে, এমন ঘটনা বিরল।
সেই কারণেই কি ভারতীয় দলের নির্ভরযোগ্য ও তারকা ফরোয়ার্ড হিসেবে তাঁকে বড় একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না? ব্যাপারটা যেন সে রকমই।
🧡🇮🇳 pic.twitter.com/PwjfcujWex
— Manvir Singh (@manvir_singh07) November 17, 2023
ইতিহাস বলছে, শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল পাঁচ বছর আগে, ২০১৮-র সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে মলদ্বীপের বিরুদ্ধে, যে ম্যাচে ভারত ২-০-য় জেতে এবং ৪৪ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় গোলটি করে দলের জয় সুনিশ্চিত করেন মনবীর। তার আট মিনিট আগে প্রথম গোলটি করেন নিখিল পূজারি। ভারতের জার্সি গায়ে মনবীরের সেটিই প্রথম গোল।
সে বছর সেপ্টেম্বরে হওয়া এই টুর্নামেন্টে মলদ্বীপকে হারানোর পরেই পাকিস্তানকে হারায় ভারত। ৩-১-এ সেই জয়ে মনবীর জোড়া গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ঠিকই। তবে জয়সূচক গোলটি করেছিলেন সুমিত পাসি। এর তিন বছর পর ২০২১-এর মার্চে মনবীর ভারতের জার্সি গায়ে তাঁর চতুর্থ গোলটি পান ওমানের বিরুদ্ধে এবং ৫৫ মিনিটের মাথায় করা সেই গোলের ফলেই ভারতীয় দল সেই ম্যাচ ১-১ ড্র করতে পারে। অনেকের মনে থাকতে পারে, সেই ম্যাচের ২৭ মিনিটের মাথায় ওমানের আব্দুল আজিজের পেনাল্টি কিক আটকে দিয়েছিলেন ভারতের গোলকিপার অমরিন্দর সিং।
এর পরে দেশের হয়ে মাঠে নেমে আরও তিন গোল করেছেন পাঞ্জাবের এই তারকা ফরোয়ার্ড। তার মধ্যে ম্যাচ জেতানো গোল গত বৃহস্পতিবারেরটাই। এ পর্যন্ত মোট ৪০টি ম্যাচে ভারতীয় স্কোয়াডে ছিলেন তিনি। তার মধ্যে প্রথম এগারোয় ছিলেন ২৬টি ম্যাচে। পরিবর্ত হিসেবে নেমেছেন ১১বার এবং রিজার্ভ বেঞ্চেই বসে থাকতে হয়েছে তিনবার। যে ম্যাচে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল পান, সেই ম্যাচ থেকে তিনি বেশিরভাগ ম্যাচেই শুরু থেকে খেলেছেন।
গত বৃহস্পতিবার কুয়েতের বিরুদ্ধে অবশ্য প্রথম এগারোয় মনবীরকে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান। লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের মতো ক্ষিপ্র গতির ফুটবলারকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে কেন মনবীরকে নামিয়েছিলেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই মনবীরই গোল করে ভারতকে বহু প্রতীক্ষিত জয় এনে দেন। দেশের মাঠে ধারাবাহিক সাফল্যের পর বিদেশে গিয়েই ভারত যেখানে পরপর দুটি টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা নিয়ে দেশে ফিরে আসে, তখন কুয়েতের মাঠে এই ম্যাচে ভারতের সাফল্য নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু বিদেশের মাটিতেও ভারতকে সাফল্য এনে দিলেন মোহনবাগানের মনবীর। এটা অবশ্যই কৃতিত্বের।
কেন সে দিন মনবীরকে প্রথম এগারোয় রেখেছিলেন, দেশে ফিরে তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্টিমাচ। বলেছেন, “মনবীর ওর ক্লাবের হয়ে সম্প্রতি যথেষ্ট ভাল খেলেছে। নিয়মিত অ্যাসিস্ট করছে ও গোলও করছে। মাঠে ওর শারীরিক উপস্থিতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেট পিস ও কর্নার মোকাবিলা করার জন্য ওর মতো উচ্চতা ও শক্তির খেলোয়াড় আমাদের দরকার”। কুয়েত সিটি থেকে ফিরে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-কে এই কথাগুলি বলেছেন ভারতের কোচ।
তাঁর মতে, “অনেকে ভাবেন, আমাদের হাতে সেন্টার ফরোয়ার্ড নেওয়ার একশো শতাংশ সুযোগ রয়েছে। যখন মনবীর, রহিম আলিদের দলে নেওয়া হয়, তখন তাঁরা সমালোচনা শুরু করে দেন। কিন্তু আমি এদের ব্যাপারে হাল ছাড়তে রাজি নই। মনবীর মাঠে যে অবদান রাখে, তার জন্য কিন্তু যথেষ্ট কৃতিত্ব ও পায় না”।
আসলে গোল করার ক্ষেত্রে অন্যান্য ফরোয়ার্ডদের ধারাবাহিকতা যতটা, মনবীরের ততটা নেই বলেই হয়তো তিনি এই কৃতিত্বটুকু পান না। যে প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটা শুরু করা হয়েছে, সেই নিয়েই যদি খোঁজ খবর করা যায়, তা হলে দেখা যাবে, আইএসএলে ১১৪টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়ে থাকলেও তিনি গোল করে দলকে জিতিয়েছেন মাত্র চারবার। এফসি গোয়াকে জিতিয়েছেন একবার, ২০১৯-এর ডিসেম্বরে, হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে। এর পরে মোহনবাগানকে জিতিয়েছে তিনবার, ২০২১-এ ওডিশা ও নর্থইস্টের বিরুদ্ধে এবং গত বছর ফেব্রুয়ারিতে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে। সে জন্যই প্রাপ্য গুরুত্ব হয়তো পাননি মনবীর।
স্টিমাচ একেবারেই ভুল বলেননি। এ বছর আইএসএলের শুরু থেকেই ভাল ফর্মে রয়েছেন মনবীর। চারটি ম্যাচে ২৯৮ মিনিট খেলে দু’টি গোল করেছেন। অ্যাসিস্টও করেছেন দুটি গোলে। গোলে শট মেরেছেন চারটি, যার মধ্যে দুটিতে গোল পেয়েছেন। অর্থাৎ, এ বার তাঁর কনভারশন রেট ৫০%। বিপক্ষের বক্সে এ পর্যন্ত ১৫ বার বল ধরেছেন এবং উইং থেকে গোলের সামনে আটবার ক্রস পাঠিয়েছেন। যে কোনও কোচের নোটবুকে কোনও খেলোয়াড় সম্পর্কে যদি এ রকম পরিসংখ্যান লেখা হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, সেই খেলোয়াড় যথেষ্ট ভাল ফর্মে রয়েছেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনবীরকে প্রথম পছন্দের তালিকায় রাখেন স্টিমাচ। রেখে যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ তো ম্যাচেই দিয়েছেন তিনি।
কুয়েতের বিরুদ্ধে তাঁর গোলটি ছিল অসাধারণ। বাঁ দিক থেকে ওঠা ছাঙতে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকেই ডানদিকে এক মাপা ক্রস বাড়ান মনবীরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মনবীরকে আটকাতে তেড়ে যান দুই কুয়েতি ডিফেন্ডার। কার্যত মাঝখান দিয়ে তাঁদের প্রতিরোধ চিরে দিয়ে বাঁপায়ে গোলে শট নেন মনবীর, যা গোলকিপারের বাঁদিক দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। প্রচুর আত্মবিশ্বাস ছাড়া এমন গোল করা যায় না।
𝗪𝗛𝗘𝗡 @manvir_singh07 𝗖𝗔𝗠𝗘 𝗖𝗔𝗟𝗟𝗜𝗡𝗚💙🇮🇳
— Indian Football Team (@IndianFootball) November 17, 2023
🎥 @SonyLIV
Highlights 👉🏼 https://t.co/mqlUn22lpH#FIFAWorldCup 🏆 #BlueTigers 🐯 #IndianFootball ⚽ pic.twitter.com/gD9lJ9beYW
গত মরশুমে এটিকে মোহনবাাগানের জার্সি গায়ে মাঠে নেমে হাফ ডজন গোল করেন মনবীর সিং। এএফসি কাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে শ্রীলঙ্কার ব্লু স্টার-এর বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেছিলেন তিনি। আইএসএলে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধেও দু’টি গোল করেন। ২০২০-২১ মরশুমেও হিরো আইএসএলে ছ’টি গোল করেছিলেন তিনি। দুই মরশুমেই ডার্বিতে গোল ছিল তাঁর।
কঠিন কোণ থেকেও যে গোলগুলি আগে করেছেন, সেই জায়গা থেকে প্রচুর গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি। এই সুযোগগুলির কয়েকটিও কাজে লাগাতে পারলে আরও গোল পেতেন মনবীর। সব মিলিয়ে মনবীর ২৫টি সুযোগ তৈরি করতে পেরেছিলেন গত মরশুমে। ১৮ ম্যাচে ৩০টি শট নিয়েছিলেন গোলে। তার মধ্যে মাত্র দুটিকে গোলে পরিণত করতে পেরেছিলেন। কনভারশন রেট ছিল খুবই খারাপ, ৬.৬৭%।
গতবার চোটের জন্য ডিসেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ছ’টি ম্যাচে খেলতেই পারেননি মনবীর। লিগের প্রথম ম্যাচে ও তৃতীয় ম্যাচে গোল করেছিলেন তিনি। তার পরে টানা চারটি ম্যাচে গোলের খরা ও ছ’টি ম্যাচে চোট। চোট সারিয়ে ফিরে আসার পরে দু’টি ম্যাচে অ্যাসিস্ট করলেও কোনও গোল পাননি। প্লে অফের একটি ম্যাচে একটি গোলে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেন তিনি।
হিরো সুপার কাপে অবশ্য একটি গোল পান। হিরো আইএসএলে ১৮টি ম্যাচে প্রথম এগারোয় ছিলেন, সময় পেয়েছেন প্রচুর (১৫৪৭ মিনিট)। কিন্তু সে ভাবে কাজে লাগাতে পারেননি এতটা সময়ও। প্রচুর সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। বারবার আক্রমণ তৈরি করেও গোলের সামনে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন।
পারফরম্যান্সে এই অধঃপতনের জেরে এ বার তাঁকে মোহনবাগান শিবিরে রাখা হবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে রেখে দেয় মোহনবাগান এসজি। আসলে গত মরশুমের আগে তাঁর চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ায় ক্লাব। ফলে অন্য কোনও ক্লাব তাঁকে নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ না করা পর্যন্ত মনবীরকে রেখে দিয়েছে মোহনবাগান এসজি।
কিন্তু এ বার যে ভাবে শুরুটা করেছেন তিনি, তার পরে আর তাঁকে অন্য কারও হাতে বোধহয় তুলে দিতে পারবেন না মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দো। যেখানে ভারতীয় দলের কোচই তাঁকে এমন দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, সেখানে ক্লাবের কোচ কী ভাবেই বা তাঁকে ছাড়বেন?
এই মরশুমে বোধহয় ফর্মে ফেরার সংকল্প নিয়েই মাঠে নেমেছেন মনবীর সিং। সামনেই যে এএফসি কাপ ও এএফসি এশিয়ান কাপের হাতছানি। এই দুই লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েই বোধহয় নিজেকে উজ্জীবিত করে তুলেছেন তিনি। এই লক্ষ্যে মনবীর সফল হলে যেমন লাভবান হবে ভারতীয় ফুটবল দল, তেমনই লাভ হবে সবুজ-মেরুন শিবিরেরও।
পরিসংখ্যানে মনবীর সিং
ভারতের হয়ে:
ম্যাচ- ৩৭, সময়- ২২০২ মিনিট, গোল-৭, অ্যাসিস্ট- ২
আইএসএলে এ মরশুমে:
ম্যাচ- ৪, সময়- ২৯৮ মিনিট, গোল- ২ (প্রতি ৯০ মিনিটে গড়ে ০.৬), অ্যাসিস্ট- ২ (০.৬), গোলে শট- ৪ (১.২১), কনভারশন রেট- ৫০%, প্রতিপক্ষের বক্সে টাচ- ১৫ (৪.৫৩), ক্রস- ৮ (২.৪২)।
আইএসএলে গত মরশুমে:
ম্যাচ- ১৮, সময়- ১৫৪৭ মিনিট, গোল- ২ (প্রতি ৯০ মিনিটে গড়ে ০.১২), অ্যাসিস্ট- ৪ (০.২৩), গোলে শট- ৩০ (১.৭৫), কনভারশন রেট- ৬.৬৭%, প্রতিপক্ষের বক্সে টাচ- ৬৩ (৩.৬৭), ক্রস- ৩১ (১.৮)।