ফুটবল শুধুমাত্র খেলা নয়, এ এক আবেগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা এক উত্তরাধিকার। তাঁর কাছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট শুধুমাত্র একটি ক্লাব নয়, এটি তাঁর পরিবারের ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গত মাসে তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাঁর হৃদয়ে লেখা ছিল একটাই নাম, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও দেখেছিলেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর সঙ্গে মহমেডান এসসি-র ম্যাচ। সেই ম্যাচের দু’দিন পর সবাইকে ছেড়ে চলে যান সমর কুমার চাকী। শেষ যাত্রায় তাঁর মরদেহের ওপর ছিল সবুজ-মেরুন পতাকা। ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি জানানো হয় শ্রদ্ধার্ঘও। ক্লাবের প্রতি তাঁর ভালবাসা, আবেগ শুধুমাত্র সমর্থক হিসেবে ছিল না। গঙ্গাপাড়ের এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার যোগ। তিনি মোহনবাগান প্রেমী, এটিই ছিল তাঁর আসল পরিচয়।

প্রয়াত সমর কুমার চাকীর সেই ঐতিহ্য এখন বহন করে চলেছেন তাঁর পুত্র সৌমেন। বাবার মতো তিনিও একজন আদ্যপান্ত সবুজ-মেরুন সমর্থক।

বাঙাল পরিবারের মোহনবাগান-প্রেমী!

জন্মগত কারণে চাকী পরিবারের মোহনবাগান সমর্থক হয়ে ওঠার কোনও কারণ ছিল না। সৌমেনের বাবা এবং তাঁর কাকারা ছিলেন ওপার বাংলার মানুষ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা পরিবারগুলির অন্যতম ছিল তারা। যাদের সাধারণত বলা হয় বাঙাল। কিন্তু তাঁরা পছন্দ করতেন মোহনবাগানকে। যা ছিল বিরল ঘটনা। কারণ, সাধারণত পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিবারগুলি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক হতেন। কিন্তু সৌমেনের পূর্বপুরুষ অন্য পথে হাঁটেন। সেই ভালবাসাই ভবিষ্যতে সৌমেনের মধ্যেও সংক্রামিত হয়।

সৌমেন বলেন, "আমি ২০০৬ সাল থেকে মাঠে যাচ্ছি এবং তখন থেকেই নিয়মিত মোহনবাগানের খেলা দেখতে যাই। আমাদের মোহনবাগান সমর্থক হয়ে ওঠা শুরু হয় আমাদের বাড়িতেই। আমরা খাঁটি বাঙাল পরিবার। আমার বাবা ও তাঁর দুই ভাই ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসেন। তবে প্রচলিত ধারার বিপরীতে গিয়ে আমাদের পরিবার ইস্টবেঙ্গল নয়, বরং মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে ওঠেন"।

সৌমেনের বাবার কাছে ফুটবল শুধুমাত্র বিনোদন ছিল না, ফুটবল ছিল তাঁর জীবনযাত্রার এক অঙ্গ। যদিও তিনি সব সময় মাঠে যেতে পারতেন না, তবু ক্লাবের প্রতি ও ফুটবলের প্রতি তাঁর ভালবাসা কখনও ছিটেফোঁটাও কমেনি। এমনকী, জীবনের শেষ মুহূর্তেও তাঁর ফুটবলের প্রতি আবেগ অটুট ছিল।

সৌমেন বলেন, "কাজের জন্য আমার বাবা নিয়মিত স্টেডিয়ামে যেতে পারতেন না। তবে আমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি কোনও ম্যাচ মিস করেননি। জীবনের শেষ দশ বছর একটিও খেলা না দেখে কাটাননি তিনি। মনপ্রাণ দিয়ে নিয়মিত আইএসএল-এর খেলা দেখতেন, খবর রাখতেন বাবা। শুধু মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের খেলাই নয়, তিনি প্রতিটি ম্যাচ দেখতেন এবং খেলার বিশ্লেষণও করতেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও খেলা দেখছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে তিনি শেষবারের মতো খেলা দেখেছিলেন"।

তাঁর আত্মার বাহক সেই টি-শার্ট!

একাধিক কারণে চাকী পরিবারের কাছে ২০২২-২৩-এর আইএসএল কাপ ফাইনাল ছিল স্মরণীয়। মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট সে বার আইএসএল কাপ জিতেছিল ঠিকই। তবে সৌমেনের বাবা সমরবাবুর কাছে এর অন্য তাৎপর্য ছিল। অনেকের মতো, তাঁরও ছিল একটি পয়া টি-শার্ট। সেই টি-শার্ট এখন শুধু পোশাক নয়, স্মৃতির প্রতীকও। সেই টি-শার্টটি এখন প্রতি ম্যাচে সঙ্গে করে নিয়ে যান সৌমেন। সেই টি শার্টের মাধ্যমে যেন বাবার আত্মাকেই প্রতি ম্যাচে তাঁর সঙ্গে থাকে।

এই প্রসঙ্গে সৌমেন বলেন, "আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে পুরী গিয়েছিলাম। সেই সফরে আমার বাবা জগন্নাথ দেবের ছবি-সহ একটি টি-শার্ট কিনেছিলেন। যখন আমরা ২০২২-২৩ মরশুমে আইএসএল কাপ জিতি, তখন বাবা সেই টি-শার্ট পরে ছিলেন। তাই তিনি সেই টি-শার্টকেই সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করতেন"।

সেই টি-শার্ট প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, "পরবর্তী সময়ে, প্রায় প্রতি ম্যাচের দিন তিনি সেই একই টি-শার্ট পরে মাঠে যেতে চাইতেন। আমি সেই টি-শার্টটি যত্নসহকারে রেখে দিয়েছি। শেষ ম্যাচেও সেটা নিয়ে গিয়েছিলাম আর পরের ম্যাচেও তা সঙ্গে রাখতে চাই। আমি অনুভব করি, এই টি-শার্টের মধ্যেই আমার বাবা সব সময় আমার সঙ্গে থাকেন, স্টেডিয়ামে আমার পাশে বসে বা দাঁড়িয়ে খেলা দেখেন"।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২০২২-২৩-এর আইএসএল কাপ জয়ের পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে চলেছে। টানা দুই মরশুম লিগ শিল্ড জিতেছে তারা। শুধু শিল্ড জেতাই না, রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে অর্জন করার জন্যই তাদের এই সাফল্যকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও দামী করে তুলেছে।

গত মরশুমের লিগ শিল্ড জয় সমর বাবুর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি শুধু ক্লাবের প্রথম আইএসএল শিল্ডই ছিল না, তাঁর প্রিয় খেলোয়াড়ের অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্যই সে বার এসেছিল সাফল্য। সৌমেন বলেন, "গত মরশুমের আইএসএল শিল্ড জয় আমার বাবার জন্য এক বিশাল আনন্দের মুহূর্ত ছিল। তবে এ মরশুমের শুরুটা একটু অন্যরকম ছিল। আমার বাবার প্রিয় খেলোয়াড় দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। তিনি এ মরশুমে তেমন ভাল ফর্মে ছিলেন না। যার ফলে বাবা বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি জেমি ম্যাকলারেনকেও খুব পছন্দ করতেন এবং আমি কৃতজ্ঞ যে ম্যাকলারেন পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে করা তাঁর দু’টি গোল আমার বাবাকে উৎসর্গ করেন"।

বাগান-অধিনায়ক শুভাশিস বোসকেও ধন্যবাদ দিয়ে সৌমেন বলেন, "আমি শুভাশিস-কেও ধন্যবাদ জানাই তার গোলের জন্য। সেই গোল, যা ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল। সেই মুহূর্তটি আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে"।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ইতিহাসে সমর কুমার চাকী ও তাঁর পুত্র সৌমেনের স্মৃতি চিরকালই থেকে যাবে। সৌমেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি তাঁর বাবার প্রিয় টি-শার্টটি প্রতিটি ম্যাচে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। যতদিন তিনি সেই টি-শার্ট সঙ্গে নিয়ে স্টেডিয়ামে যাবেন, ততদিন তিনি জানবেন, সমরবাবুও ঠিক তাঁর পাশেই আছেন, ম্যাচ দেখছেন, উল্লাস করছেন এবং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছেন।