পেনাল্টি-বিভ্রাটের প্রায়শ্চিত্ত করে মোহনবাগান এসজিকে এএফসি কাপের গ্রুপ শীর্ষে পৌঁছে দিলেন কামিংস
মাজিয়ার অতি রক্ষণাত্মক ফুটবলের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে কলকাতার দলের পক্ষে। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার মানসিকতাই তাদের সাফল্য এনে দেয়। সহাল আব্দুল সামাদের সাজিয়ে দেওয়া পাস থেকে গোল করে দলকে জয় এনে দেন কামিংস।

পেনাল্টি শট গোলে না মেরে একটু অন্যরকম কিছু করতে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসির ভক্ত জেসন কামিংস। কিন্তু তিনি যে মেসি নন, বাস্তবই তা বুঝিয়ে দেয় তাঁকে। পেনাল্টি থেকে অবধারিত গোলের সুযোগও হাতছাড়া করে এএফসি কাপ গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে মাজিয়া এসআরসি-র বিরুদ্ধে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে বড়সড় বিপদের মুখে ঠেলে দেন তিনি। শেষ পর্যন্ত নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নিজেই করেন এবং স্টপেজ টাইমে বহু প্রতীক্ষিত গোল করে দলকে টানা দ্বিতীয় জয় এনে দিলেন তিনি। এই জয়ের সঙ্গে সঙ্গে এএফসি কাপের গ্রুপ ‘ডি’-র শীর্ষে উঠে গেল গত আইএসএলের কাপ চ্যাম্পিয়নরা।
সোমবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ২৭ মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন কামিংসই। ৪০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টিও পান তাঁরা। দু’গোলে এগিয়ে যাওয়া তখন ছিল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু পেনাল্টি থেকে গোল করার সহজতম সুযোগ হাতছাড়া করে যে কী ভুল করেন, তা কামিংস টের পান ৪৫ মিনিটের মাথায় যখন সমতা আনেন তোমোকি ওয়াদা। দ্বিতীয়ার্ধে মাজিয়ার অতি রক্ষণাত্মক ফুটবলের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে কলকাতার দলের পক্ষে। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার মানসিকতাই তাদের সাফল্য এনে দেয়। সহাল আব্দুল সামাদের সাজিয়ে দেওয়া পাস থেকে গোল করে দলকে জয় এনে দেন সেই কামিংসই। ফলে দুই ম্যাচে ছ'পয়েন্ট পেয়ে আপাতত গ্রুপ শীর্ষে মোহনবাগান এসজি।
এ দিন অন্য ম্যাচে ওডিশা এফসি বাংলাদেশের বসুন্ধরা সুপার কিংসের কাছে ২-৩ গোলে হেরে যাওয়ায় গ্রুপের কোনও দলই মোহনবাগানের সমান পয়েন্ট অর্জন করতে পারেনি। এই মাজিয়াই গত ম্যাচে বসুন্ধরাকে হারিয়ে দিয়েছিল। ফলে গ্রুপের আর কোনও দলেরই সংগ্রহে ছ’পয়েন্ট নেই। তাই গ্রুপ শীর্ষে আপাতত সবুজ-মেরুন ব্রিগেডই। পরবর্তী ম্যাচে বসুন্ধরা কিংসকে হারিয়ে দিতে পারলে তাদের জোনাল সেমিফাইনালে যাওয়ার পথ আরও সুগম হবে।
এএফসি কাপের নিয়ম অনুযায়ী ছয় বিদেশিকে রাখা যেতে পারে প্রথম একাদশে। তবু গত ম্যাচে পাঁচ বিদেশিকে প্রথম এগারোয় রাখলেও মাজিয়ার বিরুদ্ধে ছ’জন বিদেশিকে নিয়েই নামে সবুজ-মেরুন বাহিনী। রক্ষণে ব্রেন্ডান ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তে, মাঝখানে হুগো বুমৌস ও আক্রমণে আরমান্দো সাদিকু, জেসন কামিংস ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এছাড়া আনোয়ার আলি ও আশিস রাই ছিলেন রক্ষণে। মাঝমাঠে গ্ল্যান মার্টিন্সের সঙ্গে লিস্টন কোলাসো। গত ম্যাচে প্রথম এগারোয় থাকা শুভাশিস বোস, অনিরুদ্ধ থাপা, সহাল আব্দুল সামাদ ও মনবীর সিংকে এই ম্যাচে দেখা যায় রিজার্ভ বেঞ্চে।
শুরু থেকেই যে আক্রমণাত্মক ফুটবলই খেলবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, দল দেখে সেটা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আন্দাজ ঠিকই ছিল সবার। কিক অফের বাঁশি বাজার পর থেকেই আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী ফুটবল শুরু করে তারা। তবে মাজিয়া সে জন্য তৈরিই ছিল। প্রতিপক্ষকে রোখার পরিকল্পনা নিয়েই যে তারা নেমেছিল, সারা ম্যাচে তাদের আগ্রাসী পারফরম্যান্স দেখেই তা বোঝা যায়। সবুজ-মেরুন বাহিনীর ত্রিফলা আক্রমণ আটকাতে এতটাই ব্যস্ত ছিল মাজিয়া যে, প্রতি আক্রমণের কথা প্রায় ভুলেই যায় তারা।
এ দিন ৬৬ শতাংশ বল পজেশন ছিল মোহনবাগানের। যেখানে ১৯টি কর্নার আদায় করে তারা, সেখানে দুটির বেশি কর্নার পায়নি মাজিয়া। মোহনবাগান যেখানে কুড়িটির মধ্যে ন’টি শট গোলে রাখে, সেখানে মাজিয়ার ছ’টি শটের মধ্যে গোলমুখী শট ছিল মাত্র একটি। প্রতিপক্ষের বক্সের ভিতরে ঢুকে এ দিন কামিংস, সাদিকুরা যেখানে ১৩টি শট নেন, সেখানে মাজিয়া বিপক্ষের বক্সে ঢুকে দুটির বেশি শট নিতে পারেনি।
কলকাতার দলের মোট পাস ছিল ৫১৪। অথচ তাদের প্রতিপক্ষ ২৬৮-র বেশি পাস খেলতে পারেনি। মোহনবাগানের ৩২টি ক্রসের তুলনায় মাজিয়ার ক্রসের সংখ্যা ছিল ৯। এ রকম পরিসংখ্যান সত্ত্বেও ম্যাচ ড্র হলে, তা কলকাতার দলের পক্ষে যথেষ্ট লজ্জাজনকই হত। সেই লজ্জার দিকে দলকে ঠেলে দেন যিনি, সেই অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপারই দলকে সেই লজ্জার হাত থেকে বাঁচান।
শুরুর দিকে ২৭ মিনিটের বেশি তাদের আটকে রাখতে পারেনি মলদ্বীপের সেরা দল। বুমৌসের পাস থেকে পাওয়া বল নিয়ে কামিংস প্রতিপক্ষের বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন, যা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকে যায় (১-০)।
তাদের যে ব্যবধান বাড়ানোর তাড়া রয়েছে, তা পরবর্তী মিনিট থেকেই বুঝিয়ে দেয় মোহনবাগান এসজি। সাদিকু, হ্যামিল সুযোগ হাতছাড়া করেন। প্রতিপক্ষের নাগাড়ে আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত মাজিয়ার ব্রানিমির জকিচ ৪০ মিনিটের মাথায় গোলমুখী সাদিকুকে বক্সের মধ্যে টেনে ফেলে দেন। পেনাল্টি দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেননি রেফারি।
কিন্তু পেনাল্টি মারতে গিয়ে যে ঘটনাটা ঘটান কামিংস, তা ভারতীয় ফুটবলে, এমনকী, বিশ্ব ফুটবলের সেরা দশ বিস্ময়কর ঘটনার তালিকায় থাকতে পারে। স্পট কিক থেকে সোজা গোলে শট না মেরে ডান দিকে পাস দেন কামিংস! যা অনুসরণ করে পেট্রাটস দৌড়ে আসেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে থাকা সেবাস্তিয়ান অ্যান্টিক আগেই বলে পা লাগিয়ে তা বাইলাইনের ওপারে পাঠিয়ে দেন। যা দেখে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় সারা স্টেডিয়াম। এমন ‘আত্মহত্যা’ কেন করতে গেলেন অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার! তার উত্তর ছিল না উপস্থিত দর্শকদের কাছে।
সাত বছর আগে, ২০১৬-য় লা লিগায় সেল্টা ফিগোর বিরুদ্ধে ম্যাচে লিওনেল মেসি এ ভাবেই পেনাল্টি থেকে পাস দিয়েছিলেন লুই সুয়ারেজকে। সে দিন সেই পাস থেকে গোল করেছিলেন সুয়ারেজ। কিন্তু সাত বছর পর সুয়ারেজ হয়ে উঠতে পারেননি না পেট্রাটস।
পেনাল্টি হাতছাড়া করার খেসারত মোহনবাগানকে দিতে হয় চার মিনিট পরেই, যখন তাদের রক্ষণে কয়েক সেকেন্ডের মনসংযোগের অভাবকে কাজে লাগিয়ে সমতা আনেন তোমোকি ওয়াদা। ওবেং রেগানের দেওয়া পাসে বল পেয়ে প্রতিপক্ষের বক্সের বাইরে থেকে যখন সোজা গোলে শট নেন ওয়াদা, তখন তাঁকে আটকাতে এগিয়ে আসেননি কেউই। জোরালো শট গোলের বাঁ দিকের ওপরের কোণ দিয়ে ঢুকে যায় (১-১)।
প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে বুমৌসের দেওয়া পাস থেকে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পান পেট্রাটস। কিন্তু তিনি নিজে গোলে শট না মেরে ওভারল্যাপে আসা আশিসের জন্য তা ছেড়ে দেন। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হন আশিস রাই। মোহনবাগান এ দিন অনায়াসে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যেতে পারত। কিন্তু তারা প্রথমার্ধের পর ড্রেসিংরুমে ফিরে যায় ১-১ অবস্থায়।
বিরতির পর যে পেনাল্টি নষ্টের ক্ষতি পূরণ করার লক্ষ্যেই মাঠে নামবেন কামিংসরা, তা জানাই ছিল। সে ভাবেই খেলা শুরু করে তারা। ৫০ মিনিটের মাথায় তাদের জোড়া শট আটকে অবধারিত গোল বাঁচান মাজিয়ার গোলরক্ষক হুসেইন শরিফ। রেগানের ভুল পাস থেকে বল পেয়ে প্রথমে জোরালো শট নেন পেট্রাটস। শরিফের হাত থেকে বল ছিটকে এলে কামিংস ফের শট নেন। এ বারও দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় সেভ করেন গোলরক্ষক। ৫৪ মিনিটের মাথায় ফের কোলাসোর গোলমুখী শট আটকান তিনি।
ব্যবধান তৈরির জন্য মরিয়া মোহনবাগান কোচ ফেরান্দো ৫২ মিনিটের মাথায় আশিস রাইকে তুলে মনবীর সিংকে নামান। ৬৪ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে শুভাশিস ও সহালকে নামানো হয় আনোয়ার ও পেট্রাটসের জায়গায়। ওই সময়ে মোহনবাগানের বল পজেশন ৬৫ শতাংশ থাকলেও প্রতিপক্ষের গোলের সামনে গিয়ে বারবার দিশাহারা হয়ে যায় তারা।
সহাল, মনবীররা নামার পরে সমর্থকদের মনে গোলের আশা জাগে। ডানদিক থেকে মাজিয়ার গোলের সামনে মাপা একটি ক্রসও পাঠান সহাল। কিন্তু অ্যানটিকের ইন্টারসেপশনে সেই শট গতি হারায়। সহাল অবশ্য তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। ৬৮ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে দুর্দান্ত একটি ক্রস পাঠান মাজিয়ার গোলের সামনে, যাতে ঠিক মতো মাথা ছোঁয়াতে পারলে অবধারিত গোল পেতেন হ্যামিল। চমৎকার পাসে ধীরগতিতে আক্রমণ তৈরি করলেও ফাইনাল থার্ডে গিয়ে বারবার আটকে যান সহালরা। এ জন্য অবশ্য কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য মাজিয়ার ডিফেন্ডারদের।
আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ৭৬ মিনিটের মাথায় গ্ল্যানকে তুলে নিয়ে অনিরুদ্ধ থাপাকে নামান ফেরান্দো। তীব্রতা বাড়লেও আসল কাজটি করতে পারেনি তারা। নিজেদের গোলের সামনে প্রায় চৌখস বাজপাখির মতো পাহাড়া দিচ্ছিলেন অ্যানটিক। বারবার তিনিই সবুজ-মেরুন অ্যাটাকারদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান। শেষের দিকে মাজিয়ার প্রায় পুরো দলটাই নিজেদের গোল এরিয়ায় নেমে আসে। জয়সূচক গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন কামিংস, সাদিকুরা। ৮৯ মিনিটের মাথায় ফের কোলাসোর গোলমুখী শট আটকান শরিফ।
নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর সাত মিনিটের যে বাড়তি সময় পায় মোহনবাগান এসজি, তাতেই নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন কামিংস। ডানদিক দিয়ে ওঠা সহাল তাঁকে বক্সের মধ্যে বল বাড়ালে বাঁ পায়ে কোণাকুনি শটে জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি (২-১)। এই গোলটিও না হলে এ দিন মোহনবাগানকে পেনাল্টি নষ্টের বড়সড় খেসারত দিতে হত এবং নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে যেতেন কামিংস। সেই পরিস্থিতি থেকে অবশ্য দলকে টেনে বার করেন তিনি নিজেই।