মায়ানমারের পর এ বার কিরগিজ প্রজাতন্ত্রকেও হারাল ভারত। মঙ্গলবার তাদের ২-০-য় হারিয়ে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন আয়োজেত হিরো ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে নিল ভারতীয় দল। মণিপুরের ইম্ফলের খুমান লম্পক স্টেডিয়ামে এ দিন দুই অর্ধে একটি করে গোল করে ভারত। দু’টিই আসে সেটপিস থেকে। প্রথমার্ধে অনিরুদ্ধ থাপার ফ্রিকিক থেকে গোল করেন সন্দেশ ঝিঙ্গন ও দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে গোল করেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী।

এ দিন  দেশের জার্সি গায়ে ৮৫ নম্বর গোলটি করেন তিনি। বিশ্বের সেরা দশ আন্তর্জাতিক গোলদাতাদের তালিকায় হাঙ্গেরির কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাসকে পিছনে ফেলে দিলেন তিনি। এ দিন পুরো ৯০ মিনিট মাঠে ছিলেন ৩৮ বছর বয়সি সুনীল। পুরো দলটাকেই তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।

এ দিন প্রথমার্ধে নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে না পারলেও ৩৪ মিনিটের মাথায় আসা সন্দেশ ঝিঙ্গনের গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ভারতীয় দল। দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা হলেও দাপট বাড়ে ভারতীয়দের। তবে বিপক্ষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। তবু ৮৪ মিনিটের মাথায় গোলমুখী নাওরেম মহেশ সিং পেনাল্টি বক্সের মধ্যে অবৈধ ভাবে বাধা পাওয়ায় পেনাল্টি পায় ভারত ও তা থেকে জয়সূচক গোলটি তুলে নেন সুনীল।

এ দিন বল দখলের লড়াইয়ে ভারতীয়দের পিছনে (৫৫-৪৫) ফেলে দেয় বিশ্ব ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে ১১ ধাপ এগিয়ে থাকা কিরগিজ প্রজাতন্ত্র। কিন্তু সারা ম্যাচে ভারতই বেশি (৪-১) গোলে শট নেয়। সুনীলদের ছ’টি শটের মধ্যে চারটিই ছিল গোলে এবং কিরগিজদের দশটির মধ্যে একটিমাত্র শট গোলমুখী ছিল। আকাশ, সন্দেশ, আনোয়ার, প্রীতমদের তোলা রক্ষণের দেওয়ালে চিড় ধরাতে পারেননি কিরগিজ অ্যাটাকাররা।

প্রথম ম্যাচে ভারত মায়ানমারকে ১-০-য় হারানোয় এবং টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচে মায়ানমার ও কিরগিজ প্রজাতন্ত্র ১-১ ড্র করায় এই ম্যাচে একটি ড্র করলেই ভারত সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত। কিন্তু মাঠে নামার আগে থেকেই ভারতীয় দলের হেড কোচ ইগর স্টিমাচ জানিয়ে তাঁরা ম্যাচটা জিততেই নামবেন। ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে অনেকটা ওপরে থাকা কিরগিজ প্রজাতন্ত্রকে মোটেই খাটো করে দেখা উচিত নয় বলে জানিয়েছিলেন দলনেতা সুনীল ছেত্রী।

সে জন্যই শুরু থেকেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি ভারতীয় দল। সুযোগ পেলে তবেই আক্রমণে ওঠে তারা। শারীরিক দিক থেকে এগিয়ে কিরগিজরা ভারতীয়দের নানা ভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করেও পেরে ওঠেনি অনিরুদ্ধ থাপাদের দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার জন্য। কী ভাবে বড় চেহারার খেলোয়াড়দের বোকা বানাতে হবে, তা আগে থেকেই দলের ছেলেদের জানিয়ে রেখেছিলেন ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্টিমাচ। এ দিন কোচের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তাঁরা।

একাধিক পরিবর্তন করে এ দিন প্রথম এগারো নামান স্টিমাচ। গোলে গুরপ্রীত সিং সান্ধু, রক্ষণে ঝিঙ্গন, আনোয়ার আলি, প্রীতম কোটাল, মাঝমাঠে সুরেশ ওয়াঙজাম, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজদের এ দিন প্রথম একাদশে ছিলেন। ব্র্যান্ডন এ দিন সেটপিস থেকে বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ তৈরি করে দেন সতীর্থদের। কিন্তু ঝিঙ্গন ছাড়া আর কেউ সুযোগগুলি কাজে লাগাতে পারেননি।

৩৪ মিনিটের মাথায় বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে নেওয়া ব্র্যান্ডনের ফ্রিকিকে বল পেয়ে গোলের বাঁ দিক থেকে জালে জড়ান অভিজ্ঞ সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। এই গোল খাওয়ার পর থেকে কিরগিজদের মধ্যে বাড়তি তৎপরতা দেখা গেলেও ভারতীয় রক্ষণে বারবার আটকা পড়ে যায় তারা। এই টুর্নামেন্টে যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছে ভারতীয় দলের রক্ষণ। গত ম্যাচে রাহুল ভেকে, চিঙলেনসানা সিং, মেহতাব সিংরা যেমন ভাল খেলেছিলেন, এ দিন ঝিঙ্গন, প্রীতম, আনোয়ার আলিরাও সুযোগ পেয়ে নিজেদের প্রমাণ করেন।

কিরগিজ দলে এ দিন অনেক নতুন মুখ দেখা যায়। প্রায় চার বছর আগে যে দলটি ভারতে এসে এক গোলে হেরেছিল এবং তাদের ঘরের মাঠে জিতেছিল, সেই দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই এই সফরে আসেননি। গত বছর জুনে তারা শেষ অফিশিয়াল ম্যাচ খেলছিল এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে। ঘরের মাঠে তাজিকিস্তানের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করে তারা। এই ম্যাচটি ছাড়া বাকি দু’টি ম্যাচেই জেতে।

তার পর থেকে দলে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং নতুন দল নিয়েই এ বার ভারতে এসেছেন রাশিয়ান কোচ আলেকজান্দার ক্রেস্টিনিন। দলটা যে এখনও সে ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি, তা এই টুর্নামেন্টে তাদের পারফরম্যান্স দেখেই বোঝা গিয়েছে। প্রায় ছ’মাস পরে মাঠে নেমে গত রবিবার মায়ানমারের বিরুদ্ধে ম্যাচে একেবারে শেষ মিনিটে কায়রাত ঝিরগালবেক উলু গোল না করলে ম্যাচটা হেরেই যেত তারা।

তবে মায়ানমারকে যারা এক গোলে হারিয়েছে, সেই ভারতের বিরুদ্ধে যেন আরও নির্বিষ লাগে কিরগিজদের। তার ওপর ভারতীয় রক্ষণ ছিল কার্যত দুর্ভেদ্য। প্রথমার্ধে গোল পাওয়ার পর থেকেই তারা আরও সজাগ হয়ে যায়। কিরগিজরাও একটি গোল খাওয়ার পর নিজেদের রক্ষণকে আরও আঁটোসাঁটো করে ফেলে। ফলে দ্বিতীয়ার্ধে পরিবর্ত হিসেবে নামা নাওরেম মহেশ সিং, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতেরা একাধিকবার ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

মহেশ ও সহাল আব্দুল সামাদকে দ্বিতীয়ার্ধে নামান ভারতীয় কোচ স্টিমাচ। দু’জনেই কোচের আশা পূরণ করেন। মিডফিল্ডার রোহিত কুমারকেও এ দিন অভিষেকের সুযোগ করে দেন ক্রোয়েশিয়ান কোচ। কেউই  হতাশ করেননি। তবে ম্যাচের সেরার পুরস্কার পান আকাশ মিশ্র, যাঁকে ম্যাচের শেষ দিকে স্ট্রেচারে করে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়।             

ভারতীয় দল: গুরপ্রীত সিং সান্ধু (গোল), আকাশ মিশ্র (মেহতাব সিং), সন্দেশ ঝিঙ্গন, আনোয়ার আলি (নাওরেম রোশন), প্রীতম কোটাল, সুরেশ ওয়াঙজাম, জিকসন সিং (রোহিত কুমার), ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ (নাওরেম মহেশ সিং), লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, অনিরুদ্ধ থাপা (সহাল আব্দুল সামাদ), সুনীল ছেত্রী।