গত দুই মরশুমের তুলনায় এ বারের মরশুম কিছুটা ভাল হলেও সাফল্যের বিচারে সেই পিছিয়েই থেকেছে তারা। ডুরান্ড কাপ, হিরো আইএসএল ও হিরো সুপার কাপ—এই তিন সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টে মোট ২৭টি ম্যাচ খেলে তারা। তার মধ্যে জয় পায় মাত্র সাতটিতে। হিরো সুপার কাপে তিনটির একটি ম্যাচও জিততে পারেনি তারা, ড্র হয়। শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের অতীতের কীর্তির সঙ্গে এই খতিয়ানের কোনও তুলনাই হয় না। এ বার হিরো আইএসএলে লাল-হলুদ বাহিনী ছ’টি ম্যাচে জেতে। মরশুম শেষে তারা ব্রিটিশ কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইনকেও বিদায় জানিয়ে দেয় এবং পরের মরশুমের জন্য  প্রাক্তন বেঙ্গালুরু এফসি কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। সারা মরশুমে দলের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন যাঁরা, তাদের পারফরম্যান্সের খতিয়ান দেখে নেওয়া যাক এই প্রতিবেদনে।  

কমলজিৎ সিং (গোলকিপার): সারা মরশুমে ২৪টি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের গোল পাহাড়া দিয়েছেন। ৪২টি গোল খেয়েছেন। পাঁচটি ম্যাচে ক্লিন শিট রেখে মাঠ ছেড়েছেন। হিরো আইএসএলে মোট ৫৪টি সেভ রয়েছে। লিগে তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ৬২.৭৯%। গত মরশুম শুরুর আগে ওডিশা এফসি থেকে তাঁকে নিয়ে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল। দারুন যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, তা নয়। তবে একাধিক ম্যাচে তাঁর দক্ষতা ও তৎপরতার জন্য হারতে হয়নি দলকে।

চ্যারিস কিরিয়াকু (সাইড ব্যাক, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার): সাইপ্রাস থেকে আসা এই ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডার ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে এক বড় স্তম্ভ ছিলেন। ৩৩ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ ফুটবলার হিরো আইএসএলে ১৮টি, হিরো সুপার কাপ ও ডুরান্ড কাপে তিনটি করে ম্যাচ খেলেছেন। হিরো আইএসএলে একটি গোলও করেন তিনি। করেছিলেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। লিগে পাসিং অ্যাকিউরেসি ৭৮.৩৯%। ৩৯টি ট্যাকল করেন তিনি। ১৮টি ইন্টারসেপশন, ৩৬টি ক্লিয়ারেন্স ও ২২টি ব্লক রয়েছে তাঁর পারফরম্যান্সের খতিয়ানে।

ইভান গঞ্জালেস (সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার): ৩৩ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ ডিফেন্ডার প্রতিভাবান হলেও ধারাবাহিকতার অভাবে এই মরশুমে সমর্থকদের মন জয় করতে পারেননি। হিরো আইএসএলে গত দুই মরশুমে এফসি গোয়ার হয়ে যতটা ভাল খেলেছিলেন। এ মরশুমে তেমন পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। ডুরান্ড কাপ, হিরো আইএসএলে খেললেও হিরো সুপার কাপে তাঁকে খেলতে দেখা যায়নি, বেঞ্চেই ছিলেন সব ম্যাচে। হিরো আইএসএলেও শেষ পাঁচটি ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পাননি তিনি। ৫৭টি ট্যাকল, ২৬টি ইন্টারসেপশন, ৬৭টি ক্লিয়ারেন্স ও ৩৬টি ব্লক ছিল তাঁর আইএসএলের খতিয়ানে।

লালচুঙনুঙ্গা (সেন্টার ব্যাক): লাল-হলুদ জার্সি গায়ে সারা মরশুমে ২৬টি ম্যাচ খেলেছেন মিজোরাম থেকে আসা এই ২২ বছর বয়সী ডিফেন্ডার, যাঁকে ভবিষ্যতের জাতীয় দলের খেলোয়াড় বলে মনে করছেন অনেকে। হিরো আইএসএলে ৬৭টি ট্যাকল, ২৫টি ইন্টারসেপশন, ৮৬টি ক্লিয়ারেন্স ও ৪৩টি ব্লক করেন তিনি। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ফিরতি লিগে কার্ড সমস্যায় খেলতে পারেননি। বাকি সব ম্যাচেই খেলেন তিনি। বেশিরভাগই পুরো ৯০ মিনিট।

জেরি লালরিনজুয়ালা (লেফট ব্যাক): গত বছর চেন্নাইন এফসি থেকে তাঁকে নিয়ে আসে ইস্টবেঙ্গল এফসি। ২৪ বছর বয়সী মিজোরামের এই ফুটবলার লাল-হলুদ জার্সি গায়ে ২২টি ম্যাচ খেলেছেন। দুটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। একটি ডুরান্ড কাপে, মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ও অপরটি হিরো আইএসএলে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে। হিরো আইএসএলে মোট ১৯টি ম্যাচে ৩৯টি ক্রস দিয়েছেন সতীর্থদের। এমনকী সাতটি গোলের সুযোগও তৈরি করেছেন। ৬৭টি ট্যাকল ও ৩২টি ইন্টারসেপশন রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

সার্থক গলুই (সাইড ব্যাক, সেন্টার ব্যাক): তিনটি টুর্নামেন্টে মোট ১৭টি ম্যাচ খেলেছেন ২৫ বছর বয়সী এই বঙ্গ ডিফেন্ডার। হিরো আইএসএলে একটি গোলও করেন তিনি, এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে। হিরো আইএসএলে ৫০টি ট্যাকল, ২০টি ইন্টারসেপশন, ৪৯টি ক্লিয়ারেন্স, ৩০টি ব্লক ছিল তাঁর।

অঙ্কিত মুখার্জি (সেন্টার ব্যাক): সারা মরশুমে ১২টি ম্যাচ খেলেছেন ২৬ বছর বয়সী ডিফেন্ডার। মরশুমের শেষ দিকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে তাঁকে চারটি ম্যাচে দলে রাখাই হয়নি। হিরো আইএসএলে ৩১টি ট্যাকল ও ১৭টি ইন্টারসেপশন করেছেন। ২৪টি ক্লিয়ারেন্স ও ১৮টি ব্লকও ছিল সঙ্গে।

অ্যালেক্স লিমা (সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার): লাল-হলুদ জার্সি গায়ে মোট ২৪টি ম্যাচে একটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করেছেন ৩৪ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়াম মিডফিল্ডার। মাঝমাঠে প্রায় সবরকম ভূমিকাই পালন করেছেন তিনি। হিরো আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ম্যাচেই কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে গোল করেন তিনি। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে একটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন। ১৩টি ম্যাচে প্রথম এগারোয় ছিলেন। হিরো আইএসএলে তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ৭৬ শতাংশ। ৭৪টি ট্যাকল করেছেন। ১৪টি ক্রস দিয়েছেন ও ১৬টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। মোট ৬১৩টি পাস করেছেন।

জর্ডন ওডোহার্টি (সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার): অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইউনাইটেড জেটস ক্লাব থেকে আসা ২৫ বছর বয়সী এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র অন্যতম নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে ২১টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ১৮টি হিরো আইএসএলে এবং তিনটি হিরো সুপার কাপে। লিগে একমাত্র গোলটি করেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে। পাসিং অ্যাকিউরেসি ৮১.৪৩%। মোট ৪৩১টি পাস দিয়েছেন। প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ২৪টি করে পাস দিয়েছেন তিনি। মাঝে কিরিয়াকুর সঙ্গে তাঁর ভাল বোঝাপড়া গড়ে ওঠায় দুজনে মিলে দলের মাঝমাঠকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন।

মোবাশির রহমান (অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার): জামশেদপুর থেকে উঠে আসা এই তরুণ মিডফিল্ডার এ মরশুমে নিজেকে মেলে ধরার মরিয়া চেষ্টা করলেও নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ না পাওয়ায় বারবার ছন্দ হারিয়েছেন। হিরো আইএসএলে ১৮টি ম্যাচে স্কোয়াডে থাকলেও প্রথম এগারোয় ছিলেন ন’টিতে। পরিবর্ত হিসেবে নামেন চারটি ম্যাচে। পাঁচটি ম্যাচে সুযোগই পাননি। সুপার কাপে অবশ্য তিনটি ম্যাচেই শুরু থেকে খেলেন। ডুরান্ড কাপে একটি ম্যাচে শুরু থেকে খেলেন। দুটিতে পরিবর্ত হিসেবে নামেন। সুপার কাপে একটি গোলও করেন ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে। হিরো আইএসএলে একটি অ্যাসিস্ট করেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। হিরো আইএসএলে যে ৮০৪ মিনিট মাঠে ছিলেন, তার মধ্যে আটটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। ন’টি ক্রস দেন। প্রতি ম্যাচে গড়ে ২৮টি করে পাস খেলেন ও পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৭৩.৬২%।

নাওরেম মহেশ সিং (অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার): এই মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে সেরা ফুটবলার তিনি। পাঁচটি গোল করেছেন, সাতটি অ্যাসিস্ট করেছেন। হিরো আইএসএলে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট তাঁরই। হিরো আইএসএলে জামশেদপুরের বিরুদ্ধে তিনটি অ্যাসিস্ট করেন তিনি, যা ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে লিগের রেকর্ড। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে দলের দুটি গোলেই তিনি অ্যাসিস্ট করেন। হিরো সুপার কাপে হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে দু’টি গোল করেন মহেশ। পরের ম্যাচেই আইজল এফসি-র বিরুদ্ধেও একটি গোল করেন। হিরো আইএসএলে ওডিশা এফসি ও মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে গোল করেন ২৪ বছরের এই নতুন তারকা। হির আইএসএলে ১৯টির মধ্যে ১৮টি ম্যাচেই শুরু থেকে খেলেন তিনি। ৫৯টি ক্রস দেন। ২৭টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। তবে পাসিং অ্যাকিউরেসি ৬০.২৯%, যেখানে আরও উন্নতি করতে হবে তাঁকে। প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ৩১টি পাস, মোট ৬০২টি পাস খেলেছেন তিনি।

ক্লেটন সিলভা (সেন্টার ফরোয়ার্ড): এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র সেরা তারকা এই ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড। হিরো আইএসএলে তিনি সর্বোচ্চ স্কোরারের পুরস্কার গোল্ডেন বুটের অন্যতম দাবিদার ছিলেন তিনি। কিন্তু দল প্লে-অফে না উঠতে পারায় তিনিও আর ১২ গোলের বেশি এগোতে পারেননি। সব মিলিয়ে এ মরশুমে ২৫ ম্যাচে ১৪টি গোল করেছেন ক্লেটন। ডুরান্ড কাপেও দুটি গোল করেছিলেন। হিরো সুপার কাপে গোল না পেলেও দুটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। সব মিলিয়ে চারটি অ্যাসিস্ট। হিরো আইএসএলে এটিকে মোহনবাগান, চেন্নাইন এফসি, হায়দরাবাদ এফসি ও মুম্বই সিটি এফসি ছাড়া সব দলের বিরুদ্ধেই গোল করেছেন তিনি। ২০টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন, ১৮টি ক্রস দেন। প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ৩১টি করে পাস দেন। পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৮০.৪৫%। এ রকম অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর ক্লেটনের সঙ্গে আগামী মরশুমের চুক্তিও করে ফেলেছে লাল-হলুদ শিবির।

ভিপি সুহের (ফরোয়ার্ড): গত মরশুমে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের হয়ে অসাধারণ খেলার পরে ইস্টবেঙ্গল তাঁকে যে প্রত্যাশা নিয়ে সই করিয়েছিল, সেই প্রত্যাশা ততটা পূরণ করতে পারেননি কেরালার এই ফরোয়ার্ড। শুরুর দিকে দু-তিনটি ম্যাচে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলে ব্যর্থ হওয়ার পরে তাঁকে একটু নীচে থেকে খেলানো হয়। মরশুমের প্রথম গোল পেতে তাঁকে ১১টি ম্যাচ অপেক্ষা করতে হয়। জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথম গোল পান তিনি। তার পরে হিরো আইএসএলে দু’টি ও হিরো সুপার কাপে একটি গোল পান তিনি। লিগে দুটি গোল করার পাশাপাশি তিনটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। এ ছাড়া ১৮টি ম্যাচে ১২টি গোলের সুযোগ তৈরি করেন সুহের। ৩৬টি ক্রস দেন ও ২৯টি শটও মারেন গোলের উদ্দেশ্যে।