এএফসি কাপ গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচে শোচনীয় হারের পরেও দ্বিতীয় ম্যাচে যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াল এটিকে মোহনবাগান, তা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল। শনিবার কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের এক নম্বর ফুটবল ক্লাব বসুন্ধরা কিংসকে ৪-০-য় হারিয়ে এএফসি কাপের গ্রুপ লিগ থেকে নক আউট পর্বে যাওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখল হিরো আইএসএল সেমিফাইনালিস্টরা।

তিন দিন আগেই গোকুলম কেরালা এফসি-র কাছে ২-৪ হারের ধাক্কা সামলে যে এ ভাবে ফিরে আসতে পারবে তারা, তা অনেকেই ভাবতে পারেনি। সবুজ-মেরুন সমর্থকদের নয়নের মণি গোয়ানিজ স্ট্রাইকার লিস্টন কোলাসোই হয়ে ওঠেন এই জয়ের নায়ক। তাঁর হ্যাটট্রিকেই এটিকে মোহনবাগান কার্যত উড়িয়ে দেয় বসুন্ধরা কিংসকে।

প্রথম ম্যাচে মাজিয়ার বিরুদ্ধে ১-০-য় জেতা বসুন্ধরা শুরুর দিকে জয়ের ছন্দে থাকলেও প্রথম গোল হজম করার পর তাদের কার্যত অসহায় দেখায়। প্রথমার্ধে ২৪ ও ৩৩ মিনিটে কোলাসোর জোড়া গোলে এগিয়ে থাকা কলকাতার দলটি দ্বিতীয়ার্ধে ফের দুই গোল দিয়ে জয়ের রাস্তা পরিস্কার করে নেয়। ম্যাচের ৫৩ মিনিটের মাথায় হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন কোলাসো ও ৭১ মিনিটে পরিবর্ত হিসেবে নামার ছ’মিনিটের মধ্যেই দলের চতুর্থ গোলটি করেন অস্ট্রেলীয় তারকা ডেভিড উইলিয়ামস।

বৃষ্টিস্নাত যুবভারতীতে গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সমর্থকদের মন আরও ভরিয়ে তোলে কোলাসোর এই অসাধারণ হ্যাটট্রিক। ম্যাচের পরে তিনি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “অফ সিজনে আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি। হ্যাটট্রিক পেতে গেলে বিপক্ষের বক্সের মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হত আমাকে। সেটা করতে পেরে আমি খুবই খুশি। এটাই এই মরশুমে আমার প্রথম হ্যাটট্রিক”।

এই সাফল্য দলের সতীর্থ ও পরিবারের সদস্যদের উৎসর্গ করে কোলাসো বলেন, “এই হ্যাটট্রিক সতীর্থ ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি উৎসর্গ করতে চাই। তাঁরা আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে সমর্থন করেছেন সব সময়। ঈশ্বরও আমার পাশে ছিলেন”।

প্রথম গোল পাওয়ার পরই তাঁরা দ্বিগুন উৎসাহ পেয়ে যান বলে জানান কোলাসো। বলেন, “আগের ম্যাচের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এই ম্যাচে নেমেছিলাম। জানতাম, আমাদের শুরুতেই গোল দিতে হবে। প্রথম গোলটা পেয়ে যাওয়ার পরেই সবাই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এটা বরাবরই হয়। তাই শুরুতে গোল করাটা খুব জরুরি”। আবহাওয়ার পরিবর্তনও তাঁদের সাহায্য করেছে বলে জানান কোলাসো।

দলের এই ঘুরে দাঁড়ানোর জয়ে উচ্ছ্বসিত কোচ ফেরান্দো বলেন, “খুব ভাল একটা দলের বিরুদ্ধে খেলেছি আমরা। দলের ছেলেরা পরিকল্পনা অনুযায়ীই খেলেছে। সমর্থকদের জন্যও ভাল লাগছে। ওঁরা আমাদের খেলা দেখে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন। প্রথম দশ মিনিট পরিস্থিতি একটু কঠিন ছিল। ম্যাচ ফের শুরুর পর আমরা খেলায় ফিরি এবং বিরতির পরে আমরা ওদের চেয়ে অনেক ভাল খেলেছি। এত ঝড়-বৃষ্টি সত্ত্বেও যে সমর্থকেরা গ্যালারিতে অপেক্ষা করে ছিলেন, এটা দারুন ব্যাপার”।

দলের পারফরম্যান্স নিয়ে ফেরান্দো বলেন, “ম্যাচটা কঠিন হলেও মাঠে নেমে আমাদের ছেলেরা স্বচ্ছন্দে খেলেছে। মনস্তাত্বিক দিক থেকেও আমরা এগিয়ে ছিলাম। আমরা সত্যিকারের দল হিসেবে খেলেছি। সমর্থকেরাও ধৈর্য্য বজায় রেখে খুব সাহায্য করেছেন আমাদের। গত দু’দিন ধরে অনেকে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছে আমাদের ফুটবলারদের নিয়ে। এটা ঠিক নয়। এরা সবাই পেশাদার এবং প্রত্যেকে ভাল মানুষও। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার”।

ঘুরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে রহস্য কী, তা জানতে চাইলে ফেরান্দো বলেন, “দলে কয়েকজনকে পরিবর্তন করে তাদের পজিশন বদলে দিই। কারণ, তাদের ওপর আমার আস্থা ছিল। দলের প্রত্যেক ফুটবলারের ওপরই যে আমার আস্থা রয়েছে, তা আগেও বলেছি। প্রত্যেকেই দলকে সাহায্য করতে পারে আর আমার কাজ হল তাদের কাছ থেকে সেরাটা বার করে আনা। আর ক্যাপ্টন বদলেছি ঠিকই। কিন্তু আমার দলে সবাই ক্যাপ্টেন। রয়ের হাতে আর্মব্যান্ড ছিল ঠিকই। প্রীতমের ভূমিকা তাতে কিছু বদলায়নি। সন্দেশও ক্যাপ্টেনের ভূমিকাই পালন করেছে”।

প্রথম এগারোয় গোলকিপার বদল নিয়ে সবুজ-মেরুন কোচ বলেন, “অমরিন্দর দুর্দান্ত গোলকিপার। কিন্তু কঠিন ম্যাচে কিছু পজিশনে বদল আনলে তাতে লাভই হয়। অমরিন্দরকে নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই। আজকের ম্যাচের পরিকল্পনায় এই পরিবর্তনটা দরকার ছিল। আমি খুশি যে সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে পেরেছি”।

বসুন্ধরা কিংসের কোচ অস্কার ব্রুজোন, যিনি ম্যাচের আগের দিন প্রায় হুঁশিয়ারির সুরে বলেছিলেন, “প্রথম ৩০ মিনিটে হয়তো ওরা আক্রণণাত্মক হয়ে উঠবে আর ওদের সমর্থকেরা হয়তো খুব চিৎকার করবে। কিন্তু তার পরে কী হবে দেখা যাবে”, সেই স্প্যানিশ কোচ প্রথম আধ ঘণ্টাতেই ম্যাচ হেরে গিয়েছেন বলে স্বীকার করে নেন। বলেন, “প্রথম আধ ঘণ্টায় প্রচুর সহজ সুযোগ নষ্ট করেছি আমরা। ওরা বক্সের মধ্যে আমাদের চেয়ে অনেক ভাল খেলেছে। এই ব্যাপারটাই ম্যাচের ফল নির্ধারণ করে দেয়। প্রথম আধ ঘণ্টায় আমরা ওদের চমকে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। রক্ষণে ও বল সরবরাহে ভুল করার মাশুল দিতে হল আমাদের”।

এটিকে মোহনবাগানের প্রশংসা করে ব্রুজোন বলেন, “ওদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। ওরা নিজেদের ওপর থেকে আস্থা হারায়নি। স্বীকার করতেই হবে, ওরা আজ আমাদের চেয়ে ভাল ফুটবল খেলেছে”।

এই জয়ের ফলে এটিকে মোহনবাগান দুই ম্যাচে তিন পয়েন্ট ও সর্বোচ্চ গোলপার্থক্য (২) নিয়ে লিগ টেবলে সবার ওপরে রয়েছে। শনিবার রাতের ম্যাচে মলদ্বীপের মাজিয়া এসআর ১-০-য় গোকুলম কেরালা এফসি-কে হারিয়ে দেওয়ায় এখন লিগ টেবলে সব দলেরই সংগ্রহ তিন পয়েন্ট করে। তাই মঙ্গলবার শেষ রাউন্ডের দু’টি ম্যাচে যারা জিতবে, তাদের মধ্যেই সেরা দল নক আউট পর্বে উঠবে।

বিকেলের ম্যাচে গোকুলম কেরালা এফসি যদি বসুন্ধরা কিংসকে হারাতে পারে ও রাতের ম্যাচে যদি এটিকে মোহনবাগান মাজিয়াকে হারায়, তা হলে অবশ্য এই দুই জয়ী দলের মধ্যে ম্যাচের ফলের ভিত্তিতে কেরালার দলই নক আউট পর্বে উঠবে। তবে বসুন্ধরা এই ম্যাচে জিতলে মাজিয়াকে হারিয়ে এটিকে মোহনবাগানকে নক আউট পর্বে উঠতে হবে। বিকেলের ম্যাচ ড্র হলে অবশ্য রাতে এটিকে মোহনবাগান ড্র করেই গোলপার্থক্যের বিচারে নক আউটে চলে যেতে পারবে। অর্থাৎ, নক আউটে যেতে গেলে তাদের ঠিক কী করতে হবে, তা জেনেই মঙ্গলবার মাজিয়ার বিরুদ্ধে নামবে হিরো আইএসএল সেমিফাইনালিস্টরা।