প্রতিবারের মতো এ মরশুমের আগে দলবদলেও চমক দিয়েছে গতবারের ইন্ডিয়ান সুপার লিগ কাপ জয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। একের পর এক সেরা বিদেশি ফুটবলার সই করিয়েছে তারা। সঙ্গে ভারতীয় দলে খেলা এক ঝাঁক তারকা ফুটবলারকে। তবে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি তাদের শহরেরই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এফসি-ও। তারাও একের পর এক চমক দিয়েছে এ বারের দলবদলে। দু’পক্ষ একে অপরকে তো বটেই, আইএসএলের অন্যান্য দলের সঙ্গেও সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার জন্য সই করিয়েছে সেরা ফুটবলারদের।

প্রতিবারই যেমন তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার ক্ষেত্রে প্রতি দলের ভারতীয় ফুটবলাররা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এ বারেও কিন্তু বিদেশিদের পাশাপাশি নজর থাকবে ভারতীয় তারকাদের দিকেও। এরকমই সেরা পাঁচ দেশীয় নিয়োগকে নিয়ে এই প্রতিবেদন, আসন্ন লিগে যাঁরা নজর থাকবেন।

আনোয়ার আলি (দিল্লি এফসি থেকে মোহনবাগান এসজি)

এ বারের দলবদলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল এই ফুটবলার। তিনি এ মরশুমে কোন ক্লাবের হয়ে খেলতে পারেন, তা নিয়ে অনেক জল্পনা ছিল। আনোয়ারকে নিয়ে অবশ্য এতটা আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। গত আইএসএলে এবং ভারতীয় দলের হয়ে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তিনি, তার পরে তিনি দেশের ফুটবলে অবশ্যই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। খেলছেনও সে রকম। মোহনবাগান এসজি-র ডুরান্ড কাপ জয় ও এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।

সেন্টার ব্যাক হিসেবে যে গোছানো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তিনি, তার যত প্রশংসা করবেন, ততই কম হবে। ডিপ পজিশন থেকে বল পায়ে দুর্দান্ত দক্ষতা দেখিয়েছেন পাঞ্জাব থেকে উঠে আসা আনোয়ার। দলের খেলার স্টাইলে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন তিনি। শুধু যে দলের রক্ষণেই তিনি বড় সম্পদ, তা নয়। অ্যাটাকিং থার্ডেও নিজেকে প্রায়ই বিপজ্জনক করে তোলেন ২৩ বছর বয়সী এই তারকা ফুটবলার। মরশুমের শুরুতেই মোহনবাগানের হয়ে তিনটি গোল করা হয়ে গিয়েছে তাঁর। আসন্ন আইএসএলে নিজেকে আরও কতটা মেলে ধরবেন এই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার, তা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে এখনও।

অনিরুদ্ধ থাপা (চেন্নাইন এফসি থেকে মোহনবাগান এসজি)

দীর্ঘ সাত বছর চেন্নাইন এফসি শিবিরে কাটানোর পর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে সই করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার অনিরুদ্ধ থাপা। শুধু কঠিন সিদ্ধান্ত নয়, এটা তাঁর কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জও। এতদিন ধরে এক রকমের পরিবেশে খেলার পর এ বার সম্পুর্ণ অন্যরকম এক পরিবেশে যাওয়াটা কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। ২৫ বছর বয়সী এই তারকা ইতিমধ্যেই ভারতীয় দলের মাঝমাঠে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। সবুজ-মেরুন শিবিরে এসেও তিনি নিজেকে যথেষ্ট ভাল ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। কোচ হুয়ান ফেরান্দোর স্টাইল অনুযায়ী ক্রমশ নিজেকে মানানসই করে তুলেছেন। মোহনবাগানের মাঝমাঠকে এক নতুন মাত্রায় বেঁধে নিয়েছেন তিনি।

মাঝমাঠের তারকা হলেও বিভিন্ন পজিশনে নিজেকে সহজেই নিয়ে যেতে পারেন থাপা এবং সে সব জায়গায় সফলও হন। দলের আক্রমণে আরও তীব্রতা আনতে সাহায্য করেন তিনি। মোহনবাগানে তিনি যোগ দেওয়ায়, আশা করা যায়, উপকৃত হবে দুই পক্ষই—ক্লাব এবং থাপা নিজেও। সবুজ-মেরুন শিবিরের মাঝমাঠে এরকম একজন খেলোয়াড়ের খুবই প্রয়োজন ছিল এবং এই ভূমিকায় থাপার চেয়ে ভাল আর কে হতে পারেন? তাই পাঁচ বছরের জন্য তাঁকে চুক্তিবদ্ধ করেছে কলকাতার ক্লাব। এই কম্বিনেশন আসন্ন আইএসএলে কতটা সফল হবে, সেটাই দেখার।

সহাল আব্দুল সামাদ (কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে মোহনবাগান এসজি)

অনিরুদ্ধ থাপার মতো সহাল আব্দুল সামাদের ওপর মোহনবাগানের নজর ছিল গত মরশুম থেকেই। গত মরশুমে তাঁরা সহালকে নিতে পারেনি। কিন্তু এ বার তাঁকে পাওয়ার জন্য একেবারে শুরু থেকেই মরিয়া হয়ে ওঠে। তাই এ বার যখন তাঁকে পাওয়াই গেল, তখন পাঁচ বছরের চুক্তি নয় কেন? থাপার মতো সহালকেও পাঁচ বছরের চুক্তিতে নিয়েছে তারা। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে গতি ও তীব্রতা বাড়ানোর মতো ভাল খেলোয়াড় এতদিন তাদের হাতে তেমন ছিল না। এ বার দল গড়ার আগেই তাই এই দিকটায় বেশি নজর দেন কোচ হুয়ান ফেরান্দো।

দলের আক্রমণকে আরও তীব্র করে তুলতে, একেবারে রক্ষণ থেকে আক্রমণ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সফল করতে তাই মাঝমাঠে সহালের মতো ক্ষিপ্র ও সুযোগসন্ধানী ফুটবলার প্রয়োজন ছিল তাদের। সেই কারণেই কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে তাঁকে নিয়ে আসে মোহনবাগান। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকু ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটসদের মতো বিদেশি অ্যাটাকাররা সহাল ও থাপার কাছ থেকে যে সহযোগিতা পাচ্ছেন, তাতেই তাঁরা আরও ধারালো হয়ে উঠছেন। তবে নিজেদের মধ্যে আরও বোঝাপড়া দরকার। সেটা তৈরি হয়ে গেলে আসন্ন আইএসএলে সবুজ-মেরুন ব্রিগেডকে রোখা কঠিন হয়ে উঠবে।

নন্দকুমার শেখর (ওডিশা এফসি থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি)

রশুমের শুরু থেকেই নন্দকুমার শেখর লাল-হলুদ সমর্থকদের হৃদয় জিতে নিয়েছেন। ডুরান্ড কাপে প্রথম কলকাতা ডার্বিতে জয়সূচক গোলটি আসে তাঁরই পা থেকে। এর পরে সেমিফাইনালে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে যখন হারের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল, তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁর গোলেই সমতা আনে তারা এবং টাই ব্রেকারে জিতে ফাইনালে ওঠে। এই দুই গোলের পর নন্দের ভক্তের সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে গিয়েছে লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে। গত বছর আইএসএলে ওডিশার হয়ে ছ’টি গোল করেন ও একটিতে অ্যাসিস্ট করেন নন্দকুমার।

সুপার কাপেও পাঁচটি ম্যাচে চারটি গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেন তিনি। একটিতে জোড়া গোল ছিল তাঁর। মূলত লেফট উইং দিয়ে আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ফাটল ধরিয়ে গোল করার ক্ষমতা রয়েছে এই উইঙ্গারের। গত বছর হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে তিনি ভারতীয় স্কোরারদের তালিকায় ছিলেন তিন নম্বরে। সুপার কাপে ছিলেন এক নম্বর ভারতীয় গোলদাতা। এ বারও গোল দিয়েই মরশুম শুরু করেছেন। আগামী ছ’মাসে তাঁর পায়ে কত গোল দেখা যাবে, সেটাই প্রশ্ন।

প্রভসুখন গিল (কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি)

গত মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি গোলকিপার হিসেবে পেয়েছিল কমলজিৎ সিংকে। গোলকিপার হিসেবে তিনি যথেষ্ট ভাল, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর জন্যই গত আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল ৩৮ গোল খেয়েই থেমে যায়, না হলে হয়তো সংখ্যাটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা কল্পনা করাও কঠিন। গত মরশুমে কমলজিৎ ১৭ ম্যাচে ৫৪টি সেভ করেছিলেন এবং ৩২টি গোল খেয়েছিলেন। ক্লিন শিট রাখতে পেরেছিলেন মাত্র তিনটি ম্যাচে। গোলকিপারের এমন পারফরম্যান্স সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গল এত গোল খেয়েছিল রক্ষণের দূর্বলতায়।

তাই এ বার লাল-হলুদ বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েই কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত প্রথমেই নজর দেন গোলকিপারের দিকে, যা নিয়ে তাদের গত তিন মরশুমেই অনেক দুশ্তিন্তায় কাটাতে হয়েছে। সেই জন্যই তারা কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে নিয়ে আসে তরুণ গোলকিপার প্রভসুখন গিলকে, যিনি ২০২১-২২-এ ব্লাস্টার্সের ফাইনালে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কুয়াদ্রাত যখন বেঙ্গালুরু এফসি-র কোচ ছিলেন, তখন তাঁর প্রশিক্ষণাধীন ছিলেন পাঞ্জাবের এই তরুণ গোলপ্রহরী। এ মরশুমের শুরু থেকেই নিজেকে প্রমাণ করা শুরু করে দিয়েছেন গিল। ডুরান্ড কাপে ছ’টি ম্যাচের মধ্যে দু’টিতে ক্লিন শিট রেখে মাঠ ছাড়েন তিনি। এ বার আইএসএলে তাঁর দিকে নজর থাকবে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের।