আইএসএল ২০২৪-২৫-এর সেরা গোল মেশিনদের ‘পঞ্চ পাণ্ডব’
সদ্য শেষ হওয়া মরশুমের সেরা পাঁচ গোলদাতার দিকে ফিরে তাকানো যাক, যাঁরা অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিলেন তাঁদের ধারাবাহিকতা, শৈলী ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করার দক্ষতার জন্য।

দর্শনীয় গোলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের (আইএসএল) ২০২৪-২৫ মরশুম ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীদের কাছে হয়ে উঠেছিল বেশ রোমাঞ্চকর। মোট ১৬৩টি ম্যাচে ৪৬৮টি গোল হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গড়ে ২.৮৭টি করে গোল—যা প্রতি সপ্তাহেই সমর্থকদের উত্তেজনার পারদকে ক্রমশ উর্দ্ধমুখী করে তুলেছে।
এ বারের লিগে দেখা গিয়েছে কিছু চোখ ধাঁধানো গোল, নিখুঁত ফিনিশ ও ক্ষিপ্র ভলি। তবে এ মরশুমে সেরা ফরোয়ার্ডদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখে তাঁদের ধারাবাহিকতা। যদিও তা আগের মরশুমগুলির মতো নয়। এই মরশুমে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে বরাবরই একক ভাবে এগিয়ে ছিলেন যিনি, সেই নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির আলাদিন আজারেই ভারতের এক নম্বর লিগে প্রথমবার নেমেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
এ ছাড়াও বলতেই হবে ভারতীয় ফুটবলের সেরা কিংবদন্তি তারকা সুনীল ছেত্রীর কথা, যিনি আন্তর্জাতিক কেরিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার পর ক্লাব ফুটবলে নেমে যেন আরও বেশি ধারালো হয়ে উঠেছিলেন। এত গোল করেন যে আইএসএলের শেষ দিকে তাঁকে অবসর ভেঙে ফের ভারতীয় দলে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন জাতীয় দলের হেড কোচ মানোলো মার্কেজ। তিনি সেই অনুরোধ রাখেন এবং ভারতীয় দলে ফিরেও গোল করেন।
লিগশিল্ড ও কাপজয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট সমর্থকেরা অবশ্যই মনে রাখবেন তাঁদের প্রিয় দলের নয়া বিদেশি তারকা জেমি ম্যাকলারেনকে, যিনি একের পর এক গোল করে দলের আক্রমণের প্রধান ভরসা হয়ে ওঠেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন আলাদিন। তাঁর আশ্চর্য প্রদীপ দিয়ে আইএসএল গ্রহকে এতটাই আলোকিত করে তুলেছিলেন যে, তাঁকে শুধু গোল্ডেন বুট নয়, গোল্ডেন বল দিয়েও সন্মানিত করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে ফিরে তাকানো যাক মরশুমের সেরা পাঁচ গোলদাতার দিকে, যাঁরা সবাই মিলে এ বারের আইএসএলের মোট গোলের প্রায় ১৫ শতাংশ (৭০ গোল) করেছেন।
আলাদিন আজারেই (নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি) – ২৩ গোল

মরক্কোর এই ফরোয়ার্ড আইএসএল-এ তাঁর প্রথম মরশুমেই ঝড় তোলেন। ২৩টি গোল করে নজির গড়েন তিনি। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে জেতেন গোল্ডেন বুট। প্রতিপক্ষের গোলমুখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ত্রাস। সাতটি ম্যাচে করেন জোড়া গোল, যার মধ্যে ওডিশা এফসি ও জামশেদপুর এফসির বিরুদ্ধে হোম ও অ্যাওয়ে, দুই ম্যাচেই জোড়া গোল করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র ন’টি ম্যাচে তিনি গোল পাননি। তাঁর প্রভাব শুধু গোল করায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সাতটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন তিনি। সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট প্রদানকারীদের তালিকায় তিনি ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। ফলে তিনি শুধু গোল্ডেন বুটই নয়, জেতেন গোল্ডেন বল-ও। আইএসএল-এর মরশুমসেরা খেলোয়াড় হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন আলাদিন।
সুনীল ছেত্রী (বেঙ্গালুরু এফসি) – ১৪ গোল

সময়কে অনায়াসে পিছনে ফেলে রেখে এ মরশুমে চমৎকার পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন ৪০ বছর বয়সের সুনীল ছেত্রী। ২০২৩-২৪ মরশুমে তিনি মাত্র পাঁচটি গোল করেছিলেন। কিন্তু এ মরশুমে ২৮টি ম্যাচে করেন ১৪টি গোল। হায়দরাবাদ এফসির বিরুদ্ধে তিনি জোড়া গোল করেন। বেঙ্গালুরুর ঘরের মাঠ কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলকে ৪-২-এ জেতান। প্লে-অফেও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ গোল করেন ছেত্রী। নেতৃত্বে ও গোল দেওয়ায় তিনি ফের প্রমাণ করেন, কেন তাঁকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার বলা হয়।
জেমি ম্যাকলারেন (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট) – ১২ গোল

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট-এর হয়ে এটিই প্রথম মরশুম ছিল অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেনের। ভারতে আসার আগে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ‘এ’ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার সন্মান অর্জন করেন। কেন সেই তকমা পাওয়ার যোগ্য তিন, তা ভারতে এসেও প্রমাণ করে ম্যাকলারেন। তাঁর ফুটবল জীবনের প্রথম ভারত সফরের শুরুতেই করেন ১২টি গোল ও দেন দু’টি অ্যাসিস্ট। যদিও মরশুমের শুরুটা তিনি করেন ধীর গতিতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফর্মে ফিরে আসেন এবং ক্রমশ তাঁর গোলেই নিশ্চিত হয় আইএসএল কাপ জয়ের মুহূর্ত। তাঁর ধারাবাহিকতা ও দক্ষতা দলের জোড়া খেতাব জয়ে বড় ভূমিকা পান করে।
ইয়েসুস জিমিনিজ (কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি) – ১১ গোল
দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের জায়গায় কেরালার দলে আসা স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড জিমিনিজ প্রথম মরশুমেই প্রায় সকলের মনে ছাপ রেখে যান। চোটের কারণে কিছু ম্যাচে খেলতে না পারলেও তিনি ১১টি গোল করেন, যার মধ্যে ছিল টানা ছ’টি ম্যাচে গোল করার নজির। নোয়া সাদাউইয়ের সঙ্গে তাঁর দুর্দান্ত বোঝাপড়া সারা মরশুমে দলের পক্ষে বেশ কার্যকরী হয়ে ওঠে।
লুকা মাজেন (পাঞ্জাব এফসি) – ১০ গোল

পাঞ্জাব এফসি এ বার সেরা পাঁচ দলের মধ্যে থাকতে না পারলেও সেরা পাঁচ গোলদাতার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন তাদের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড লুকা মাজেন। গত মরশুমে আটটি গোল করা এই স্লোভেনিয়ান স্ট্রাইকার এবার করেছেন দশটি গোল। বক্সের মধ্যে তাঁর ক্ষিপ্র গতি, গোলে শক্তিশালী শট এবং বল নিয়ে গতিময় ড্রিবলিং তাঁকে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গোলদাতা হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে। নতুন কোচ ও নতুন সতীর্থদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিজের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতাও বজায় রেখেছেন তিনি।
এ ছাড়াও যাদের কথা উল্লেখ না করলে নয়, তাঁরা হলেন, আরমান্দো সাদিকু, নিকোলাওস কারেলিস ও উইলমার জর্ডান গিল—তিনজনই ১০টি করে গোল করেছেন, তবে মাজেনের তুলনায় মাঠে বেশি সময় থেকেছেন তাঁরা।