আইএসএলে ফিরে দেখা: হতাশার স্তূপ সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা আখ্যানগুলি
এই আবেগঘন আখ্যানের পাতা ওল্টালে জানা যায় কিছু অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের কাহিনী— যেখানে প্রতিকূলতাকে জয় করে ইতিহাসে অমর হয়ে গিয়েছেন কাহিনীর নায়কেরা।

ধীরে ধীরে এক নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে তুলছে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। ১১টি মরশুম সফলভাবে সম্পন্ন করার পর এখন এই প্রতিযোগিতাই দেশের সেরা ফুটবল লিগ। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই লিগ এখন দীর্ঘমেয়াদী এক প্রতিযোগিতার রূপ নিয়েছে, যেখানে ক্লাবগুলি তাদের গৌরব, সম্মান এবং এশীয় মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগের জন্য লড়াই করে।
আইএসএল শুধু আকার ও মর্যাদায় নয়, আবেগের গভীরতাতেও বেড়ে উঠেছে। এই লিগ এখন অসংখ্য কাহিনীর এক জাদুকরী বই— যেখানে রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব, সাহসিকতা, অধ্যবসায় এবং সংকল্পের নানা কাহিনী।
এই আবেগঘন আখ্যানের পাতা ওল্টালে জানা যায় কিছু অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের কাহিনী— যেখানে প্রতিকূলতাকে জয় করে ইতিহাসে অমর হয়ে গিয়েছেন কাহিনীর নায়কেরা।
সুনীল ছেত্রী: ৪০ বছর বয়সেও গর্জন
সুনীল ছেত্রী ভারতীয় ফুটবলের প্রায় সব রেকর্ড বইতেই নিজের নাম লিখিয়েছেন এবং আইএসএল-ও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতা। মোট ৭৫ গোল করেছেন তিনি। এই নিয়ে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই যে, তিনিই সেরা।
তবে তাঁর পথচলা সব সময় সহজ ছিল না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়েছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত তিনটি মরশুমে তাঁর গোলসংখ্যা ছিল মাত্র ১৪।
যখন মনে হচ্ছিল তাঁর সময় শেষের পথে, তখনই নিজের পুরনো রূপে ফিরে আসেন সুনীল। ২০২৪-২৫ মরশুমে বেঙ্গালুরু এফসির হয়ে ১৪টি গোল করে তিনি ২০১৭-১৮-র নজির ছুঁয়ে ফেলেন।
এই অভাবনীয় প্রত্যাবর্তনে মুগ্ধ হয়ে ভারতের প্রধান কোচ মানোলো মার্কেজ তাঁকে আন্তর্জাতিক অবসর থেকে ফিরিয়ে আনেন। ৪১-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছেত্রী এখনও নিজের সেরা মরশুমের রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখছেন।
আনোয়ার আলি: হতাশা থেকে আধিপত্য
ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান সেন্টার-ব্যাক আনোয়ার আলি। কিন্তু হৃদযন্ত্রে এক বিরল রোগের কারণে তাঁর কেরিয়ার প্রায় শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। তবে তিনি হার মানেননি। আইনি ও চিকিৎসাগত জটিলতার মধ্যেও ফুটবলে ফিরে আসার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। অবশেষে এক বছরেরও বেশি বিরতির পর তাঁকে ফের খেলার অনুমতি দেওয়া হয়।
২০২১-২২ মরশুমে তিনি এফসি গোয়ায় যোগ দেন এবং মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলে জাতীয় দলে ফিরে আসেন। ২০২২-এ ভারতের ছ’টি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতে খেলেন তিনি।
এর পরও থেমে থাকেননি আনোয়ার। ২০২৩-এ মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দিয়ে দলের নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়ে ওঠেন। চোট সারিয়ে তিনি দলকে তাদের প্রথম লিগ শিল্ড জিততে সাহায্য করেন। ২০২৪-২৫ মরশুমে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন তিনি এবং সেরা খেলোয়াড়দের একজন হয়ে ওঠেন। ভারতের রক্ষণভাগেও এখন তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তাঁর জীবনযুদ্ধ এবং পেশাদারিত্ব অনুপ্রেরণাদায়ক।
আওয়েন কোইলের চেন্নাইন এফসি: অসম্ভব থেকে সম্ভব
২০১৮-১৯ মরশুমে মাত্র ৯ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবলের একেবারে নীচে থাকা চেন্নাইন এফসি-র পরের মরশুমেও শুরুটা খারাপ হয়। প্রথম ছয় ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে জেতে। তখন ক্লাব কোচ জন গ্রেগরিকে সরিয়ে আওয়েন কোইলকে দায়িত্ব দেয়। তিনি আসার পর দলটিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। টানা আট ম্যাচে অপরাজিত থাকে তারা। যার মধ্যে ছ’টি ম্যাচে জেতে।
তাদের এই বদলে যাওয়া ছন্দ তাদের সেমি ফাইনালেও পৌঁছে দেয়। এমনকী লিগ শিল্ডজয়ী এফসি গোয়াকে দুই ম্যাচ মিলিয়ে ৬-৫-এ হারিয়ে ফাইনালেও ওঠে তারা। যদিও ফাইনালে এটিকে এফসি-র কাছে হেরে যায় কোইলের চেন্নাই, তবু ওই মরশুমেই তাদের পারফরম্যান্স ছিল সেরা এবং আইএসএলের অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তন।
সন্দেশ ঝিঙ্গন: এক অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা
২০১৪-য় প্রথম আইএসএল থেকেই সন্দেশ ঝিঙ্গনের পথচলা শুরু। প্রথম মরশুমেই সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের খেতাব পান তিনি। তবে তাঁর ফুটবল জীবনে চোট-আঘাত ছিল নিত্যসঙ্গী। ২০১৯-এ কেরালা ব্লাস্টার্সে খেলার সময় গুরুতর চোট পান এবং পুরো মরশুমে খেলতে মাঠে নামতে পারেননি।
এর পর মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন ও দারুণ পারফরম্যান্স করেন। কলকাতার ক্লাবে থাকতে থাকতেই ক্রোয়েশিয়ার এইচএনকে সিবেনিক ক্লাব থেকে ডাক পান এবং জাগরেব-এ রওনা দেন। কিন্তু সেখানেও চোট সঙ্গ ছাড়েনি তাঁর। ফলে খেলতে না পেরে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
পরে বেঙ্গালুরু এফসিতে যোগ দিয়ে দলকে ফাইনালে তোলেন। পরবর্তীতে এফসি গোয়ায় যান এবং শুরুটা দারুণ করলেও ফের চোট পান। কিন্তু ২০২৪-২৫ মরশুমে ফিরে এসে এফসি গোয়াকে কেবল দ্বিতীয় স্থানেই নয়, কলিঙ্গ সুপার কাপ জিততেও দলকে সাহায্য করেন। সন্দেশ ঝিঙ্গনের গল্প আসলে এক যোদ্ধার গল্প, যিনি বারবার ফিরে এসেছেন এবং সেরা হয়ে উঠেছেন।
নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি: হতাশা থেকে নবজাগরণ
নর্থইস্ট ইউনাইটেড ২০২২-২৩ মরশুমে মাত্র ৫ পয়েন্ট নিয়ে আইএসএলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করেছিল। তখন তাঁদের প্রয়োজন ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন মানুষের।
স্প্যানিশ কোচ হুয়ান পেদ্রো বেনালির মধ্যে সেই নেতাকে খুঁজে পায় তারা। তাঁর অধীনে ২০২৩-২৪ মরশুমে দলটি এগারো থেকে সাত নম্বরে উঠে আসে। মাত্র এক পয়েন্টের জন্য প্লে-অফে খেলা হয়নি তাদের। এই জায়গা থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয় তাদের। ২০২৪-এ মরক্কান ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেইকে নিয়ে স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেন বেনালি। মরশুমের শুরুতেই তারা ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবগুলিকে বার্তা দিয়ে রাখে যে, তারা ফিরে এসেছে।
বেনালির অধীনে গত মরশুমের আইএসএল প্লে-অফেও পৌঁছে যায় নর্থইস্ট ইউনাইটেড। ক্লাবের ইতিহাসে এই নিয়ে তৃতীয়বার নক আউটে ওঠে তারা। যদিও প্লে অফে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনোর আগেই তাদের যাত্রা থেমে যায়। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাবর্তন ছিল অবাক করার মতো। এখনও অবশ্য এই রূপকথার সমাপ্তি লেখা হয়নি।
আলবিনো গোমস: যে কখনও হার মানে না
আইএসএল ২০২৪-২৫ মরশুমের সর্বাধিক সেভ করেছেন আলবিনো গোমস। একসময় যে গোলকিপার প্রথম চার বছরে মাত্র ১৩টি ম্যাচ খেলেছিলেন, তিনি এখন আইএসএলের সেরা গোলরক্ষকদের একজন। ২০২০-২১-এ কেরালা ব্লাস্টার্সের প্রথম পছন্দ হয়ে ২০টি ম্যাচ খেললেও, পরের মরশুমে চোট পেয়ে ছিটকে যান এবং তাঁর জায়গা দখল করেন প্রভসুখন গিল।
গোমস ফিরে যান আই-লিগে, চর্চিল ব্রাদার্স ও শ্রীনিধি ডেকানের হয়ে খেলেন। তাঁর খেলা নজর কাড়ে জামশেদপুর এফসি-র কোচ খালিদ জামিলের। দু’বছর পর তিনি আইএসএলে ফিরে এসে জামশেদপুরকে তাদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার সেমিফাইনালে পৌঁছতে সাহায্য করেন এবং কলিঙ্গ সুপার কাপের ফাইনালেও পৌঁছে দেন। গোমসের ফিরে আসারস কাহিনী আসলে ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস আর প্রচেষ্টার প্রতিচ্ছবি।
আর এই প্রত্যাবর্তনের গল্পগুলো শুধু ফুটবলের নয়, মানুষের জীবনেরও।