গোল না খেলে আবার কীসের হার? অনেক ফুটবল দলের কোচেরাই এই দর্শনে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন, রক্ষণকে আঁটোসাঁটো রেখে যত বেশি ম্যাচে ‘ক্লিন শিট’ বজায় রাখা যাবে, ততই হারের সম্ভাবনা কমবে। কিন্তু গোল না খেয়ে মাঠ ছাড়তে হলে তো প্রয়োজন দুর্ভেদ্য গোলকিপারও। তাই মরশুম শুরুর আগে কোচেরা দেখে নেন, তাঁদের দলের গোলরক্ষক কে, কী রকম।

রক্ষণের শেষ সীমা যেখানে গোলকিপার, সেখানে গোলপ্রহরীর দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়া খুবই প্রয়োজন। সারা বিশ্বে এমন বহু ফুটবল ম্যাচে দেখা গিয়েছে রক্ষণের ব্যর্থতা সত্ত্বেও গোলকিপার একা হাতে দলের হার বাঁচিয়েছেন। ভারতেও তেমন উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। ভেবে দেখলে সাম্প্রতিক সময়েই এমন একাধিক উদাহরণ পাওয়া যাবে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইতিহাসেও তেমন উদাহরণ কম নেই।

আসন্ন আইএসএল মরশুমেও দক্ষ ও অভিজ্ঞ গোলকিপাররা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। ১৩টি দলে প্রায় ৪০ জন গোলকিপার থাকবেন এ বারের আইএসএলে। সবাইকেই যে ম্যাচে দেখা যাবে, তার কোনও মানে নেই। বেশির ভাগই থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। যাদের মাঠে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাঁদের মধ্যে গোল্ডেন গ্লাভ খেতাবের লড়াইয়ে থাকতে পারেন যাঁরা, তেমনই পাঁচজন গোলপ্রহরীদের দিকে নজর দেওয়া যাক।

বিশাল কয়েথ, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট

 



সবুজ-মেরুন শিবিরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গোলকিপার বিশাল। ২৮ বছর বয়সী এই পাঞ্জাবী গোলকিপার গত মরশুমে ২৫টি ম্যাচ খেলে ন’টি ম্যাচে কোনও গোল খাননি। মোট ৫০টি গোল সেভ করেন তিনি। সেভ পার্সেন্টেজ বা তাঁর গোলের দিকে আসা মোট শটের যত শতাংশ শট তিনি আটকেছেন, তার হার ছিল ৬১। সব মিলিয়ে ৩১টি গোল খেয়েছেন তিনি। এমন পরিসংখ্যান যে গোলকিপারের, তাঁকে যে কোনও দলের কোচই মাথায় করে রাখবেন। তাই এ বার মোহনবাগানের কোচ বদল হলেও গোলকিপার বদল হয়নি। মরশুমের শুরুতেই ডুরান্ড কাপে সেই আস্থার যথাযোগ্য সন্মানও দিয়েছেন ১৮৭ সেন্টিমিটার উচ্চতার বিশাল। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে টাই ব্রেকারে তিনিই একাধিক শট বাঁচিয়ে দলকে জেতান। ফাইনালে অবশ্য সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। আইএসএলে তাঁকে এই ধারাবাহিকতাই আনতে হবে নিজের পারফরম্যান্সে। এর আগে পুণে সিটি, চেন্নাইন এফসি-র হয়ে খেলা বিশাল আইএসএলে ১১৯টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। ৩৯টি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রেখেছেন। মোট সেভ পার্সেন্টেজ ৬৭%। ২৯৫টি সেভ করেছেন। ২০২২-এ সবুজ-মেরুন বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি আরও দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠেন।

ফুর্বা লাচেনপা, মুম্বই সিটি এফসি

 



বাইচুং ভুটিয়ার পর সিকিম থেকে উঠে আসা ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এই ফুর্বা লাচেনপা। গত আইএসএল মরশুমে মুম্বই সিটি এফসি-র কাপ জয়ের সাফল্যে তাঁর অবদান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ২২টি ম্যাচের মধ্যে ন’টিতে ক্লিন শিট বজায় রাখেন তিনি। ওডিশা এফসি-র অমরিন্দর সিং ও মোহনবাগানের বিশাল কয়েথও ন’টি করে ক্লিন শিট রাখেন। কিন্তু তাঁরা আরও বেশি ম্যাচে খেলেন। ফলে ফুর্বাই সেরা গোলকিপার নির্বাচিত হন এবং গোল্ডেন গ্লাভ জিতে নেন। তবে সেভ-এর সংখ্যায় তিনি অন্যান্যদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ২২ ম্যাচে মাত্র ৪২টি গোল সেভ করেন তিনি। অথচ তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৭১%! গোল খান ১৭টি। অর্থাৎ দলের দুর্ভেদ্য রক্ষণ প্রতিপক্ষকে তাদের গোলে বেশি শট নিতেই দেয়নি। সে দিক দিয়ে ফুর্বা অবশ্যই সৌভাগ্যবান। কিন্তু তাই বলে তাঁর কৃতিত্বকে এতটুকু খাটো করার অবকাশ নেই। শিলং লাজং, রিয়েল কাশ্মীরে খেলার পর ২০২০-তে যোগ দেওয়া ১৮৩ সেন্টিমিটার উচ্চতার এই গোলকিপার এ বার মুম্বই দলের প্রধান ভরসা।

গুরপ্রীত সিং সান্ধু, বেঙ্গালুরু এফসি

 



ভারতীয় ফুটবলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে অভিজ্ঞ গোলকিপার গুরপ্রীত, যিনি বেঙ্গালুরু এফসি-র পুরনো যোদ্ধা। ২০১৭-য় বেঙ্গালুরু এফসি-তে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ৩২ বছর বয়সেও ক্রসবারের নীচে তিনি সর্বদা অতন্দ্র। গতবার লিগে ২২টি ম্যাচে ৭০টি সেভ করেছিলেন, যা সবচেয়ে বেশি সেভ-এর তালিকায় ছিল দু’নম্বরে। তাঁর সেভ পার্সেন্টেজও ছিল প্রশংসা করার মতো, ৬৭%। কিন্তু ক্লিন শিট বজায় রাখতে পেরেছিলেন মাত্র পাঁচটি ম্যাচে। ৩৪টি গোলও খেয়েছিলেন, যা তাঁর আইএসএল কেরিয়ারে এক মরশুমে সর্বোচ্চ। ১৩৮টি আইএসএল ম্যাচ খেলা ১৯৭ সেন্টিমিটার উচ্চতার এই দুরন্ত গোলকিপার এখনও ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য। ২০১১-য় বব হাউটনের সময় থেকে ভারতের হয়ে ৭৩টি ম্যাচ খেলে ২৮টি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রেখেছেন গুরপ্রীত। চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপেও ভারতীয় দলে রয়েছেন তিনি। আইএসএলে সব মিলিয়ে তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ৭১%। এ বার বেঙ্গালুরু দলে আরও দুই তরুণ গোলকিপার থাকলেও তিনিই সামলাবেন সুনীল ছেত্রীদের দূর্গের শেষ সীমানা।

অমরিন্দর সিং, ওডিশা এফসি

 



ভারতীয় ফুটবলে তাঁকে দ্বিতীয় সেরা গোলকিপার বলা যেতে পারে। জাতীয় দলে গুরপ্রীতের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠেছেন ১৮৬ সেন্টিমিটার উচ্চতার এই পাঞ্জাবী গোলকিপার। গতবার আইএসএলে সবচেয়ে বেশি সেভ করেছিলেন তিনিই। ২৪টি ম্যাচে ৮১টি সেভ করেন অমরিন্দার, যা তাঁর আইএসএল কেরিয়ারে একই মরশুমে সর্বোচ্চ। ক্লিন শিটও রাখেন সর্বোচ্চ ন’টি ম্যাচে। তবে মুম্বই সিটি এফসি-র ফুর্বা লাচেনপা তাঁর চেয়ে দু’টি ম্যাচ খেলে একই সংখ্যক ক্লিন শিট রাখায় গোল্ডেন গ্লাভ আর জেতা হয়নি অমরিন্দারের। তবে গোলকিপার হিসেবে তাঁর সামগ্রিক পারফরম্যান্স ছিল প্রশংসনীয়। সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৭৭%। এই পরিসংখ্যানও তাঁর আইএসএল কেরিয়ারে সেরা। এই নিয়ে দশম আইএসএল মরশুম হতে চলেছেন তাঁর। ১৬২টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে এই লিগে। এর আগে পুনে সিটি এফসি, এটিকে, বেঙ্গালুরু এফসি, মুম্বই সিটি এফসি এবং এটিকে মোহনবাগানের মতো ক্লাবগুলির হয়ে খেলে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি এখন বিশাল বড়। তাই ভারতীয় দলেও নিয়মিত খেলছেন তিনি। ২০১৭-র অগাস্ট থেকে ভারতের হয়ে ১৩টি ম্যাচ খেলেছেন অমরিন্দার। এর মধ্যে সাতটি ম্যাচে ক্লিন শিট রেখেছেন তিনি। চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপেও প্রথম ম্যাচে তিনি খেলেন এবং ক্লিন শিট বজায় রাখেন।

প্রভসুখন সিং গিল, ইস্টবেঙ্গল এফসি

 


গত মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত তাদের কম গোল খাওয়া নিয়ে যে গর্ব করেছিলেন, তার অনেকটাই তাঁর দলের গোলকিপার প্রভসুখন গিলের জন্য। গতবার গিল ২১টি ম্যাচে সাতটি ক্লিন শিট রাখেন এবং ২৫টি গোল হজম করেন। সেভ করেন ৫৪টি এবং সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৬৮%। যে চারটি আইএসএলে খেলেছেন তিনি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল পারফরম্যান্স ছিল গতবারেই। এর আগে বেঙ্গালুরু এফসি ও কেরালা ব্লাস্টার্সের হয়ে খেলা প্রভসুখনের পিছন থেকে দলের সতীর্থদের সঠিক ভাবে গাইড করা ও উৎসাহ জোগানোর দুর্দান্ত ক্ষমতা রয়েছে। এ ছাড়াও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী তিনি। এই দক্ষতাই তাঁকে কোচের প্রিয় করে তুলেছে। এ বার লাল-হলুদ শিবিরে আর এক অভিজ্ঞ গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদারও যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়াও কমলজিৎ সিং, আদিত্য পাত্ররাও রয়েছেন কুয়াদ্রাতের শিবিরে। তাই গিলকে প্রথম এগারোয় নিজের জায়গা টিকিয়ে রাখতে গেলে গত মরশুমের চেয়েও ভাল ও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখাতে হবে।