কলকাতার ফুটবল প্রেমীদের হৃদয়ে রয়ে গিয়েছেন আইএসএলের যে তারকারা
একবার ভেবে দেখুন, সারা বিশ্ব জুড়ে ফুটবল তারকারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আর কতটাই বা বাড়ত? ইন্ডিয়ান সুপার লিগেও তারকাদের নিয়ে হইচই কম হয় না। প্রতি বছর তারকাদের মেলা বসে দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগে।

একবার ভেবে দেখুন, সারা বিশ্ব জুড়ে ফুটবল তারকারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আর কতটাই বা বাড়ত? ইন্ডিয়ান সুপার লিগেও তারকাদের নিয়ে হইচই কম হয় না। প্রতি বছর তারকাদের মেলা বসে দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগে। প্রতিবার প্রতিষ্ঠিত তারকারা যেমন ম্যাজিক দেখান, তেমনই আবার একাধিক নতুন তারকারও জন্ম হয়, যাঁরা ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করেন এবং তাদের স্মৃতির মণিকোঠায় জায়গাও করে নেন। কলকাতার ক্লাবের হয়ে আইএসএলে খেলা এমনই কয়েকজন জনপ্রিয় তারকাকে নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন, যাঁদের মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে।
লেইন হিউম (এটিকে এফসি, ২০১৫-২০১৭)
কানাডাজাত এই সেন্টার ফরোয়ার্ড যে দুই মরশুমে আতলেতিকো দ্য কলকাতার জার্সি গায়ে খেলেন, সেই দুই মরশুমেই সমর্থকদের মন জয় করে নেন। তাই আজও অনেকে মনে রেখেছে তাঁকে। প্রথমে ২০১৫-র জুনে যোগ দেন এটিকে-তে। সে বছর অক্টোবরে এটিকে-র জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নামেন তিনি। নভেম্বরে গোলের খাতা খোলেন মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে। তাও আবার হ্যাটট্রিকের মাধ্যমে। সেই মাসেরই শেষের দিকে পুনের বিরুদ্ধে ফের হ্যাটট্রিক করেন তিনি। সে বার সব মিলিয়ে ১৪ ম্যাচে ১০টি গোল করেন তিনি। পরের মরশুমে আরও সাতটি গোল উপহার দেন ক্লাবকে। সে বার অবশ্য কোনও হ্যাটট্রিক ছিল না। তবে সেমিফাইনালে জোড়া গোল করে দলকে জেতান। কলকাতার দলের হয়ে ৩০টি ম্যাচে ১৮ গোল করেন হিউম।
রয় কৃষ্ণা (এটিকে এফসি, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২০১৯-২০২২)
ফিজি থেকে আসা রয় কৃষ্ণাকে আইএসএলে কলকাতার ক্লাবে খেলে যাওয়া সবচেয়ে সফল স্ট্রাইকার বললে বোধহয় ভুল হবে না। তিন মরশুমে তিনি এটিকে ও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে ৬০টি ম্যাচ খেলে ৩৬টি গোল করেন। ২০১৯-২০ মরশুমে তিনি এটিকে এফসি-তে যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ান লিগের দল ওয়েলিংটন ফিনিক্স থেকে। আইএসএলে তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচেই গোল পান কৃষ্ণা। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে সেই গোল দিয়েই চালু হয়ে যায় গোলমেশিন। সেই মরশুমে ১৫টি গোল করে সারা দেশের ফুটবল মহলের নজর কেড়ে নেন তিনি। কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। জামশেদপুর এফসি (দুই লেগেই), নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি, হায়দরাবাদ এফসি বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেন তিনি। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকও পান। সে বছর গোলের ফোয়ারা ছোটানরয় কৃষ্ণা। ১৫টি গোল ছাড়াও ছ’টি অ্যাসিস্ট ছিল তাঁর।
পরের মরশুমে নবগঠিত মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দেন তিনি। জার্সি বদলালেও তাঁর মেজাজ বদলায়নি একেবারেই। সে বারেও ২৩ ম্যাচে ১৪টি গোল করেন এবং গোল্ডেন বুট পান। এর মধ্যে কেরালা ব্লাস্টার্স ও ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে ছিল জোড়া গোল। দুই ডার্বিতেই একটি করে গোল করেন কৃষ্ণা। সে বার এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বেও দুটি গোল করেন তিনি। আটটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন সে বার। ২০২১-২২ মরশুম অবশ্য তেমন ভাল যায়নি তাঁর। ১৬টি ম্যাচে সাতটি গোল পান তিনি। এএফসি কাপেও একটি গোল পান। কিন্তু চোট-আঘাত, অসুস্থতা, ব্যক্তিগত সমস্যা ইত্যাদি নানা কারণে সেই মরশুম ভাল যায়নি তাঁর। তবে কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছেন এটিকের হয়ে ১৫টি ও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে ২৪টি গোল করে। হোসে রামিরেজ ব্যারেটোর পর কলকাতায় তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ট্রাইকার।
ডেভিড উইলিয়ামস (এটিকে এফসি, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২০১৯-২০২২)
কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের রয় কৃষ্ণার কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়বে এই অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ডের কথাও। কৃষ্ণার সঙ্গেই ওয়েলিংটন ফিনিক্স থেকে ২০১৯-এ ভারতে আসেন ডেভিড। প্রথম মরশুমেই এটিকে-র হয়ে ১৮টি ম্যাচে সাতটি গোল করেন ও পাঁচটি করান। সে বার দুই সেমিফাইনালেই গোল করেছিলেন তিনি। ২০২০-২১ মরশুমে কৃষ্ণার সঙ্গে তিনিও যোগ দেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে এবং আইএসএলে ২০টি ম্যাচে ছ’টি গোল করেন ও দুটিতে অ্যাসিস্ট করেন। সে বার চারটি এএফসি কাপের ম্যাচ খেলে একটি গোলও পান তিনি। ২০২১-২২ মরশুম কৃষ্ণার মতো তাঁরও তেমন ভাল যায়নি। ১৭টি ম্যাচে চারটি গোল করেন। তবে এএফসি কাপের বাছাই ও গ্রুপ পর্ব মিলিয়ে পাঁচটি ম্যাচে পাঁচটি গোল পান। বাছাই পর্বে বাংলাদেশের আবাহনী লিমিটেডের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকও পান তিনি। যখনই দলের গোলের প্রয়োজন হয়েছে, তখনই ডেভিডকে গোল করতে দেখা গিয়েছে। এটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট। গত মরশুমে তিনি ফিরে যান দেশে, পারথ গ্লোরির হয়ে খেলতে।
দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২০২২- )
দলে কোনও বিশেষজ্ঞ ফরোয়ার্ড না থাকা সত্ত্বেও একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কী ভাবে কোচের নির্দেশে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজেকে স্ট্রাইকারে রূপান্তরিত করে দলকে সাফল্য এনে দিতে পারেন, তা দেখিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। তাঁর অতীতের পারফরম্যান্সের পরিসংখ্যান বলে, তিনি নিজে যত না গোল করেছেন, তার চেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরিতে সাহায্য করেছেন বা অ্যাসিস্ট করেছেন। সবুজ-মেরুন শিবিরের স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দোর চিন্তা ভাবনা সবসময়ই অন্যরকম। তিনি মনে করেন, কোনও একজন ফুটবলারের ওপর গোলের জন্য অতিরিক্ত নির্ভর না করে পুরো আক্রমণ বিভাগের ওপর গোল করার দায়িত্ব দেওয়াটাই ভাল। কিন্তু লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংরা গোলের ঠিকানা কার্যত হারিয়ে ফেলায় ফেরান্দোর পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যায় এবং তার ফলে পেট্রাটসের ওপর পুরো চাপ পড়ে যায়। চাপটা অবশ্য নিয়ে নেন এই অস্ট্রেলীয় তারকা। গত আইএসএল মরশুমে তিনি ২৩ ম্যাচে ১২ গোল ও সাতটি অ্যাসিস্ট করেন। কেরালা ব্লাস্টার্সের মাঠে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে আসেন তিনি। রাশিয়ায় বিশ্বকাপ দলের সদস্য পেট্রাটস এ মরশুমেও সবুজ-মেরুন জার্সি পরেই আইএসএলে নামবেন। তবে এ বার তাঁর দলে একাধিক বিদেশি ফরোয়ার্ড ও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার রয়েছেন। তাই এ বার তিনি অনেকটাই চাপমুক্ত হয়ে নিজের আসল খেলাটা খেলতে পারবেন। তাই এ বার আইএসএলে তিনি আরও ধারালো হয়ে উঠবেন, না পুরনো ভূমিকায় (অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার) ফিরে যাবেন, সেটাই দেখার।
ব্রাইট এনোবাখারে (ইস্টবেঙ্গল এফসি, ২০২০-২১)
খুব কম সময়ের জন্যই আইএসএল গ্রহে পা রেখেছিলেন এই নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড। সব মিলিয়ে এক হাজার মিনিটও মাঠে ছিলেন না তিনি। কিন্তু লাল-হলুদ জার্সি গায়ে যে টুকু সময় খেলেন তিনি, তাতেই সমর্থকদের মন জিতে নেন ব্রাইট এনোবাখারে। ২০২১-এর ১ জানুয়ারি কলকাতার ক্লাবে যোগ দেন তিনি। মরশুমের মাঝখানে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বলে তাঁকে নিয়ে কিছুটা সন্দেহই ছিল সমর্থকদের মনে। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে ৭০ মিনিটের পরে নামানো হয় নবাগত ব্রাইট ইনোবাখারেকে। জাক মাঘোমার জায়গায় নামেন ব্রাইট। অভিষেকেই গোল করে দলকে লিগের প্রথম জয় এনে দেওয়ায় ব্রাইটকে নিয়ে রীতিমতো মাতামাতি শুরু হয়। এর পরের ম্যাচেই তাঁর অসাধারণ গোল তাঁকে নায়কের আসনে বসিয়ে দেয়। মাঘোমার পাস থেকে বল পেয়ে দ্রুত দৌড়ে বিপক্ষের পাঁচ ফুটবলারকে ডজ করে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে অসাধারণ ও বিশ্বমানের গোল করে দলকে এগিয়ে দেন তিনি। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে যে গোলটি করেছিলেন ব্রাইট, তাও ছিল অসাধারণ ও দর্শনীয়। মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে এক স্প্রিন্টে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি ও ডান পায়ের আউটস্টেপে ছোট্ট এক টোকায় গোলে বল জড়িয়ে দেন তিনি। এইটুকু সময়েই যে ভাবে নিজেকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যান, তা অভাবনীয়। এখনও লাল-হলুদ সমর্থকদের মুখে শোনা যায় তাঁর নাম।
লিস্টন কোলাসো (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ২০২১-)
গোয়া থেকে উঠে আসা এই ২৩ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে যোগ দিয়ে আইএসএলে ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করেন। একই মরশুমে মোট আট গোল করেন তিনি। একসময় লিগে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের প্রধান ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই তরুণ ফরোয়ার্ড। রেকর্ড ট্রান্সফার ফি দিয়ে তাঁকে হায়দরাবাদ এফসি থেকে নিয়ে এসেছিল সবুজ-মেরুন শিবির। সেই সিদ্ধান্ত যে একেবারেই ভুল ছিল না, তা প্রথম মরশুমেই অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা যে গোলগুলি তিনি করেছেন, তার বেশির ভাগই মনে ছাপ ফেলার মতো। সুনীল ছেত্রী ছাড়া আর কোনও ভারতীয় আইএসএলের একই মরশুমে এত গোল করতে পারেননি। সবুজ-মেরুন শিবিরে যোগ দেওয়ার পরে তিনি যে শুধু ১৪টি গোল করেছেন, তা নয় আটটি গোলে প্রত্যক্ষ সাহায্যও করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে দলের অন্যতম সেরা কার্যকরী ফুটবলার হিসেবেও গড়ে তুলেছেন কোলাসো। সে বার আইএসএলে দশটির মধ্যে আটটি দলের বিরুদ্ধেই গোল করেন তিনি।