প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এক নম্বর জায়গায় থেকে লিগ শেষ করতে না পারেনি এটিকে মোহনবাগান। ফলে লিগশিল্ড তথা আগামী এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয় তাদের। এ জন্য সবুজ-মেরুন সমর্থকদের হয়তো মন খারাপ। কিন্তু সেমিফাইনালে নিজেদের জায়গা পাকা করার পথে যে দাপুটে পারফরম্যান্স তারা দেখিয়েছে, সে কথা ভেবে তারা খুশি হতেই পারেন। এই দাপুটে পারফরম্যান্সই তাদের ফাইনালে ওঠার আশা আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।

অভিষেক মরশুম স্মরণীয় করে রাখার মতোই খেলেছে এটিকে মোহননবাগান। কলকাতা ডার্বির দুই লেগেই তারা চিরপ্রতিদ্বন্দী এসসি ইস্টবেঙ্গলকে হারায়। ওডিশা এফসি-কে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারায় তারা এবং গত মরশুমে মোহনবাগানকে আইলিগ জেতানো কোচ কিবু ভিকুনার প্রশিক্ষণাধীন কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে পিছিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৩-২ জয় পায় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। এক নম্বরে থেকে শেষ করতে পারলে তা হত সোনায় সোহাগা। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য শেষ দুই ম্যাচে ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পারল না তারা। তার আগের পাঁচ ম্যাচে জেতার পরেও শেষ দুই ম্যাচে না জিততে পারায় দুই নম্বরেই থেকে যেতে হল তাদের।

সবুজ-মেরুন অভিযান

প্রথম তিন ম্যাচে একটিও গোল না খেয়ে সবক’টিতেই জয়। এই তিন ম্যাচে চার গোল দিয়েছিল তারা, যার মধ্যে এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ২-০ জয়ও ছিল। এর চেয়ে ভাল শুরু একটা দলের পক্ষে আর কীই বা হতে পারে? এটিকে মোহনবাগানের শুরুটা এমনই হয়েছিল এ বারের হিরো আইএসএলে। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে নেমে প্রথম ধাক্কাটা খায় তারা। ১-২ গোলে হারে সবুজ-মেরুন বাহিনী। পরের ম্যাচটা আবার হায়দরাবাদ এফসি-র  বিরুদ্ধে ১-১ ড্র।

পরপর দুই ম্যাচে ধাক্কা খেলেও পরপর দুই ম্যাচে এফসি গোয়া ও বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারিয়ে তারা ফের সাফল্যের রাস্তায় ফিরে আসে। তখন চার ম্যাচে দশ পয়েন্ট পেলেও মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে অল্পের জন্য জয় পাওয়া হয়ে ওঠেনি তাদের। তবে মুম্বইয়ের কাছে হারের চেয়ে বড় ধাক্কা ছিল নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র কাছে ১-২ হার। অসাধারণ ও কৌশলী ফুটবলের মাধ্যমে লিগ টেবলের দু’নম্বরে থাকা এটিকে মোহনবাগানকে সে দিন ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় নর্থইস্ট ইউনাইটেড। তাদের পরিচিত সেরা ফুটবল দেখাতে না পারার মাশুল দিতে হয় কলকাতার ক্লাবকে। স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তাঁর দলের রক্ষণে সমস্যা দেখা দেয়। যার সুযোগ নিয়ে সে দিন ম্যাচ জেতে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি।

জয়ে না ফিরতে পারলেও বেশ কয়েকটি ম্যাচ গোল না পাওয়ার পরে সে দিন গোলে ফিরেছিলেন রয় কৃষ্ণা। এবং তাঁর এই গোলে ফেরাটাই সবুজ-মেরুন শিবিরকে অনেকটা চাঙ্গা করে দেয়। রয় কৃষ্ণা ফর্মে ফিরতেই এটিকে মোহনবাগান আগের চেহারায় ফিরে আসে এবং পরের পাঁচটি ম্যাচই জেতে তারা। এরমধ্যে কেরালার বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও জয়, ওডিশার বিরুদ্ধে ৪-১ ও দ্বিতীয় কলকাতা ডার্বিতেও জয় ছিল উল্লখেযোগ্য। টানা এই পাঁচ ম্যাচে জয়ই তাদের এক নম্বরে নিয়ে চলে যায়। সে জন্য অবশ্য মুম্বই সিটি এফসি-র টানা তিন ম্যাচে জয়হীন থাকাটাও অনেকটা দায়ী। এটিকে মোহনবাগান যে সময়ে টানা সাফল্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়ে মুম্বই সিটি এফসি-র সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। আবার মুম্বই যখন দুঃসময় কাটিয়ে শেষ দুই ম্যাচে সাফল্যের রাস্তায় ফিরে এল, তখন গঙ্গাপাড়ের দল অপ্রত্যাশিত ভাবে ছন্দ হারায়। তবে এটা বলতেই হবে যে, সারা লিগে এক বারও সেরা চার থেকে ছিটকে যায়নি এটিকে মোহনবাগান শিবির। তবু লিগশিল্ড অধরাই রয়ে গেল তাদের। এরই নাম ফুটবল!

দুই দলই ৪০ পয়েন্ট করে অর্জন করে লিগ টেবলের শীর্ষে ছিল। কিন্তু দুই দলের দু’বারের মুখোমুখিতে দু’বারই মুম্বই জেতায় শীর্ষস্থানে ওঠার দৌড়ে ফোটোফিনিশ করে সাগরপাড়ের দলই।

একঝাঁক তারকা

পুরো দলটাই ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে সেরা চারে জায়গা করে নিলেও প্রত্যেক দলে যেমন কয়েকজন তারকা ও নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় থাকেন, এটিকে মোহনবাগান দলেও তেমনই কয়েকজন তারকা রয়েছেন। প্রথমেই যার কথায় আসতেই হবে, তিনি আর কেউ নন, রয় কৃষ্ণা। ফিজি থেকে আসা এই তারকা স্ট্রাইকারই এটিকে মোহনবাগানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য ফুটবলার। কোচ হাবাস যদিও স্বীকার করেন না যে দলটা রয় কৃষ্ণার ওপর অনেকটাইনির্ভর করে। তবে তার প্রমাণ একাধিকবার পাওয়া গিয়েছে। এ বারের হিরো আইএসএলে যখন রয়ের পায়ে গোলখরা চলছিল, তখন দলের গোলসংখ্যাও ছিল দুশ্চিন্তায় রাখার মতো। রয় গোলে ফিরতেই দলের গোলের সংখ্যা একলাফে অনেক বেড়ে যায়।

তবে শুধু গোলের সামনে নয়, যখন যেখানে তাঁকে প্রয়োজন, তখনই তাঁকে দেখা গিয়েছে। তবে তাঁর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড ডেভিড উইলিয়ামসের বোঝাপড়া বিপক্ষের ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে একাধিক ম্যাচে। রয় কৃষ্ণা নিজে যেমন আনপ্রেডিক্টেবল, কখন কোন জায়গা থেকে ছিটকে বেরিয়ে বলের কাছে চলে যাবেন, তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন, তেমনই ডেভিডের গতিবিধি আন্দাজ করাও সহজ নয়। তাই এই দু’জন যখন একসঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠেন, তখন বিপক্ষ তাদের সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়।

জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোয় যখন ওডিশা এফসি থেকে সবুজ-মেরুন শিবিরে এসে এই দু’জনের সঙ্গে যোগ দেন অভিজ্ঞ ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড মার্সেলো পেরেইরা বা মার্সেলিনহো, তখন সেই কম্বিনেশন আরও ধারালো হয়ে ওঠে। এটিকে মোহনবাগানে আসার আগে মার্সেলো ওডিশার আটটি ম্যাচে নেমে একটিও গোল পাননি। কিন্তু হাবাসের সংষ্পর্ষে এসে ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেন তিনি এবং সবুজ-মেরুন জার্সিতে প্রথম ম্যাচেই গোল পেয়ে যান। পরে আরও একটি গোল করেন তিনি।

মনবীর সিং-এর পারফরম্যান্স এ বারের হিরো আইএসএলে প্রথম থেকেই যথেষ্ট ভাল। লিগের ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল যেখানে সুনীল ছেত্রীর, সেখানে পাঁচ গোল করে তার পরেই রয়েছে মনবীরের নাম। এমনিতেই সুযোগসন্ধানী এই ফরোয়ার্ড। ডানদিকের উইং দিয়ে আক্রমণে ওঠার ব্যাপারে পারদর্শী। তবে কোচ তাঁকে বাঁ দিকের উইংয়েও ব্যবহার করে থাকেন। কোণাকুণি শটে গোল করতে তিনি গোল করার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট দক্ষ। এ ভাবে একাধিক গোল করেওছেন তিনি। হ্যাটট্রিকের সুযোগও হাতছাড়া করেন একটি ম্যাচে। তিনি যে দিন ভাল ফর্মে থাকেন, সে দিন তাঁকে রোখা কঠিন, কিন্তু মনবীরের সমস্যাটা হল, তিনি ধারাবাহিক নন। সব ম্যাচেই যে দলকে ভরসা জোগাতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। না হলে হয়তো আরও গোল পেতেন তিনি। এডু গার্সিয়া, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ, সন্দেশ ঝিঙ্গন, প্রীতম কোটাল, তিরি-দেরও অবদান যথেষ্ট। আর গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যের প্রশংসা তো করতেই হবে। এ পর্যন্ত ক্রসবারের নীচে দাঁড়িয়ে ৫০টি সেভ করেছেন তিনি। দশটি ম্যাচে ‘ক্লিন শিট’ রেখে মাঠ ছেড়েছেন অরিন্দম।

ফাইনালিস্ট হওয়ার যোগ্য, কিন্তু...

কোচ হিসেবে হিরো আইএসএলে দু’বার চ্যাম্পিয়নের খেতাব জেতা আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের হাতে যা দল রয়েছে, তাতে এ বার তিনি তৃতীয় খেতাবও জিততে পারেন। কিন্তু সঠিক সময়ে সবাই ঠিকমতো পারফর্ম না করতে পারলে যে ভাবে লিগশিল্ড হাতছাড়া হয়েছে, সে ভাবে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটাও হাতছাড়া হতে পারে। এই স্তরের ম্যাচে খেলতে হলে যে ধরনের টেম্পারমেন্ট ও অভিজ্ঞতা লাগে, তা এই দলের খেলোয়াড় ও কোচেদের রয়েছে।

তবে ফাইনালে ওঠা তাদের পক্ষে মোটেই সোজা হবে না। কারণ, যাদের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের লড়াইয়ে  নামবে তারা, সেই নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি গত দশটি ম্যাচে অপরাজিত। সবচেয়ে বড় কথা তাদের শেষ মুখোমুখিতে ভারতীয় কোচ খালিদ জামিলের দল হাবাস-বাহিনীকে হারিয়ে দেয়। প্রথমবার অবশ্য হাবাসের দলই তাদের বিরুদ্ধে জেতে। তাই সেমিফাইনালের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কারা শেষ হাসি হাসবে, সেটা আগাম বলা বেশ কঠিন।

দল হিসেবে ও খাতায় কলমে ফুটবলারদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বিচারে অবশ্য এগিয়ে এটিকে মোহনবাগানই। কিন্তু ফুটবল এমনই একটা খেলা যে খাতায় কলমের হিসেবের ধার ধারেনা সে। তাই ফুটবলে অঘটন অতীতেও অনেকবার ঘটেছে, এখনও ঘটে চলেছে, ভবিষ্যতেও কত যে ঘটবে, তার সীমা নেই।