প্রিভিউ: কঠিনতম সাফ ফাইনালে কুয়েত ও ভারতের লড়াই সক্ষমতা, দক্ষতার
চেনা টুর্নামেন্ট, চেনা ফাইনাল, চেনা মাঠ, চেনা দর্শক। অচেনা শুধু ফাইনালের প্রতিপক্ষ। কী করেই বা চেনা হবে? এর আগে তো কখনও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেনি কুয়েত? সাফ ফুটবল মানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির অংশগ্রহণে হওয়া টুর্নামেন্ট। সেখানে এই প্রথম লেবানন ও কুয়েতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রতিযোগিতার মান বাড়ানোর জন্য। দুই অতিথি দলই সেমিফাইনালে ওঠে।


চেনা টুর্নামেন্ট, চেনা ফাইনাল, চেনা মাঠ, চেনা দর্শক। অচেনা শুধু ফাইনালের প্রতিপক্ষ। কী করেই বা চেনা হবে? এর আগে তো কখনও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেনি কুয়েত? সাফ ফুটবল মানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির অংশগ্রহণে হওয়া টুর্নামেন্ট। সেখানে এই প্রথম লেবানন ও কুয়েতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রতিযোগিতার মান বাড়ানোর জন্য। দুই অতিথি দলই সেমিফাইনালে ওঠে। লেবাননকে বিদায় দিয়েছে আটবারের সাফ চ্যাম্পিয়ন ভারত। কিন্তু কুয়েতের মুখের ওপর ফাইনালের দরজা বন্ধ করে দিতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও কুয়েত, ফিফার ক্রমতালিকায় যাদের বর্তমান অবস্থান যথাক্রমে ১০০ ও ১৪১।
প্রতিপক্ষ শুধু অচেনা নয়, কঠিনতমও। একচল্লিশ ধাপ পিছনে থাকলেও কুয়েত কিন্তু ভারতের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই টুর্নামেন্টে নেপালকে ৩-১-এ ও পাকিস্তানকে ৪-০-য় হারিয়ে লিগের শেষ ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হয় তারা। ভারত ৯০ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে থাকলেও আত্মঘাতী গোল দিয়ে ১-১ ড্র করে। বিশ্ব ক্রম তালিকায় ১৪১ নম্বরে থাকলেও দলটা ছুটছে কিন্তু তাজা ঘোড়ার মতো। তাদের পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছে ১০০-য় থাকা ভারতের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না তারা।
সাফের কঠিনতম ফাইনাল!
আসলে শারীরিক দিক থেকে কুয়েতিরা অনেকটাই এগিয়ে। এবং শরীরি ফুটবল খেলার প্রবণতাও তাদের বেশি। কিন্তু স্কিল দিয়ে যে শরীরি চ্যালেঞ্জকে মাত করে দেওয়া যায়, তা ফুটবল ইতিহাসে অনেকবার দেখা গিয়েছে। ইউরোপের আগ্রাসী শরীরি ফুটবল অনেকবারই পরাজিত হয়েছে লাতিন ফুটবলের শিল্প ও দক্ষতার কাছে। কয়েকদিন আগে এই টুর্নামেন্টে লিগ পর্বের ম্যাচে ভারতও সেটাই প্রমাণ করে। নিজেদের ভুলে আত্মঘাতী গোল না হলে ম্যাচটা জিতেই মাঠ ছাড়তেন সুনীল ছেত্রীররা। তবে সেই ম্যাচে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল কুয়েত, যে ভাবে নিজেদের দূর্গ আগলে রেখেছিল তারা, তাকে অসাধারণ বলাই যায়।
সে দিন দুই দলের মধ্যে ফুটবলের লড়াইয়ের পাশাপাশি একাধিকবার অশান্তির ঝড়ও ওঠে। অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে ভারতীয় দলের হেড কোচ ইগর সিটমাচকে লাল কার্ড দেখে মাঠে ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। এই ম্যাচেই তিনি লাল কার্ডের সাসপেনশন কাটিয়ে মাঠে ফিরেছিলেন। কিন্তু ফের লাল কার্ড দেখায় ফাইনালেও তাঁর ভারতের ডাগ আউটে থাকা হচ্ছে না। শুধু কোচ নয়, ভারতীয় দলের তরুণ ফরোয়ার্ড বাংলার ফুটবলার রহিম আলিও শেষ দশ মিনিটের জন্য পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমে মেজাজ গরম করে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অপরাধে লাল কার্ড দেখেন।
মঙ্গলবার খেতাবী লড়াইয়েও যে এমন ঘটনা ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু যে দল মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজেদের মাথা ঠাণ্ডা রেখে ফোকাস বজায় রেখে বেশিক্ষণ খেলে যেতে পারবে, জয় তাদের কাছেই হাসবে। ফুটবলের ইতিহাস এবং ব্যাকরণ অন্তত সে কথাই বলে।
নীল নকশা তৈরি নীল-শিবিরে!
ভারতের প্রাক্তন ফুটবল তারকা ও বর্তমান সহকারী কোচ মহেশ গাওলি অবশ্য জানিয়েই দিলেন, সুনীল ছেত্রী ও তাঁর সতীর্থদের মঙ্গলবার মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কুয়েত, লেবানন দুই দলের সঙ্গে ম্যাচেই উত্তেজনার পারদ চড়ে গিয়েছিল। ছেলেদেল বলে দেওয়া হয়েছে, এবার যেন মাথা ঠাণ্ডা রেখে ফাইনাল জয়ের ফোকাস বজায় রেখে খেলে। কারণ, এটা একেবারে অন্যরকম ম্যাচ। আমাদের দলে একটা ইতিবাচক মানসিকতা রয়েছে। আশা করি, গত কয়েকদিন ধরে আমরা যেমন খেলে আসছি, তা বজায় রাখতে পারব”।
হেড কোচ স্টিমাচ যে লাল কার্ড দেখার জেরে ফাইনালেও মাঠে থাকতে পারবেন না, তা ফের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে মাঠের বাইরে তিনি সমান তৎপর ও ছটফটে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তিনি বলেন, “লেবাননকে হারানোটা দারুন কিছু না হলেও কোনও গোল না খেয়ে জেতার কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে হবে ছেলেদের। ১২০ মিনিট ধরে এবং পেনাল্টি শুট আউটের সময়েও যে ভাবে সমর্থকেরা আমাদের জন্য গলা ফাটিয়েছেন, সেজন্যও কৃতিত্ব প্রাপ্য ওদের। যদিও দু’বার আমরা ওদের একেবারে আমাদের গোলের সামনে এসে আক্রমণের সুযোগ দিয়েছি, যা উচিত হয়নি। তবে সব মিলিয়ে সব কিছুই ইতিবাচক রয়েছে”।
রবিবার সন্ধ্যায় মুষলাধারা বৃষ্টির মধ্যে অনুশীলন চলার সময় এই সাক্ষাৎকার দেন স্টিমাচ। তিনি বলেন, “এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ছেলেরা কেমন পূর্ণ উৎসাহে অনুশীলন করে চলেছে দেখছেন। প্রতিদিন ওরা উন্নতি করছে। শিবিরে শান্তি ও খুশি রয়েছে সব সময়”। মঙ্গলবারের ম্যাচে নিয়ে স্টিমাচ বলেন, “এই ম্যাচে শরীরি সক্ষমতার পরীক্ষা তো হবেই। তবে আমরা যে ভাবে ওদের চাপে রাখব এবং আক্রমণে উঠব, তা আটকানো কুয়েতের পক্ষে সহজ হবে না। অনুশীলনে ছেলেরা যে ফুটবল খেলছে তার মধ্যে যেমন তীব্রতা থাকছে, তেমন আগ্রাসনও থাকছে। আমার মনে হয় ফাইনালের জন্য আমরা তৈরি হয়েই মাঠে নামব”।
সন্দেশের রক্ষণই ভরসা
কার্ড সমস্যার জন্য সেমিফাইনালে নামতে পারেননি দলের রক্ষণের সবচেয়ে বড় ভরসা সন্দেশ ঝিঙ্গন। ফাইনালে তিনি মাঠে নামার জন্য ছটফট করছেন। তিনি বলেন, “ফাইনালে ওঠার ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমি ফাইনালের প্রস্তুতি তাই আগেই শুরু করে দিই। এখন পুরো ফোকাস কুয়েতের ওপর। গত ৮-১০টা ম্যাচের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন দল ছিল এটাই। এই ম্যাচটাও কঠিন হবে। ঈশ্বর করুন, এই ম্যাচে আমরা জিতে যেন সবার মুখে হালি ফোটাতে পারি”।
গত দশটি ম্যাচে মাত্র একটি গোল খেয়েছে ভারত। রক্ষণে তাদের সাম্প্রতিককালে এতটা শক্তিশালী লাগেনি কখনও। এর জন্য প্রাক্তন তারকা ডিফেন্ডার গাওলির কৃতিত্ব অনেকটাই বলে জানান বর্তমানে তাঁরই উত্তরসূরী ঝিঙ্গন। তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “মহেশভাই তার খেলোয়াড়জীবনে দেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ছিল। আমরা সবাই ওঁকে দেখেই বড় হয়েছি। মহেশভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ শিবির করার পরে তো উপকার হয়েছেই। আমাদের রক্ষণ যে এত প্রশংসা পাচ্ছে, তার কৃতিত্ব অনেকটাই মহেশভাইয়ের। সব সময় প্রতি সেশনে ওঁর ইনপুট আমাদের ভীষণ কাজে লাগে। এমন একটা সিস্টেম রয়েছে আমাদের, যা প্রতি খেলোয়াড়ের সেরাটা বের করে আনতে পারে”।
‘ফাইনালে অন্যরকম খেলা’
সেমিফাইনালে দুই দলকেই ১২০ মিনিটের লড়াই লড়তে হয়েছে। কুয়েত অতিরিক্ত সময়েই গোল করে বাংলাদেশকে হারায়। কিন্তু ভারতকে টাইব্রেকার বা পেনাল্টি শুট আউট পর্যন্ত গিয়ে তার পরে ফাইনালের ছাড়পত্র অর্জন করতে হয়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতকেই বেশি কষ্ট করে ফাইনালে উঠতে হয়েছে।
তবে মঙ্গলবারের ম্যাচ যে অন্যরকম হবে, তা বলছেন কুয়েতের কোচ রুই বেনতো-ও। তাঁর মতে, “ভারতের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন ম্যাচ খেলেছি, ঠিকই। কিন্তু আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, ফাইনাল সব সময়ই অন্য রকম হয়। এই ম্যাচে আমরা খেতাবের জন্য লড়ব। দলের খেলোয়াড়দের ফোকাস থেকে ভাল খেলতে বলেছি। ফাইনালে ওঠার জন্য আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি। এ বার এই ম্যাচ উপভোগ করার পালা, দলের ফুটবলারদের এটাই আমার বার্তা”।
ভারতের মতোই সাম্প্রতিককালে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে কুয়েতও। গত আটটি ম্যাচের একটিতেও হারেনি তারা। দলের সবচেয়ে কার্যকরী ফুটবলার আব্দুল্লাহ আল-ব্লৌশিই তফাৎ গড়ে দিতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে তাঁর নীচু শটে করা গোলেই জেতে কুয়েত। ভারতের বিরুদ্ধে ডান উইং থেকে তাঁর ক্রসই ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজ গোল করে ফেলেন আনোয়ার আলি। সুতরাং তাঁকে কড়া নজরে রাখার জন্য নিশ্চয়ই আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের।
পর্তুগীজ কোচ রুই বেনতো কুয়েত দলের দায়িত্ব নেন গত বছর এবং দলকে প্রথম চ্যাম্পিয়ন খেতাব এনে দিতে মরিয়া তিনি। ২০১০-এ শেষবার কোনও খেতাব পেয়েছিল কুয়েত। সেবার তারা সৌদি আরবকে ফাইনালে হারিয়ে আরবিয়ান গালফ্ কাপে অংশ নেন। গত ২১ দিনে সাতটি ম্যাচ খেলার পরে তাঁর দলের খেলোয়াড়রা ক্লান্ত। তবে তার জন্য ফাইনালে কম লড়বে না তাঁর বাহিনী, জানিয়েই দিলেন কোচ।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “খুব কম সময় অনেক বেশি ম্যাচ খেলেছি আমরা। তবে এটা যেহেতু ফাইনাল, তাই আমরা সেরাটাই দেব। নিজেদের খেলার প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে হবে আমাদের এবং সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ীই খেলতে হবে”।
সংখ্যায় সমতার আনার সুযোগ
ফুটবল ইতিহাস বলছে, কুয়েতের বিরুদ্ধে চারটি ম্যাচ খেলে ভারত এ পর্যন্ত মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছে। কুয়েত জিতেছে দু’টিতে। ২০১০-এ ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ৯-১-এ ভারতকে হারিয়েছিল এই পশ্চিম এশীয় দেশ। তার আগে ১৯৭৮-এর এশিয়ান গেমসে ৬-১-এ জেতে কুয়েত। তবে এই দুইয়ের মাঝখানে ২০০৪-এ ভারত তাদের হারায় ৩-২-এ। তবে এখন ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। গত ম্যাচেই ভারত কুয়েতের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু নিজেদের ভুলেই শেষ পর্যন্ত সেই জয় পাওয়া হয়ে ওঠেনি। মঙ্গলবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে এই পরিসংখ্যান ২-২ করার সুযোগ সুনীল ছেত্রীদের সামনে। সাফের সবচেয়ে কঠিন ফাইনাল জেতার পরীক্ষায় উতরে যেতে পারবে ভারত? আর কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষার পরই তা জানা যাবে।
ভারতীয় স্কোয়াড: গোল- গুরপ্রীত সিং সান্ধু, অমরিন্দর সিং, গুরমিত সিং,
রক্ষণ- শুভাশিস বোস, প্রীতম কোটাল, সন্দেশ ঝিঙ্গন, আনোয়ার আলি, আকাশ মিশ্র, মেহতাব সিং, রাহুল ভেকে,
মাঝমাঠ- লিস্টন কোলাসো, আশিক কুরুনিয়ান, সুরেশ সিং ওয়াংজাম, রোহিত কুমার, উদান্ত সিং, অনিরুদ্ধ থাপা, নাওরেম মহেশ সিং, নিখিল পূজারী, জিকসন সিং, সাহাল আব্দুল সামাদ, লালেঙমাউইয়া রালতে, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, রাওলিন বোর্জেস, নন্দ কুমার শেখর,
আক্রমণ- সুনীল ছেত্রী, রহিম আলি।
টুর্নামেন্ট: সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০২৩
ম্যাচ: ফাইনাল - ভারত বনাম কুয়েত
ভেনু: কান্তিরাভা স্টেডিয়াম, বেঙ্গালুরু
কিক অফ: ৪ জুলাই, সন্ধ্যা ৭.৩০
টিভি সম্প্রচার: ডিডি স্পোর্টস
অনলাইন স্ট্রিমিং: ফ্যানকোড অ্যাপ