কেরালা ব্লাস্টার্সের জার্সি গায়ে মাঠে নেমে তিনি গত মরশুমে জিতে নিয়েছিলেন গোল্ডেন বুট। এ মরশুমে ইস্টবেঙ্গল এফসি-তে যোগ দেওয়ার পর থেকে সেই দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের পা থেকে বেশি গোল দেখতে পাচ্ছেন না সমর্থকেরা। কেন এমন হচ্ছে গ্রিক ফরোয়ার্ডের। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁকেই। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি।

আইএসএলের ২০২২-২৩ মরশুমের আগে কেরালা ব্লাস্টার্সে যোগ দেন দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। সে মরশুমে ২১ ম্যাচে দশ গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। গত মরশুমে কেরালার দলের হয়ে ১৭ ম্যাচে ১৩টি গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট করে সোনার বুট জিতে নেন তিনি। কিন্তু এ বার ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার পরে ১৫টি ম্যাচ খেলে ফেললেন। কিন্তু তিনটির বেশি গোল করতে পারেননি। অনেকেরই প্রশ্ন, গোলমেশিনের পায়ে কেন এমন গোলের খরা! তারই জবাব তিনি দিয়েছেন আইএসএলের ইউটিউব চ্যানেলের সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘ইন দ্য স্ট্যান্ডস’-এ।

ব্লাস্টার্স ছেড়ে কেন ইস্টবেঙ্গলে এলেন, তিন বছরে ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে তাঁর ধারণা কতটা পাল্টেছে—এই বিষয়গুলি নিয়েও এই সাক্ষাৎকারে মন খুলে কথা বলেছেন ইস্টবেঙ্গলের ‘দিমি’। সাক্ষাৎকারটিতে বাংলা সাবটাইটেলও পেয়ে যাবেন।

দু’বছর ব্লাস্টার্সের হয়ে খেলার পর ইস্টবেঙ্গলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে আমার সঙ্গে প্রাক্তন কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতের কথা হয়। উনি কী কী করতে চান, তা বিস্তারিত ভাবে বলেছিলেন আমাকে। তার পরে ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা হয়। তখন আরও তিনটি ক্লাবের প্রস্তাব ছিল আমার কাছে। এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, তখন আমি জেনে গিয়েছিলাম যে কেরালা ব্লাস্টার্সে আমি থাকছি না। আর ইস্টবেঙ্গল আমাকে খুব চাইছিল। ওরা বলে, ওরা বড় কিছু করতে চায়। ওদের ইতিহাসটাও তখন জানি তখন। সে জন্যই এখানে আসি”।

কেরালায় থাকতে প্রচুর গোল করেছেন তিনি। সেই সময়ের কথা জানিয়ে দিয়ামান্তাকস বলেন, “কেরালায় আমার দলের সতীর্থরা আমাকে খুব ভাল করে চিনত। লুনা এবং অন্য খেলোয়াড়রা জানত, ঠিক কোন জায়গায় বল চাই আমি। সেখানে আমি কী ভাবে মুভ করব। মাঝে মাঝে আমরা একে অপরের দিকে তাকাতামও না। প্রথম বছরে, আমি বেশি গোল করিনি। দশটা কি বারোটা গোল করেছিলাম। এই বোঝাপড়াটা তৈরি করতে হয়।”

কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে এসে তিনি যে সমস্যায় পড়েছেন, তা জানাতে দ্বিধা করেননি দিমি। বলেন, “এখানে আমরা এখনও (একে অপরকে জানার) প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কারণ, মাঝে মাঝে ওরা আমার মুভমেন্ট বুঝতে পারছে না। আমরা দু'জন নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়কে খুইয়েছি। একজন, (মাদি) তালাল। যার সঙ্গে আমার যোগাযোগটা ভাল ছিল। আর সউল (ক্রেসপো), যার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ভাল। প্রতি ম্যাচে সতীর্থরা আমাকে ক্রমশ বুঝতে পারছে এবং আমাকেও ওদের বুঝতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমি গোল না করলেও দল জেতে”।

খেলোয়াড়দের জীবনে যে ভাল সময়ের মতো খারাপ সময়ও আসে, তা সমর্থকদের মনে করিয়ে দিয়ে তিনি এই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রতি ম্যাচে সেরা ছন্দে থাকা তো সম্ভব না। এমনকী কেউ চাইলেও না। কোনও কোনও দিন, ভাল খেলা যায় না। যারা ফুটবল দেখে, তাদের অনেকেই এটা বোঝে না। হতে পারে, তোমার একটা দিন খারাপ গিয়েছে। কিন্তু আমিও বুঝি। কারণ, যারা এগুলো (সোশ্যাল মিডিয়ায়) লেখে, তাদের বেশিরভাগই সমর্থক। সমর্থকেরা শুধু জিততে চায় এবং জিততে না পারলে ওরা অপমান করে”।

অভিজ্ঞ ফুটবলার মনে করেন, “আমার কাছে এটা সমস্যা নয়। কারণ, আমি জানি পরের ম্যাচে বা অনুশীলনে, আমি নিজের সেরাটাই দেব”।

ভারতে বাংলা, কেরালা, গোয়ার মতো ফুটবল-পাগল রাজ্য আর একটাও যে নেই, তা কারও অজানা নয়। এখানে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা ও আবেগ আকাশছোঁয়া। তবে দিয়ামান্তাকস মনে করেন, এখানে সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপ কম। যা শুনতে অবাক লাগলেও গ্রিক ফরোয়ার্ডের মতে, এটাই সত্যি।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, এখানে, এই ভারতে, যেহেতু আমি অনেক দেশেই খেলে এসেছি, এখানে অত চাপ নেই। কেউ যদি অন্য দেশে খেলে - যেমন গ্রিস, জার্মানি। জার্মানিতেও অতটা নেই। ৯০ মিনিটের চাপ। তার পরে লোকে ম্যাচের কথা ভুলেই যায়। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ায়, যেহেতু এটা বল্কান দেশ (হাজদুক স্প্লিটে খেলেছেন)। ওখানে, হেরে যাওয়ার পর বাড়ি থেকে বেরনো যায় না। না হলে লুকিয়ে থাকতে হবে। রেস্তোরাঁয় গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। একে বলে চাপ। সে জন্যই বললাম, এখানে চাপ কম”।

গ্রিসের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এই সফল ফরোয়ার্ড। ২০১২-য় অনূর্ধ্ব ১৯ উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স আপ গ্রিক দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। নিজের দেশ ছাড়াও জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া ও ইসরায়েলের ক্লাব ফুটবলেও খেলেছেন তিনি।

বাংলা ও কেরালার সমর্থকদের ফারাক নিয়ে দিয়ামান্তাকস বলেন, “এখানে লোকে অনেক বেশি চায়। কারণ, ক্লাবের ট্রফির সংখ্যা অনেক বেশি। ওদের সব কিছু আছে, সে জন্যই। ওদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। গত বছর আমরা সুপার কাপ জিতেছিলাম। কিন্তু তার পরে আর কিছু জিতিনি। সে জন্যই প্রত্যাশা বেশি। আমার মনে হয়, এখানে লোকে খুব সহজেই ভাবনা বদলে ফেলতে পারে। একদিন তুমি অসাধারণ, পরের দিন তুমি খুবই খারাপ। কেরালায় ২-৩টে ম্যাচে খারাপ খেললেও তারা তোমাকে ভালবাসবে। ওরা ওদের দল ও খেলোয়াড়দের রক্ষা করে”।

তবে কলকাতায় যখন প্রথম পা রাখেন তিনি, সেই সময় সমর্থকেরা যে ভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তাঁকে, সেই অভ্যর্থনা এখনও মনে আছে দিমির। সেই রাতের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বলেন, “অনেক সমর্থক এসেছিল, শুনেছিলাম হাজারেরও বেশি সমর্থক ছিল ওখানে। আমি অন্য একটা গাড়িতে উঠি। কারণ, রাস্তায় আমরা অন্য কোনও সমস্যায় পড়ি, তা চাইছিলাম না। কয়েকজন তো গাড়ির মাথায় উঠে লাফাতে শুরু করে! অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল। সত্যিই কখনও ভাবিনি, এমন অভিজ্ঞতা কোনও দিন হবে। সমর্থকদের জন্য আমার নিজেকে ভগবান মনে হচ্ছিল।”

গোলের সংখ্যা বাড়াতে কী চান ইস্টবেঙ্গলের তারকা স্ট্রাইকার? তাঁর বক্তব্য, “আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই- আমাকে ওরা ঠিকমতো পাস দিক। এখন অন্য সব দলই আমাদের চিনে গেছে। ওরা জানে আমরা কী করে খেলি, আমরা কী করে আক্রমণ করি। এই অবস্থায় গোল করা মোটেই সোজা নয়। কিন্তু আমাকে যদি ঠিক জায়গায় বল দাও, আমি আছি, গোল করব”।

সামনেই এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের পরীক্ষা। যা নিয়ে দিয়ামান্তাকস এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মার্চে আমাদের দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আছে। এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে আমাদের এগোতে হলে আমাদের ওখানে ভাল খেলতে হবে। আইএসএল-ও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এখানে ভাল খেললে ওই প্রতিযোগিতায় ভাল ছন্দ নিয়ে যেতে পারব। এই লিগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ! কারণ, আমরা ওখানে শুধু ইস্টবেঙ্গলের নয়, ভারতেরও প্রতিনিধিত্ব করব। আমরা সফল হলে সব ভারতীয়রাই বোধহয় আমাদের নিয়ে গর্বিত হবে। ক্লাবের কাছেও এটা বিশাল এক মুহূর্ত হয়ে উঠবে। কারণ, আমরা এগোতে পারলে ফাইনালে ওঠারও সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যাবে”।

এ ছাড়াও এই সাক্ষাৎকারে আরও একাধিক বিষয়ে কথা বলেছেন দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস, যা দেখতে পাবেন আইএসএলের ইউটিউব চ্যানেলে মঙ্গলবারই প্রকাশিত হওয়া ‘ইন দ্য স্ট্যান্ডস’-এর সাম্প্রতিক এপিসোডে।

পুরো সাক্ষাৎকারটি দেখতে নীচে ক্লিক করুন।