হিরো আইএসএলের চলতি মরশুমে এক বনাম দুইয়ের লড়াইয়ে আধিপত্য বজায় রাখল শীর্ষস্থানীয় দল মুম্বই সিটি এফসি। প্রথম লেগের দ্বিতীয় সেরা এটিকে মোহনবাগানকে ১-০ গোলে হারিয়ে লিগ টেবলে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখল তারা। দুই স্প্যানিশ কোচের কৌশলের যুদ্ধে একমাত্র গোলটি করেন নাইজেরিয়া-জাত তারকা ফরোয়ার্ড বার্থোলোমিউ ওগবেচে। সোমবার ফতোরদা স্টেডিয়ামে ৬৯ মিনিটের মাথায় ফরাসি মিডফিল্ডার হুগো বুমৌসের পাস থেকে দর্শনীয় গোল করে দলকে জেতান তিনি। তবে এই গোলের এগারো মিনিট আগেই গঙ্গাপাড়ের ক্লাব এগিয়ে যেতে পারত এডু গার্সিয়ার গোলে। প্রায় ফাঁকা গোল পেয়েও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি।

এই জয়ের ফলে ১০ ম্যাচে ২৫ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা এটিকে মোহনবাগানের চেয়ে পাঁচ পয়েন্টের দূরত্ব তৈরি করে নিল তারা। তিন নম্বর দল হায়দরাবাদ এফসি-র থেকে দশ পয়েন্ট এগিয়ে আরব সাগরপাড়ের ক্লাব। চলতি হিরো আইএসএলের প্রথম লেগের শেষে সেরা চারের শেষ দল এফসি গোয়ারও অর্জিত পয়েন্ট ১৫। তবে গোলসংখ্যায় পিছিয়ে থাকায় তারা চার নম্বরে।

  • ১১ মিনিট: গোল লাইনের ঠিক সামনে থেকে গোল বাঁচান অরিন্দম ভট্টাচার্য। তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বল সামনেই থাকা মনবীরের গায়ে লেগে গোললাইনের বাইরে চলে যায়।
  • ৪৫ মিনিট: মুম্বই সিটি এফসি-র পাসিং নির্ভর ও দাপুটে ফুটবলের জেরে প্রথমার্ধে সে ভাবে কাউন্টার অ্যাটাকে উঠতেই পারেনি এটিকে মোহনবাগান।
  • ৫২ মিনিট: ৫২ মিনিটের মাথায় বিপক্ষের বক্সের ঠিক বাইরে থেকে ফ্রি কিকে সোজা গোলে শট নিয়েছিলেন এডু গার্সিয়া। কিন্তু ডানদিকে ডাইভ দিয়ে তা বাঁচিয়ে দেন মুম্বইয়ের গোলকিপার অমরিন্দর সিং।
  • ৫৮ মিনিট: মাঝমাঠ থেকে প্রণয়ের পাস ধরে দ্রুত দৌড়ে এডু গার্সিয়া বিপক্ষের রক্ষণের বুক চিরে দীর্ঘদেহী মুর্তাদা ফলকে ধোঁকা দিয়ে প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঠেলেন যা পোস্টে লেগে ফিরে আসে।
  • ৬৯ মিনিট: বক্সের মাথায় থাকা বুমৌস ফ্লিক করে বল দেন বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওগবেচেকে। তিনি ফার পোস্টের দিকে রাখা জোরালো শটে জালে বল জড়িয়ে দেন।
  • ৮৩ মিনিট: ফ্রি কিক থেকে এডুর গোলমুখী শট মুর্তাদা হেড করে ক্লিয়ার করার পরে ফিরতি বল বক্সের মধ্যে বাঁ দিকে পান ডেভিড। তাঁর কোনাকুনি শট ফের মুর্তাদার মাথায় লেগে বাইরে চলে যায়।

সোমবার দলে তিনটি পরিবর্তন করে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে নামে এটিকে মোহনবাগান। এ দিন স্কোয়াডেই ছিলেন কার্ল ম্যাকহিউ। হাভিয়ে হার্নান্ডেজ দলে ফেরায় সম্ভবত তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। এ ছাড়া গ্লেন মার্টিন্স ও মনবীর সিংকেও এ দিন রাখা হয়েছিল ৫-৪-১-এ সাজানো দলে। অন্য দিকে মুম্বই সিটি এফসি-কে ৪-২-৩-১-এ সাজান তাদের কোচ সের্খিও লোবেরা। একেবারে সামনে ওগবেচে। তাঁর পিছনে সাই গদার্ড, হিরো আইএসএলে ৫০তম ম্যাচ খেলা হুগো বুমৌস ও বিপিন সিং।

শুরুর দিকে নিজস্ব পরিচিত স্টাইলেই খেলা শুরু করে দু’পক্ষ। নিজেদের মধ্যে প্রচুর পাস খেলে বল পজেশন বাড়িয়ে ধীর গতিতে আক্রমণে উঠছিল মুম্বই সিটি এফসি। অন্যদিকে, রক্ষণে লোক বাড়িয়ে বিপক্ষকে নিজেদের এলাকায় টেনে এনে দ্রুত আক্রমণে ওঠার চেষ্টা শুরু করে সবুজ-মেরুন বাহিনী। তবে নিজেদের খেলা ধরে রাখার ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে ছিল মুম্বই। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে দু-তিনবার গোলের সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করে সাগপাড়ের ক্লাব।

মূলত বাঁ দিকের উইং দিয়ে আক্রমণ তৈরি করছিল তারা। বাঁ দিকে বিপিন সিং ও ডানদিকে বুমৌসের তৎপরতায় একাধিক সুযোগ তৈরি করে তারা। ১১ মিনিটের মাথায় গোল লাইনের ঠিক সামনে থেকে সাই গদার্ডের পা থেকে আসা শট আটকান অরিন্দম ভট্টাচার্য। তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বল সামনেই থাকা মনবীরের গায়ে লেগে গোললাইনের বাইরে চলে যায়। শুরুর দিকে এটিকে মোহনবাগান ডিফেন্সকে বেশ চাপেই রেখেছিল মুম্বই সিটি এফসি। প্রথমার্ধে সবুজ-মেরুন শিবির একটিও শট গোলে নিতে পারেনি। সেই সুযোগও তেমন তৈরি করতে পারেনি তারা।   

সবুজ-মেরুন জার্সিধারীদের পায়ে বেশিক্ষণ বল রাখতে দিচ্ছিলেন না হলুদ জার্সির ফুটবলাররা। মাঝমাঠেই আটকে দিচ্ছিলেন তাঁদের। রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসদের সে ভাবে উঠতেই দিচ্ছিলেন না বিপক্ষের ফুটবলাররা। ম্যাচের প্রথম আধ ঘণ্টায় মুম্বই সিটি এফসি-র পজেশন ছিল ৬৭ শতাংশ। প্রথামার্ধে যখন পৌনে চারশো পাস খেলা হয়ে গিয়েছিল তাদের, তখন এটিকে মোহনবাগানের পাসের সংখ্যা দেড়শোও পেরোয়নি।

এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় গঙ্গাপাড়ের দলের ওপর কতটা আধিপত্য বিস্তার করে তারা। একবার বল তাদের দখলে চলে গেলে, বলকে দখলমুক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল এটিকে মোহনবাগানের পক্ষে। ফলে তাদের ঘন ঘন কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিক বৈঠকে যে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন সবুজ মেরুন কোচ হাবাস, অর্থাৎ মুম্বইয়ের আক্রমণের সঙ্গে এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণের লড়াই, সেটাই এই ম্যাচের প্রথমার্ধে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়।  

দ্বিতীয়ার্ধে গ্লেন মার্টিন্সের জায়গায় প্রণয় হালদারকে ও মনবীরের জায়গায় প্রবীর দাসকে নামান সবুজ-মেরুন কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল আক্রমণের ধার বাড়ানো। ৫২ মিনিটের মাথায় বিপক্ষের বক্সের ঠিক বাইরে থেকে ফ্রি কিকে সোজা গোলে শট নিয়েছিলেন এডু গার্সিয়া। কিন্তু ডানদিকে ঝাঁপিয়ে তা বাঁচিয়ে দেন মুম্বইয়ের গোলকিপার অমরিন্দর সিং।

বিপক্ষকে কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগ দিলেই যে তাদের বিপদ হতে পারে, মুম্বই তা বুঝে নেয় ৫৮ মিনিটের মাথায়, যখন মাঝমাঠ থেকে প্রণয়ের পাস ধরে পেনাল্টি বক্সের দিকে দ্রুত দৌড়ে যান এডু গার্সিয়া। বিপক্ষের রক্ষণের বুক চিরে দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফলকে ধোঁকা দিয়ে প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দেন তিনি। কিন্তু পোস্টের ভিতরে লেগে বল ফিরে আসে।

এই একটা কাউন্টারেই নড়েচড়ে বসে মুম্বই সিটি এফসি। প্রথমার্ধে যে পাসিংসর্বস্ব ফুটবল খেলছিল তারা, সেই জায়গা থেকে সরে এসে উইং দিয়ে আক্রমণের প্রবণতা বাড়ে তাদের এবং বহু প্রতিক্ষার সেই মুহূর্তটি এসে যায় ৬৯তম মিনিটে। নিজেদের এলাকায় হার্নান সান্তানা এডু গার্সিয়ার পা থেকে বল কেড়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়ে দৌড় শুরু করেন ও বিপক্ষের বক্সের মাথায় থাকা বুমৌসকে পাস দেন। তিনি ফ্লিক করে বল দেন বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওগবেচেকে। তিনি ডান পোস্টের দিকে রাখা জোরালো শটে জালে বল জড়িয়ে দেন।

এই গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরেই মুম্বইয়ের কোচ সের্খিও লোবেরা ছুটি দেন ওগবেচেকে, অ্যাডাম লে ফন্দ্রেকে নামানোর জন্য। মাঠে নামার দু’মিনিটের মধ্যেই লে ফন্দ্রে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। ডানদিকে বুমৌসের সঙ্গে ওয়াল খেলে বক্সের ডানদিক দিয়ে ঢুকে গোলে শট নেন, যা অরিন্দম তাঁর চেনা দক্ষতায় রুখে দেন।

৮০ মিনিটের মাথায় চোট সারিয়ে মাঠে নামা হাভিয়ে হার্নান্ডেজের জায়গায় নামেন ব্র্যাড ইনম্যান। কাউন্টার অ্যাটাক চালিয়ে যাচ্ছিল সবুজ-মেরুন বাহিনী। ৮৩ মিনিটের মাথায় আরও একটা দুর্দান্ত সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন ডেভিড উইলিয়ামস। ফ্রি কিক থেকে এডুর গোলমুখী শট মুর্তাদা হেড করে ক্লিয়ার করার পরে সেই ফিরতি বল বক্সের মধ্যে বাঁ দিকে পেয়ে গিয়েছিলেন ডেভিড। তিনি কোনাকুনি শট নেন গোলে। এ বারও মুর্তাদার মাথায় লেগে তা বাইরে চলে যায়।

শেষ পাঁচ মিনিটে বুমৌস ও বিপিনকে তুলে নেন লোবেরা। পাঁচ মিনিট অতিরিক্ত সময়ও দেওয়া হয় দ্বিতীয়ার্ধে। স্টপেজ টাইমে এডুর কর্নারে হেড করে গোলের শেষ চেষ্টা করেন তিরি। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।       

এটিকে মোহনবাগান দল: অরিন্দম ভট্টাচার্য (গোল), প্রীতম কোটাল, সন্দেশ ঝিঙ্গন, তিরি, শুভাশিস বসু, গ্লেন মার্টিন্স (প্রণয় হালদার), এডু গার্সিয়া, হাভিয়ে হার্নান্ডেজ (ব্র্যাড ইনম্যান), মনবীর সিং(প্রবীর দাস), ডেভিড উইলিয়ামস, রয় কৃষ্ণা

পরিসংখ্যানে

বল পজেশন: এটিকে মোহনবাগান ৩৯% - মুম্বই সিটি এফসি ৬১%

সফল পাস: ১৬৪/২৬৬ - ৪১৯/৫৩৯

গোলে শট: ১-৭

ফাউল: ১১-১১

ইন্টারসেপশন: ১৪-১৬

কর্নার: ২-৭

হলুদ কার্ড: ৩-২

ম্যাচের সেরা: বার্থোলোমিউ ওগবেচে