সেমিফাইনালে শক্তিশালী মোহনবাগানকে হারানোর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ওডিশা
যারা এই ম্যাচে জিততে পারবে, তারাই আগামী রবিবার দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে এগিয়ে থেকে মাঠে নামবে। তাই শুরু থেকেই যদি দুই দলের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘনঘটা দেখা যায়, অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ইন্ডিয়ান সুপার লিগে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের যে ক’টা কাঁটা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ওডিশা এফসি এবং এ মরশুমের প্রথম সেমিফাইনালে তাদেরই মুখোমুখি হতে চলেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে মুখোমুখি হবে এ বারের লিগের সেরা আক্রমণাত্মক দলগুলির অন্যতম দুই বাহিনী। লিগ পর্বে যাদের সমর্থকেরা প্রচুর গোল দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
মোহনবাগান ছিল গোলের হাফ সেঞ্চুরি থেকে দুই ধাপ দূরে, যা হয়তো প্লে অফেই করে ফেলবে তারা। অন্য দিকে ওডিশা এফসি-ও নয় নয় করে ৩৯টি গোল করেছে। অথচ এই দুই দলের শেষ সাক্ষাৎ ছিল গোলশূন্য! ইন্ডিয়ান সুপার লিগ এমনই, অদ্ভূত, অনন্য। তার আগের মুখোমুখিতে চারটি গোল হলেও তা সমান ভাগাভাগি করে নিয়ে ম্যাচ ড্র রেখে মাঠ ছাড়ে দুই দল।
আসলে দুই দল যখনই আইএসএলের আসরে মুখোমুখি হয়েছে, তার বেশিরভাগ ম্যাচই ড্র হয়েছে। আর যে ক’বার ম্যাচের ফয়সালা হয়েছে, তার প্রতিবারই জয়ের হাসি হেসেছে কলকাতার সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। তাই মঙ্গলবার বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘরের মাঠে নামবে কলিঙ্গবাহিনী, যে মাঠে গত ১২টি ম্যাচে হারেনি তারা।
লড়াই সমানে সমানে
লিগ পর্বের শেষ দুটি ম্যাচে হারের পর প্লে অফের প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে কেরালা ব্লাস্টার্সকে ২-১-এ হারিয়ে সেমিফাইনালের দরজা খুলে ফেলে ওডিশা এফসি। গত দশটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র চারটিতে জিতেছে তারা। সে দিক থেকে মোহনবাগান এসজি বেশ কিছুটা এগিয়ে এবং দাপটের সঙ্গে খেলে যাচ্ছে। শেষ দশটি ম্যাচের মধ্যে আটটিতেই জিতেছে তারা। হেরেছে একটিতে ও ড্রয়ের সংখ্যাও এক। যে ম্যাচটি তারা ড্র করে, সেটি ছিল এই ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধেই। শেষ পাঁচটি ম্যাচের চারটিতেই জিতেছেন লিস্টন কোলাসোরা। এই পাঁচ ম্যাচে ১৩ গোল দিয়ে সাতটি গোল খেয়েছে তারা। দু’টি ম্যাচে চারটি করে গোল করেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটসরা। অর্থাৎ যদি দাপটের তুলনা করা যায়, তা হলে মোহনবাগানকেই এগিয়ে রাখতে হবে।
মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরে দেখা যাবে দুই দলের দুই স্ট্রাইকারজুটির প্রতিযোগিতা। ওডিশার দিয়েগো মরিসিও-রয় কৃষ্ণা জুটি বনাম মোহনবাগানের দিমিত্রিয়স পেট্রাটস-জেসন কামিংস জুটি। এই দুই জুটিকে ঠেকিয়ে রাখাই হতে চলেছে দুই দলের রক্ষণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, যা দক্ষতা বা শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে যতটা না করা যাবে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে কৌশল ও বুদ্ধির।
যেমনটা দেখা গিয়েছিল তাদের মধ্যে দ্বিতীয় লিগ ম্যাচে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই কলিঙ্গ স্টেডিয়ামেই যে ভাবে একাধিক গোলের সুযোগ হাতছাড়া করে গোলশূন্য ড্র করে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের দল, যে ভাবে তারা বিপক্ষকে ফাইনাল থার্ডে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখায় বেশি মনোনিবেশ করে, তাতে দর্শনীয় ফুটবল হয়নি। অথচ লিগের সেরা দুই দলের কাছ থেকে তুমুল লড়াই আশা করেছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা কাজে লাগাতে পারেনি মোহনবাগান। ওডিশাকেও কোনও বাড়তি ঝুঁকি নিতে দেখা যায়নি সে দিন।
তবে প্রথম লেগের ম্যাচে টানটান উত্তেজনায় ঠাসা প্রায় একশো মিনিটে ওডিশা এফসি-র মুখের গ্রাস কার্যত ছিনিয়ে নিয়ে ২-২ ড্র করে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। সে দিন প্রথমার্ধে দুই গোলে এগিয়ে থাকা ওডিশা তিন পয়েন্ট হাতছাড়া করে আরমান্দো সাদিকুর জোড়া গোলে। ওডিশার শরীরী আক্রমণের বাধা পেরিয়ে যে শেষ পর্যন্ত এক পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছিল চোট-আঘাতে জর্জরিত মোহনবাগান, সে জন্য তাদের প্রশংসাই প্রাপ্য।
মঙ্গলবার প্রথম সেমিফাইনালে সে রকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, দুই দলেরই জয় চাই। যারা এই ম্যাচে জিততে পারবে, তারাই আগামী রবিবার দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে এগিয়ে থেকে মাঠে নামবে। তাই শুরু থেকেই যদি দুই দলের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘনঘটা দেখা যায়, অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ধারাবাহিকতার সমস্যা ওডিশার
এ মরশুমের আগে মুর্তাদা ফল, আহমেদ জাহু, রয় কৃষ্ণাদের মতো তারকাদের সই করিয়ে এক দুর্দান্ত দল তৈরি করেন আইএসএলে সেরা কোচেদের অন্যতম সের্খিও লোবেরা। কিন্তু তাদের মরশুমের শুরুটা তেমন ভাল হয়নি। চার ম্যাচে চার পয়েন্ট পায় তারা। কিন্তু দলটাকে গুছিয়ে নিয়ে, দলের ফুটবলারদের থেকে সেরাটুকু বের করে নিয়ে দলকে ক্রমশ ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেন লোবেরা। ফলে পরের ১৩টি ম্যাচে টানা অপরাজিত থাকে তারা।
যে এএফসি কাপে তারা প্রথম দুটি ম্যাচে হারে, সেই এএফসি কাপে তার পরের চারটি ম্যাচে টানা জেতে ওডিশা। এমনকী মোহনবাগানকে হারিয়েই তারা এএফসি কাপের পরবর্তী রাউন্ডে পৌঁছয়। সুপার কাপের ফাইনালেও ওঠে তারা। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে যায়। চলতি আইএসএল মরশুমে লোবেরার দলই সবার আগে প্লে অফে জায়গা পাকা করে। কিন্তু চেন্নাইন এফসি-র কাছে হার ও বেঙ্গালুরু এফসি-র সঙ্গে ড্র তাদের লিগ শিল্ড জয়ের স্বপ্ন চুরমার করে দেয়। এই ধারাবাহিকতার অভাবই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
সেট পিসে যে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী, তা বারবার প্রমাণ করেছেন আহমেদ জাহু, মুর্তাদা ফলরা। দুজনেই সেটপিসে বিশেষজ্ঞ। দিয়েগো মরিসিও, রয় কৃষ্ণা, কার্লোস দেলগাদোরা তাদের সবরকম ভাবে সাহায্য করায় সেট পিসে বহুবার সফল হয়েছে কলিঙ্গবাহিনী। মরিসিও ও কৃষ্ণার গোলের মধ্যে থাকাটাও একটা বড় ইতিবাচক দিক।
মোহনবাগানের প্রাক্তনী কৃষ্ণা এ পর্যন্ত এক ডজন গোল করেছেন। মরিসিও করেছেন ১১ গোল। দু’জনে মিলে দলের ২৭টি গোলে অবদান রেখেছেন। মঙ্গলবারের ম্যাচে এঁরাই নজরে থাকবেন।
আক্রমণ-রক্ষণই ভরসা বাগানের
যেমন নজরে থাকবেন মোহনবাগানের দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জেসন কামিংস জুটি। এঁরা দু’জনে মিলে ২৮টি গোলে অবদান রেখেছেন। দুই অস্ট্রেলীয়ই এখন দলের আক্রমণে দুই প্রধান অস্ত্র। পেট্রাটস দশটি গোল করেছেন ও ছ’টিতে অ্যাসিস্ট করেছেন। কামিংসও দশটি গোল করেছেন ও দু’টি করিয়েছেন। এই তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছেন আলবানিয়ান আরমান্দো সাদিকু, যিনি আটটি গোল করেছেন ও একটিতে অ্যাসিস্ট করেছন। বাকিরা তাদের মতো এত গোল করতে না পারলেও নিয়মিত গোলে সাহায্য করছেন। অ্যাসিস্টে সবচেয়ে মনবীর সিং (৭), জনি কাউকো (৪), লিস্টন কোলাসো (৪), সহাল আব্দুল সামাদ (৪)। গোলের করার ব্যাপারেও মনবীর (৩), লিস্টন (৪), দীপক টাঙরি (২), অনিরুদ্ধ থাপারা (২) তৎপর।
চলতি লিগে মোহনবাগান যথেষ্ট ধারাবাহিক। শুরুতে তারা টানা পাঁচটি জয় পাওয়ার পরে ওডিশার কাছেই আটকে যায়। এর পরে নর্থইস্টের বিরুদ্ধে জিতলেও টানা চারটি ম্যাচে জয়হীন থাকে। তবে বর্তমান কোচ আন্তোনিও হাবাস দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত থাকে তারা। এর মধ্যে ছ’টিতে জেতে ও একটিতে ড্র করে ও সেটি সেই ওডিশার বিরুদ্ধেই। কিন্তু তার পরে চেন্নাইনের বিরুদ্ধে হঠাৎ ধাক্কা খায় তারা, যা তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয় এবং ফের টানা তিন ম্যাচে জয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রথমবার লিগ সেরার খেতাব জেতে। এ বার আগামী দুই ম্যাচে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে গতবারের মতো ফের ফাইনালে উঠবে তারা। তার পরে কাপজয়ের লড়াই।
আক্রমণের মতো রক্ষণেও যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্স তাদের। এ পর্যন্ত আটটি ম্যাচে ক্লিন শিট রাখতে পেরেছে তারা। গত তিনটি ম্যাচের মধ্যে দুটিতেই ক্লিন শিট বজায় রেখেছে মোহনবাগান। এই তিন ম্যাচে সাত গোল দিয়ে মাত্র এক গোল খেয়েছে তারা। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে সফল হতে পারে তারা। মুম্বই সিটি এফসি-র মতো ধারাবাহিক ও শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধেও দাপুটে জয় পান পেট্রাটসরা। এই জয়ই তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। রক্ষণে হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস ও আনোয়ার আলি তিন স্তম্ভ। তবে গত ম্যাচে লাল কার্ড দেখায় রক্ষণে ব্রেন্ডান হ্যামিল খেলতে পারবেন না। তবে মোহনবাগান শিবিরে সবচেয়ে ভাল খবর তারকা উইঙ্গার সহাল আব্দুল সামাদের সুস্থ হয়ে ওঠা, যা জানিয়ে দিয়েছেন খোদ কোচ হাবাস।
দ্বৈরথের পরিসংখ্যান
ঘরের মাঠে গত ১২টি ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে ওডিশা এফসি। এর মধ্যে ন’টি জয় ও তিনটি ড্র রয়েছে। ওডিশা এফসি আইএসএলে এখন পর্যন্ত কোনও ম্যাচে জিততে না পারলেও তাদের বর্তমান কোচ সের্খিও লোবেরার দলের বিরুদ্ধে মোহনবাগান এসজি এখনও কোনও ম্যাচ জিততে পারেনি। সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনটি ম্যাচে তিনি জিতেছেন ও দুটিতে ড্র করেছেন। কলকাতার সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিরুদ্ধে আটটি ম্যাচে খেলেছেন ওডিশার সেরা স্ট্রাইকার দিয়েগো মরিসিও। কিন্তু একটিতেও গোল করতে পারেননি। অবশ্য গত তিনটি ম্যাচেই গোল পেয়েছেন তিনি।
গত চারটি অ্যাওয়ে ম্যাচেই জয় পেয়েছে মোহনবাগান এসজি। শেষ দুই ম্যাচে কোনও গোল খায়নি তারা। যা ক্লাবের আইএসএল ইতিহাসে সেরা। এ মরশুমে অ্যাওয়ে ম্যাচে তারা দু’বার পয়েন্ট খুইয়েছে, মুম্বইয়ে হেরে ও ভুবনেশ্বরে ড্র করে। আইএসএল প্লে-অফে তারা শেষ পাঁচটি ম্যাচে দু’টি জিতেছে ও তিনটি ড্র করেছে। এর মধ্যে চারটি ম্যাচেই ক্লিন শিট রাখে তারা। এই মরশুমে এ পর্যন্ত মোট ৫৭.০৫% এরিয়াল ডুয়াল জিতেছে মোহনবাগান, যাতে তারা অন্যান্য সব দলের চেয়ে এগিয়ে। শেষ সাতটি ম্যাচের প্রতিটিতেই দলের গোলে অবদান রেখেছেন তাদের সেরা স্ট্রাইকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এই সাতটি ম্যাচে চারটি গোল করেছেন ও পাঁচটিতে অ্যাসিস্ট করেছেন দিমি।
দ্বৈরথের ইতিহাস
ইন্ডিয়ান সুপার লিগের পরিসংখ্যান এগিয়ে রেখেছে মোহনবাগান-কেই। চার মরশুমে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট ন’বার। তার মধ্যে চারবার জিতেছে কলকাতার দল। বাকি পাঁচটিতে ড্র হয়। অর্থাৎ, ওডিশা এফসি এখন অবধি আইএসএলে মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি। ২০২০-২১ মরশুমে দু’বারই মোহনবাগান জেতে যথাক্রমে ১-০ ও ৪-১-এ। ২০২১-২২ মরশুমে দু’বারই ড্র হয়। প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য ও দ্বিতীয় ম্যাচে ১-১ ফল হয়। ২০২২-২৩-এর প্রথম মুখোমুখিও গোলশূন্য ছিল। দ্বিতীয় লেগে মোহনবাগান জেতে ২-০-য় এবং প্লে অফেও তারা ওডিশা এফসি-কে একই ফলে হারায়। চলতি মরশুমের লিগ পর্বে ফল হয় ২-২ ও ০-০। দুই দলের মুখোমুখিতে এ পর্যন্ত ১৬টি গোল হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি দিয়েছে মোহনবাগান ও চারটি দিয়েছে ওডিশা এফসি।
ম্যাচ- ওডিশা এফসি বনাম মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট
সেমিফাইনাল ১ (প্রথম লেগ)
ভেনু- কলিঙ্গ স্টেডিয়াম, ভুবনেশ্বর
সময়- ২২ এপ্রিল, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.৩০
সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং টিভি চ্যানেল: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ













