যে লক্ষ্য নিয়ে এ মরশুমের আগে দুর্দান্ত একটি দল গড়ার চেষ্টা করেছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, সেই লক্ষ্যপূরণ হল না তাদের। এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সোমবার ওডিশা এফসি-র কাছে ২-৫-এ হেরে এশীয় স্তরের অন্যতম সেরা ক্লাব টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হল তাদের। 

গতবার ফাইনালের মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে আসার পরে এ মরশুমে সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল এএফসি কাপ। তাই এ বছর ক্লাবের সঙ্গে নতুন চুক্তি করার পরই স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো বলে দেন, “আইএসএলে এ বারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য থাকবে এএফসি কাপে ভাল ফল করা”।

সেই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যেই এ মরশুমের আগে দলবদলে বেশ কয়েকটি চমক দেয় মোহনবাগান এসজি। কাতার বিশ্বকাপে নামা অস্ট্রেলীয় সেন্টার ফরোয়ার্ড জেসন কামিংস ও আলবানিয়ার জাতীয় দলের হয়ে ইউরো ২০১৬-য় খেলা সেন্টার ফরোয়ার্ড আরমান্দো সাদিকু যোগ দেন তাদের শিবিরে। গতবছর দলে যোগ দেওয়া অস্ট্রেলিয়ার তারকা অ্যাটাকার দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও ফরাসি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস তো আগে থেকেই ছিলেন। 

তাই আক্রমণে নিয়ে খুব একটা চিন্তার কিছু ছিল না মোহনবাগানের। গতবার যেমন দলে কোনও বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকার ছিল না, এ বার কিন্তু ছবিটা পুরো অন্যরকম ছিল। এমনকী রক্ষণও বেশ আঁটোসাঁটো করে সাজিয়েছিল তারা। গত মরশুমে দলে যোগ দেওয়া ব্রেন্ডান হ্যামিল, আশিস রাই ও পুরনো সঙ্গী শুভাশিস বোস তো ছিলেনই। তাঁদের সঙ্গে এ বার যোগ দেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বিরুদ্ধে খেলা স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তে। এ ছাড়াও এ বছর এফসি গোয়া থেকে।  সবুজ-মেরুন শিবিরে যোগ দেন ভারতীয় দলের নিয়মিত ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি। যিনি মরশুমের শুরু থেকেই ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন।

আনোয়ার ছাড়াও ভারতীয় দলের আরও কয়েকজন নিয়মিত তারকাকেও এ বার সই করায় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ভারতীয় দলের আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার অনিরুদ্ধ থাপা আসেন দলে। যোগ দেন কেরালার আর এক নির্ভরযোগ্য তারকা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার সহাল আব্দুল সামাদও। তবে মরশুমের শুরুতেই দুঃসংবাদ আসে তাদের শিবিরে, আশিক কুরুনিয়ান ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পেয়ে কার্যত সারা মরশুমের জন্যই ছিটকে গিয়েছেন।

এখান থেকেই শুরু হয় মোহনবাগানের দুঃসময়। আশিকের পর চোট পেয়ে যান আনোয়ারও। তিনিও কবে মাঠে ফিরবেন, এখনও কেউ নিশ্চিত নন। যিনি ক্রমশ ফর্মে ফিরছিলেন, সেই মনবীর সিংও চোট পেয়ে ছিটকে যান। অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার পেট্রাটসও চোটের তালিকায় নাম লেখান সোমবারের ম্যাচের আগে। সব মিলিয়ে প্রথম দলের প্রায় চারজন ফুটবলারকে যদি না পাওয়া যায়, তা হলে এএফসি কাপের মতো টুর্নামেন্টে ভাল ফল করা কঠিন হয়ে ওঠে। 

শুধু যে চোট-আঘাতে জর্জরিত মোহনবাগান, তা নয়। কয়েকজন নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়ের অফ ফর্মও বেশ চিন্তায় ফেলেছে ফেরান্দোকে। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকুরা দলকে সেইভাবে সাহায্য করতে পারছেন না, যে ভাবে তাদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিল সবুজ-মেরুন। মনবীর ফর্মে ফিরতে শুরু করলেও লিস্টন কোলাসোর ফারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা নেই। সহাল সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তিনি কোনও কোনও ম্যাচে জ্বলে উঠলেও বেশির ভাগ ম্যাচেই নিষ্প্রভ থাকছেন।

আনোয়ার আলির অনুপস্থিতিতে দলের রক্ষণও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তেরা সেই ফর্মে নেই, যে ফর্মে তাদের দেখার আশায় ছিলেন সমর্থকেরা। ফলে দলকে গোলও হজম করতে হচ্ছে অনেক। এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে তারা পাঁচ ম্যাচে ১১টি গোল দিলেও খেয়েছে ১০টি। চলতি আইএসএলে অবশ্য তাদের গোলপার্থক্য এই টুর্নামেন্টের চেয়ে ভাল। চার ম্যাচে দশটি গোল করে খেয়েছে চারটি। এএফসি কাপে আর একটি ম্যাচ বাকি থাকলেও তা নিয়মরক্ষার্থে খেলতে হবে তাদের। তাই সবুজ-মেরুন কোচের ফোকাস এখন আইএসএলের দিকেই। 

সোমবার রাতে ওডিশা এফসি-র কাছে হারার পরই এ কথা জানিয়ে দেন হুয়ান ফেরান্দো। বলেন, “জীবন থেমে থাকে না। এখন আমাদের ফোকাস আইএসএলে। সামনেই (শনিবার) হায়দারাবাদের বিরুদ্ধে ম্যাচ। সুপার কাপও রয়েছে। সেগুলোতে ভাল ফল করে টেবলের শীর্ষে টিকে থাকার জন্য আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। এখনও অনেক পথ বাকি আছে”। 

এ বারের এএফসি কাপে অনেক আশা নিয়ে নামলেও বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের কাছে দু’টি ম্যাচে জিততে না পারাটাই মোহনবাগানের কাছে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বসুন্ধরার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ২-২ হওয়ার পর ফিরতি ম্যাচে বসুন্ধরা ২-১-এ জেতে। এই দুই ম্যাচের ব্যর্থতাই যে তাদের শেষ পর্যন্ত গ্রুপ থেকে ছিটকে দিল, তা স্বীকার করে নিয়ে ফেরান্দো বলেন, “বসুন্ধরার বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের ফলই খুব হতাশাজনক হয়েছে। ওদের বিরুদ্ধে আমরা হোম ম্যাচ খেললেও সেটা এই মাঠে হয়নি। সবাই জানে, একই দলের বিরুদ্ধে যদি একটা ম্যাচে হারি আর অন্য ম্যাচে ড্র করি, তা হলে সেই দলটা ওপরে ওঠার ভাল সুযোগ পেয়ে যায়”। তা-ই হয়েছে। আপাতত বসুন্ধরাই এই গ্রুপের শীর্ষে। শেষ ম্যাচে ওডিশা এফসি-র সঙ্গে তারা ম্যাচ ড্র রাখতে পারলেও পরের রাউন্ডে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ওডিশার সামনে বসুন্ধরাকে ছিটকে দিয়ে পরের রাউন্ডে ওঠারও সুযোগ আছে। সে জন্য তাদের ১১ ডিসেম্বর শেষ ম্যাচ জিততেই হবে। 

সোমবারও ওডিশার কাছে হারের জন্য বসুন্ধরা কিংসকেই পরোক্ষে দায়ী করেন মোহনবাগান কোচ। বলেন, “আজ আমরা ওয়ার্ম-আপ করার সময় মাজিয়া এক গোলে এগিয়ে ছিল। খেলা শুরুর আগে জানতে পারি বসুন্ধরা জিতে গিয়েছে, আমাদেরও জিততেই হবে। ফুটবলারদের মাথায় এটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রথমার্ধে ২৫ মিনিট পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট ভাল খেলেছি। কিন্তু ১-১ হয়ে যাওয়ার পর আমরা মিনিট দশেকের জন্য প্রায় উধাও হয়ে যাই। ওরা শেষ পাঁচ মিনিটে দুটো গোল করে ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আমরা ওদের চেয়ে ভাল খেলেছি। আমাদের পরিবর্ত খেলোয়াড়রা অনেক জায়গা তৈরি করেছে। যদি অন্তত ৩-৩ করতে পারতাম, তা হলেও চলত। তাই আমরা পুরোপুরি আক্রমণে মনোনিবেশ করেছিলাম। কারণ, তখন ম্যাচটা অন্তত ড্র করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমরা। তবে ওরা শেষের দিকে আক্রমণের জন্য প্রচুর জায়গা পেয়েছে”। 

আগামী মাসে সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে কঠিন পরীক্ষা। তাদের ২৫ দিনের ব্যবধানে সাতটি ম্যাচ খেলতে হবে, যার মধ্যে একটি এএফসি কাপের ম্যাচও রয়েছে। সেটির কোনও গুরুত্ব আর না থাকলেও আইএসএলের প্রতিটি ম্যাচের গুরুত্ব যথেষ্ট। শীর্ষে থাকা ছ’টি দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম (৪) ম্যাচ খেলেছে তারাই এবং তারাই লিগের একমাত্র দল, যারা এখন পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচে জিতেছে। কিন্তু এই রেকর্ড অক্ষত রাখতে গেলে তাদের পরপর কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে হবে। 

শনিবার হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচের পর তাদের সূচী এ রকম: ৬ ডিসেম্বর- বনাম ওডিশা এফসি (কলকাতা, রাত ৮টা); ১৫ ডিসেম্বর- বনাম নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি (গুয়াহাটি, রাত ৮টা); ২০ ডিসেম্বর- বনাম মুম্বই সিটি এফসি (মুম্বই, রাত ৮টা); ২৩ ডিসেম্বর- বনাম এফসি গোয়া (কলকাতা, রাত ৮টা); ২৭ ডিসেম্বর- বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি (কলকাতা, রাত ৮টা)। এর মাঝে ১১ ডিসেম্বর তাদের এএফসি কাপের শেষ ম্যাচ রয়েছে মলদ্বীপে, মাজিয়ার বিরুদ্ধে। আগামী মাসের এই ম্যাচগুলিতেই আন্দাজ পাওয়া যাবে এএফসি কাপে তাদের ব্যর্থতার প্রভাব আইএসএলেও পড়তে চলেছে কি না।