এই লেখাটি ইংরেজিতে পড়তে পারেন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ফুটবল মানে যেন মশলা ছাড়া খাবার! প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ফুটবলের হৃদস্পন্দন। ফুটবল মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই এনে দেয় উত্তেজনা ও বিনোদনের সেই মিলিত অনুভূতি, যা খেলা শেষ হওয়ার অনেক পরেও অটুট রাখে ফুটবলপ্রেমীদের বন্ধন।

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) এমন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্ম নিয়েছে, যেগুলির তীব্রতা ক্রমশ সেগুলি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে। দেশের সেরা এই লিগ এমন কিছু লড়াইয়ের জন্ম দিয়েছে, যেগুলির তারিখে সমর্থকেরা ক্যালেন্ডারে লাল দাগ দিয়ে রাখে এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কবে আসবে সেই দিন।

অবশ্য সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্মই যে আইএসএলে হয়েছে, এ কথা বলাটা ঠিক হবে না। কিছু লড়াইয়ের জন্ম হয়েছে সুদূর অতীতে, যা নিয়ে উন্মাদনা দেখা গিয়েছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু দেখা গিয়েছে ফুটবলের চিরশত্রুদের সেই ‘ডুয়াল’-এর তাপমাত্রা আইএসএলের আসরে এতটাই বেড়েছে, যা অতীতে খুব কমবারই টের পাওয়া গিয়েছে।

ইতিমধ্যেই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলি ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। কিছু এসেছে যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে, তেমনই কিছু জন্ম নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। আবার কিছু দল একে অপরের সাফল্য কোনও মতেই সহ্য করতে পারেনি। সে জন্যই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা।

এই প্রতিবেদনে তেমনই পাঁচটি সর্বাধিক চর্চিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা ইন্ডিয়ান সুপার লিগের জনপ্রিয়তাও বাড়িয়েছে বহুগুন।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এবংইস্টবেঙ্গল এফসির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও তীব্র এক ফুটবল দ্বৈরথ, যার সূচনা হয় ১৯২১ সালে। এই দু’টি ক্লাব শুধু ভারতীয় ফুটবলের সেরা দলগুলির অন্যতম নয়, বরং এ দেশের ফুটবলের পরিচয়েরও বাহক তারা। ঐতিহ্যের দিক থেকে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট চিরকালই পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় ‘ঘটি’ সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে এসেছে। অন্যদিকে, ইস্টবেঙ্গল এফসির সমর্থকদের শিকড় মূলত ছিল পরাধীন ভারতের পূর্ব বাংলায়। ইতিহাস বলে, দেশভাগের সময় সেখান থেকেই পশ্চিমবঙ্গে এসে এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কয়েকজন ফুটবলপ্রেমী মানুষ। এদেশীয়দের ‘ঘটি’-র মতো তাদের সাধারণত ‘বাঙাল’ বলে ডাকা হয় এবং ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সেই প্রতিষ্ঠাতাদের আজও যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

২০২০-তে আইএসএলে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এবং ইস্টবেঙ্গল এফসির আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার বিখ্যাত ডার্বি পায় এক নতুন মঞ্চ, দেশের ফুটবলের সেরা আসর। কলকাতা ডার্বিতে সল্টলেক স্টেডিয়াম (বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন) যেন ৬০ হাজারেরও বেশি দর্শকের উত্তেজনার উত্তাপে জ্বলে ওঠা এক ‘ফার্নেস’-এ পরিণত হয়। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকেরা একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, আতশবাজির রোশনাই দেখা যায় আর বিশাল বিশাল ‘টিফো’ দেখা যায় গ্যালারিজুড়ে। কারণ, কলকাতা ডার্বি কোনও সাধারণ লিগ ম্যাচ নয়, এ আসলে বাংলার অর্ধেক অংশের গৌরবের লড়াই।

দুই দলের ফুটবলারদের কাছে ডার্বিজয় মানে যেন কোনও ট্রফি জেতার সমান গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থকেরা এই যুদ্ধ হারার কথা ভাবতেই পারে না। আর দুই পক্ষের ফুটবলার, কোচেরা বদলালেও এই সত্যিটা সব সময় একই থাকে— ভারতীয় ফুটবলে কলকাতা ডার্বি ‘একমেবদ্বিতীয়ম’।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স

এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়তো কলকাতা ডার্বির মতো ঐতিহাসিক নয়, তবে দুই রাজ্যের ফুটবলপ্রেমীদের মনে এই দ্বৈরথ এক আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাতের কারণ সহজেই বোঝা যায়।কেরালা ব্লাস্টার্স এফসির আবেগপ্রবণ সমর্থকেরা সল্টলেক স্টেডিয়াম ভরিয়ে তুলতে ভালবাসেন। এমনকী, সে জন্য কোচি, ত্রিবান্দ্রম, আলেপ্পি, ত্রিশূড় থেকে বহু দূর পাড়ি দিতেও তাদের আপত্তি নেই। তাদের তৈরি হলুদ সাগর প্রায়ই সবুজ-মেরুন সমর্থকদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, যা তৈরি করে দেয় এক অনন্য পরিবেশ। একই দৃশ্য দেখা যায় যখন বাগান সমর্থকেরা উজান বয়ে কোচিতে গিয়ে হাজির হয় তাদের প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটাতে।

এই দুই দলের মাঠের লড়াইগুলিও ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। যদিও বেশিরভাগ সময়ই এগিয়ে থেকেছে মোহনবাগান, তবু কেরালা ব্লাস্টার্স সমানতালে লড়ে গিয়েছে। হলুদ সেনাদের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়ের একটি এসেছিল ২০২৩-২৪ মরশুমে, যখন তারা কলকাতায় মেরিনারদের হারাতে সক্ষম হয়েছিল।

অনেক দিক থেকেই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারতীয় ফুটবলে পুরনো বনাম নতুনদের লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ঐতিহ্যের প্রতিফলন। কেরালা ব্লাস্টার্সের সম্বল আবোগোন্মাদ সমর্থকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী। তারা একসঙ্গে প্রতিটি লড়াইকে করে তোলে অবিস্মরণীয়।

মুম্বই সিটি এফসি বনাম এফসি গোয়া

আইএসএলে খুব কম প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, যেগুলি মাঠের বাইরেও এক অন্য গল্প শোনাতে পারে। তাদের অন্যতমএফসি গোয়া বনামমুম্বই সিটি এফসির দ্বৈরথ। একদিকে এফসি গোয়া, যারা এক ফুটবলপাগল রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে ফুটবল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। অন্যদিকে, মুম্বই সিটি এফসি, যারা দু’বার শিল্ড এবং দু’বার আইএসএল কাপ জিতে নিজেদের অনেক উচ্চস্তরে তুলে নিয়ে এসেছে।

আরব সাগর পাড়ের দুই ক্লাবের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজ বপন হয়েছিল এফসি গোয়া এবং মুম্বই সিটি এফসি যখন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্লে-অফ ম্যাচে মুখোমুখি হয়। সেখানেই জন্ম নেয় দুই ক্লাবের সম্পর্কের নাটকীয়তা। ওয়েস্টার্ন ডার্বিতে বাড়তি রং লাগে, যখন এফসি গোয়ার প্রাক্তন প্রধান কোচ সের্খিও লোবেরা দলবদল করে মুম্বই সিটি এফসিতে যোগ দেন এবং সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর প্রাক্তন দলের কয়েকজন তারকাকেও। সেই ঘটনা গোয়ার ক্লাবের সমর্থকদের বেশ বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল। সেই মরশুমেই গোয়াকে পেনাল্টিতে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে ওঠে লোবেরার মুম্বই সিটি এবং পরে সেরার শিরোপাও জিতে নেয়।

এই দুই দলের দ্বৈরথে বরাবরই গোলের বন্যা বয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে অসাধারণ মানের কিছু গোল, নাটকীয় প্রত্যাবর্তন এবং মনে রাখার মতো অসংখ্য মুহূর্ত। যখন এই দুই দল মুখোমুখি হয়, তখন প্রায়ই যেন আকাশে-বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

চেন্নাইন এফসি বনাম বেঙ্গালুরু এফসি

একনজরেচেন্নাইন এফসি এবংবেঙ্গালুরু এফসির দ্বৈরথকে হয়তো অন্য লড়াইগুলোর মতো ঐতিহাসিক মনে নাও হতে পারে। তবে মেরিনা এরিনায় একটা সন্ধ্যা কাটালেই বোঝা যায়, কেন এই ম্যাচ এত গুরুত্বপূর্ণ। দুই শহরের দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার—কয়েক ঘণ্টার সড়কপথ। আর এই নৈকট্যই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। এ যেন দুই প্রতিবেশীর নিত্যদিনের মন কষাকষি।

ভারতীয় ফুটবলে বেঙ্গালুরু এফসির আধিপত্য অনেক দিন আগে থেকেই। ২০১৭-য় আইএসএলে যোগ দেওয়ার সময়ই বড় ক্লাবের মর্যাদা পেয়ে যায় তারা। অন্যদিকে, ২০১৫-য় আইএসএল কাপ জিতে দ্রুত নিজেদের উত্তরাধিকার গড়ে তোলে চেন্নাইন এফসি। দক্ষিণ ভারতে এক অন্যরকম দাপট তৈরি হয় তাদের।

এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা হয়েছিল ২০১৭-১৮ মরশুমে। শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে চেন্নাইন এফসি ব্লুজদের (বেঙ্গালুরু এফসি) হারায়। তবে চেন্নাইয়ে গিয়ে মধুর প্রতিশোধ নেয় বেঙ্গালুরু। সেই মরশুমের ফাইনালেও আবার মুখোমুখি হয় এই দুই দল। কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে পিছিয়ে থেকেও দুর্দান্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আইএসএল কাপ জেতে চেন্নাইন এফসি

বেঙ্গালুরুর ‘ওয়েস্ট ব্লক ব্লুজ’ এবং চেন্নাইয়িন এফসির বিখ্যাত সমর্থকগোষ্ঠী ‘সুপারমাচানস’ এই দক্ষিণী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও মশলাদার করে তুলেছে। এরা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে শুধুমাত্র ফুটবল হিসেবেই দেখেন না, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু মনে করে। আর নিরপেক্ষ ফুটবলভক্তদের কাছে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তায়। এই যুদ্ধে কখনওই আগে থেকে বোঝা যায় না, এর চিত্রনাট্য শেষ পর্যন্ত কোথায় এই লড়াইকে কোথায় নিয়ে যাবে।

কেরালা ব্লাস্টার্স বনাম বেঙ্গালুরু এফসি

এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে আছে সমর্থকদের ব্যক্তিগত আবেগ, যা এদের প্রতিটি লড়াইকে করে তোলে তীব্র। কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র সমর্থকদের আবেগ শুধু আইএসএলেই নয়, সারা এশিয়ায় বিখ্যাত। অপরদিকে, বেঙ্গালুরু এফসি ভারতের অন্যতম পেশাদার ক্লাব, যাদের সাফল্যের প্রমাণ তাদের ট্রফিতে ঠাসা ক্যাবিনেট। এই দুই দল যখন মুখোমুখি হয়, তখন মাঠে উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে।

দুই দল প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৭-য় কোচির জেএলএন স্টেডিয়ামে। সেই মরশুমেই বেঙ্গালুরু এফসি আইএসএলে যোগ দেয়। যদিও ব্লুজরা ৩-১ ব্যবধানে জিতেছিল, ম্যাচটি ছিল নাটকে ভরপুর। সংযুক্ত সময়েই তিন-তিনটি গোল হয়েছিল। সঙ্গে ছিল কড়া ট্যাকল, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ—যা চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

তবে আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় গ্যালারিতে—বিশেষ করে দুই সমর্থকগোষ্ঠী ‘মানজাপ্পাড়া’ ও ‘ওয়েস্ট ব্লক ব্লুজ’-এর মধ্যে। একে অপরের প্রতি তাদের কটাক্ষ, স্লোগান আর তর্ক-বিতর্কই এই দ্বৈরথকে আজও জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে।

আইএসএল প্লে-অফে শেষ বার দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল ২০২২-২৩ মরশুমে, যেখানে বেঙ্গালুরু এফসি একমাত্র গোলের ব্যবধানে কেরালা ব্লাস্টার্সকে পরাজিত করে। প্রতিবার যখন এই দুই দল মুখোমুখি হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে। এর রেশ পড়ে মাঠে লড়াইয়েও। ম্যাচ হয় তীব্র, অনিশ্চিত। অনেক সময় মরশুমে দুই দলের ভাগ্য নির্ধারকও হয়ে ওঠে তাদের লড়াই। নিরপেক্ষ ফুটবলভক্তদের জন্য এটিই আধুনিক আইএসএলের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদাহরণ।

এ ছাড়াও যে উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলির কথা না বললেই নয়: এফসি গোয়া বনাম চেন্নাইন এফসি, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম মুম্বই সিটি এফসি, ওডিশা এফসি বনাম মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, চেন্নাইন এফসি বনাম কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি।