এক দল তৃতীয়বার ইন্ডিয়ান সুপার লিগের প্লে অফ ফাইনালের সামনে, অন্য দল প্রথমবার ফাইনালে ওঠার স্বাদ পাওয়ার জন্য মরিয়া। রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে কাদের স্বপ্ন পূরণ হবে, তা তো বোঝা যাবে রাতে ম্যাচের পর। কিন্তু এই ম্যাচ দেখতে যে যুবভারতীর গ্যালারিতে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের ঢল নামবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঘরের মাঠে, নিজেদের সমর্থকেরা যখন তাদের প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটাবেন, তখন কি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে হারানো অত সোজা হবে ওডিশা এফসি-র পক্ষে?

আইএসএল ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে যে অসাধ্য সাধন করতেই হয়, তা খুব ভাল করেই জানেন ওডিশার দলের কোচ, ফুটবলাররা। রবিবার সন্ধ্যায় সেই অসাধ্য সাধনের পরীক্ষায় নামবেন রয় কৃষ্ণা, দিয়েগো মরিসিওরা। রয় কৃষ্ণার নামটা দেখে অনেক মোহনবাগানপ্রেমীদেরই চোখ আটকে যেতে পারে। একসময় তিনিই তো ছিলেন মোহনবাগান জনতার নয়ণমণি। একসময় তিনিই সবুজ-মেরুন সমর্থকদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি থাকাকালীন যা পারেনি মোহনবাগান, তিনি দল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তা পেরেছে। গত বছর নক আউট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। এ বছর লিগশিল্ড জিতে নিয়েছে।

অতীতে প্রিয়, এখন কাঁটা

এ বার জোড়া খেতাব জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সে মাঠে রয় কৃষ্ণাও থাকবেন, তবে বিপক্ষে। বরং বলা যায়, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র রূপে তিনি সবুজ-মেরুন শিবিরের সামনে দাঁড়াবেন এই ম্যাচে। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ওডিশার হয়ে জয়সূচক গোলটি এসেছিল এই ফিজিয়ান তারকার পা থেকেই। রবিবার সেই রয় কৃষ্ণাকে আটকে রাখাই হবে মোহনবাগান রক্ষণের অন্যতম প্রধান কাজ।

সে দিন যিনি রয়কে আটকাতে পারেননি, যাঁর সামনে দিয়েই গোল করে ওডিশাকে ফাইনালের দিকে এক পা বাড়িয়ে রাখতে সাহায্য করেন তিনি, সেই হেক্টর ইউস্তে কলকাতার সাংবাদমাধ্যমে বলেছেন, এই ম্যাচে রয়কে আর গোল করতে দেবেন না। গত ম্যাচে দলের রক্ষণ নিয়ে অভিযোগ ছিল কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের। সেই ম্যাচে ব্রেন্ডান হ্যামিল খেলতে না পারায় তাদের রক্ষণে অনেক ফাঁকা জায়গা ও গলদ দেখা যায়। এই ম্যাচে খেলবেন হ্যামিল। তাই এ বার রয় বা দিয়েগো মরিসিও, ওডিশার প্রধান দুই স্ট্রাইকারের কাজ খুবি কঠিন করে তুলবেন বলে দাবি ইউস্তের।

তবে এই ম্যাচে যেহেতু ড্র করলেই ফাইনালের দরজা খুলে ফেলতে পারবে ওডিশা, তাই নিজেদের গোল করার চেয়ে প্রতিপক্ষের গোল আটকানো বেশি জরুরি তাদের পক্ষে। সে জন্যই কৌশলী কোচ সের্খিও লোবেরা হয়তো অতিরক্ষণাত্মক ফুটবল খেলার পরামর্শ দিয়ে দলের খেলোয়াড়দের মাঠে নামাবেন। সেক্ষেত্রে রয়কে বেশিরভাগ সময় রক্ষণে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এমনিতেই গত ম্যাচে লাল কার্ড দেখায় দলের রক্ষণের অন্যতম ভরসা কার্লোস দেলগাদো এই ম্যাচে খেলতে পারবেন না। তাই রক্ষণে একটা বড় জায়গা ফাঁকা থাকবে। সেই জায়গায় আহমেদ জাহু ও রয় কৃষ্ণাকে দফায় দফায় পাহাড়া দিতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ঘরে-বাইরে বাড়তি চাপ

মোহনবাগানের এই ম্যাচে জয় চাইই-চাই। তাও আবার অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে। তা হলে অতিরিক্ত সময় বা টাই ব্রেকারে না গিয়েই ফাইনালে উঠে যাবে তারা। এক গোলে জিতলে অবশ্য খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে। কলকাতার এই দুঃসহ গরমে যা বোধহয় চাইবেন না কোনও দলের ফুটবলাররাই। ম্যাচটাকে নিশ্চয়ই ৯০ মিনিটেই ফয়সালা করে আসতে চাইবেন তাঁরা। তাই শুরু থেকেই নিশ্চয়ই আক্রমণাত্মক মেজাজে দেখা যাবে মোহনবাগানকে। হাবাসের হাতে যখন ভাল আক্রমণাত্মক ফুটবলার আছে, তখন এই কৌশল অবলম্বন করবেনই বা না কেন তিনি? সেটা অবশ্যই তিনি করতে চাইবেন ঘর সামলে। নিজেদের এলাকায় পাহাড় বজায় রেখে।

এই মাঠেই কয়েক মাস আগে এএফসি কাপের ম্যাচে ৫-২-এ মোহনবাগানকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়েছিল ওডিশা এফসি। রবিবার সেই হারের বদলা নেওয়ার সুযোগ তাদের সামনে। এই ম্যাচে হারিয়ে ওডিশাকে আইএসএল থেকে ছিটকে দিতে পারলে অনেক স্বস্তি পাবেন পেট্রাটসরা। গত ম্যাচে লাল কার্ড দেখায় খেলতে পারবেন না আরমান্দো সাদিকু। তাঁর জায়গায় প্রথম থেকেই নিশ্চয়ই নামবেন জেসন কামিংস। তাঁকে সামনে রেখে পেট্রাটস হয়তো একটু পিছন থেকে খেলবেন। তাই তাঁকে কড়া মার্কিংয়ে রাখা সহজ হবে না ওডিশার পক্ষে। কামিংস-পেট্রাটস জুটিকে সাহায্য করার জন্য তো মনবীর, কোলাসোরা আছেনই। তাঁরা যদি নিজেদের সেরা খেলা দেখাতে পারেন, তা হলে সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটতেই পারে।

লড়াইটা হয়তো হবে মূলত ওডিশার রক্ষণ ও মোহনবাগানের আক্রমণের মধ্যে। কিন্তু ওডিশার অ্যাওয়ে ম্যাচের পারফরম্যান্স তাদের বেশ পিছিয়ে রেখেছে। এ মরশুমে ১১টির মধ্যে মাত্র তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় পেয়েছে তারা। পাঁচটিতে হেরেছে। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে শেষবার তারা জিতেছিল ফেব্রুয়ারিতে, তাও লিগতালিকার একেবারে নীচে থাকা হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে। এ ছাড়া জামশেদপুর ও পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় পায় তারা। সেরা ছয়ে থাকা কোনও দলের বিরুদ্ধেই অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় পায়নি ওডিশা। রবিবার ভরা যুবভারতীতে সেরা ছন্দে থাকা মোহনবাগানের বিরুদ্ধে কি সেই দুর্বলতা কাটিয়ে বাজিমাত করতে পারবে তারা? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

দ্বৈরথের পরিসংখ্যান

আইএসএলের প্লে অফে গত দুই ম্যাচের প্রতিটিতেই একাধিক গোল খেয়েছে মোহনবাগান এসজি। গত ম্যাচে তারা ১-২ গোলে হারে ওডিশার কাছে। তার আগে গত মরশুমে (২৩ মার্চ, ২০১৮) বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে তারা ২-২-এ শেষ করে। চলতি মরশুমে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে থেকে ৪২টি গোল করেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী, যা অন্য সব দলের চেয়ে বেশি। এই বিষয়ে আইএসএল ইতিহাসের সেরাদের তালিকায় তারা তৃতীয়, এফসি গোয়া (৪৮), মুম্বই সিটি এফসি-র (৪৫) পরেই।
এ মরশুমে ওডিশা এফসি হারার জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ জিতে মাঠ ছেড়েছে মোট ছ’বার। যা অন্য সব দলের তুলনায় বেশি। মোহনবাগানের ক্ষেত্রে তিনবার এমন হয়েছে। চলতি মরশুমে মোহনবাগান একই ম্যাচে তিন বা তার বেশি গোল করেছে মোট ন’বার। অন্য সব দলের চেয়ে বেশি।

যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শেষ তিনটি ম্যাচে মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি ওডিশা এফসি। এই মাঠে যে ছ’টি আইএসএল ম্যাচ খেলেছে তারা, তার মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে জিতেছে ওডিশা, ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ৪-২-এ, ২০২২-এর ১৮ নভেম্বরে। গত চারটি অ্যাওয়ে ম্যাচের একটিতেও জিততে পারেনি তারা। এর মধ্যে একটিতে ড্র করেছে ও তিনটিতে হেরেছে সের্খিও লোবেরার দল। গত মরশুমে (ডিসেম্বর, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি) টানা পাঁচটি অ্যাওয়ে ম্যাচে জিততে পারেনি তারা।

মোহনবাগানের হয়ে আইএসএলে সবচেয়ে বেশি গোল-অবদানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা রয় কৃষ্ণাকে ছুঁতে মনবীর সিংয়ের আর একটি গোল বা অ্যাসিস্ট দরকার। এই তালিকায় সবার ওপরে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (৩৬)। এই ম্যাচে মনবীর একটি গোলে অ্যাসিস্ট করলে তিনি মোহনবাগানের সবচেয়ে বেশি (১৪) অ্যাসিস্ট প্রদানকারীদের তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসবেন, যেখানে ইতিমধ্যেই রয়েছেন পেট্রাটস। ওডিশা এফসি-র গোলকিপার অমরিন্দর সিং এই ম্যাচে মাঠে নামলে সবচেয়ে বেশি আইএসএল ম্যাচ খেলা ফুটবলারদের তালিকায় এক নম্বরে থাকা প্রীতম কোটালকে (১৬২) ধরে ফেলবেন।

দ্বৈরথের ইতিহাস

ইন্ডিয়ান সুপার লিগের পরিসংখ্যান এগিয়ে রেখেছে মোহনবাগান-কেই। এই লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট দশবার। তার মধ্যে চারবার জিতেছে কলকাতার দল। একবার ওডিশা। বাকি পাঁচটিতে ড্র হয়। ২০২০-২১ মরশুমে দু’বারই মোহনবাগান জেতে যথাক্রমে ১-০ ও ৪-১-এ। ২০২১-২২ মরশুমে দু’বারই ড্র হয়। প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য ও দ্বিতীয় ম্যাচে ১-১ ফল হয়। ২০২২-২৩-এর প্রথম মুখোমুখিও গোলশূন্য ছিল। দ্বিতীয় লেগে মোহনবাগান জেতে ২-০-য় এবং প্লে অফেও তারা ওডিশা এফসি-কে একই ফলে হারায়। চলতি মরশুমের লিগ পর্বে ফল হয় ২-২ ও ০-০। এবং কয়েক দিন আগেই সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ওডিশা তাদের প্রথম ও একমাত্র জয়টি পায় ২-১-এ। দুই দলের মুখোমুখিতে এ পর্যন্ত ১৯টি গোল হয়েছে। যার মধ্যে ১৪টি দিয়েছে মোহনবাগান ও পাঁচটি দিয়েছে ওডিশা এফসি।

ম্যাচ- মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম ওডিশা এফসি

সেমিফাইনাল ১ (দ্বিতীয় লেগ)

ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা

সময়- ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.৩০

সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং টিভি চ্যানেল: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ