মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ঘরের মাঠে এসে তাদের হারিয়ে আইএসএল কাপ জেতার আনন্দ যে নিজেদের মাঠে কাপ জেতার আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি, শনিবার ৩-১-এ তাদের হারানোর পর বাঁধভাঙা সেলিব্রেশনে সেটাই বুঝিয়ে দিল তারা।

তিন সপ্তাহ আগে এই একই স্টেডিয়ামে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে হেরে লিগশিল্ড খেয়ায় তারা। সেই ম্যাচে যে নিজেদের সেরা খেলা খেলতে পারেননি তাঁরা, তা দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ই বুঝে নিয়েছিলেন। ষাট হাজার দর্শকের তুমুল চিৎকার ও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ফুটবলারদের উজ্জীবিত পারফরম্যান্সের জোড়া ধাক্কা সামলাতে না পেরে, নিজেদের সেরা খেলাটাই প্রায় ভুলে যায়।

একবার যখন সব কিছু ভুল হতে শুরু করে, তখন সবই ভুল হয়ে চলে। তাই শনিবার মাঠে নামার আগে রাহুল ভেকেরা সংকল্প করেই নেমেছিলেন যে, এই ম্যাচে শুরু থেকে কোনও ভুল করবেন না। কোচ ঠিক যে ভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন।

লিগের শেষ ম্যাচে নিজেদের কোথায় কোথায় ভুল হয়েছিল, তা কোচকে আলাদা করে বলে দিতে হয়নি, নিজেরাই বুঝতে পেরেছিলেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতেরা। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ষাট হাজার সমর্থককে চুপ করিয়ে দেন তাঁরা।

ম্যাচের পর মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন, “আমরা একটা গোল করে এগিয়ে গেলেও প্রতিপক্ষের চেয়ে ভাল খেলতে পারিনি। মুম্বই আমাদের চেয়ে ভাল খেলেছে। ওদের আমরা চাপে ফেলতেই পারিনি। মুম্বই বরং অনেক সোজা ও স্বাভাবিক ফুটবল খেলেছে। আমরা ওদের চাপে ফেলার সুযোগই পাইনি। এটা অবশ্যই ওদের কৃতিত্ব”।

শনিবার আইএসএল ফাইনালে প্রথমে ৪৪ মিনিটের মাথায় জেসন কামিংসের গোলে এগিয়ে যায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। দ্বিতীয়ার্ধে, ৫৩ মিনিটের মাথায় জর্জ পেরেইরা দিয়াজ সমতা আনেন এবং ৮১ মিনিটের মাথায় বিপিন সিং ব্যবধান বাড়ান। বাড়তি সময়ের সাত মিনিটের মাথায় জাকুব ভইতুস তাদের জয় সুনিশ্চিত করে।

তিন সপ্তাহ আগেই লিগের শেষ ম্যাচে নিজেদের মাঠে মুম্বইকে হারিয়ে শিল্ড জিতে নিয়েছিল মোহনবাগান এসজি, সেই মুম্বই শনিবার নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়ে কাপ জিতে মাঠ ছাড়ে। প্রথমার্ধে মোহনবাগান কিছুক্ষণের জন্য দাপুটে পারফরম্যান্স দেখালেও দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় অতিথিরা এবং বাজিমাত করে। ভরা গ্যালারির হাজার ষাটেক দর্শকের তুমুল চিৎকার কার্যত উপেক্ষা করে সারা ম্যাচে বেশিরভাগ সময় কার্যত তারাই দাপুটে ফুটবল খেলে বাজিমাত করে।

এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর শনিবার indiansuperleague.com কে মুম্বই সিটি এফসি-র অধিনায়ক রাহুল ভেকে বলেন, “শিল্ড জয়ের ম্যাচে আমরা যে ভুলগুলো করেছিলাম, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছি। কোচ আমাদের একটা নির্দিষ্ট কৌশলে খেলতে বলেছিলেন। আজ প্রত্যেকেই যার যার নিজের দায়িত্ব খুব ভাল করে জানত। ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই আমরা কী ভাবে খেলেছি, তা সকলেই দেখেছেন। সে জন্যই জয় পেলাম এবং ৯০ মিনিট পর্যন্ত আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছি”।

বিরতিতে এক গোলে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও যে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, সেই আত্মবিশ্বাস তাঁদের মধ্যে ছিল বলে জানান রাহুল। বলেন, “আমরা এক গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পরেও একে অপরের উপর আস্থা বজায় রেখেছি। বিরতির পর যখন মাঠে নামি, তখন একই ভাবে খেলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, গোল পাব”।

কোচের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই যে সাফল্য পেলেন, তা স্বীকার করে নিয়ে ভারতীয় দলের ডিফেন্ডার বলেন, “গত তিন বছর ধরে আমরা যে দর্শন নিয়ে খেলেছি, ডেস (বাকিংহাম) স্যরের পর পিটার (ক্রাতকি) স্যর এসেও সেই দর্শন নিয়েই আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। উনি যে রকম ভাবে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। সেমিফাইনাল, ফাইনাল একেবারে অন্যরকমের ম্যাচ। এই ম্যাচগুলোতে মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত অবস্থা সামলাতে হয়। কোচ আমাদের এ কথা বলেওছিলেন যে, মাঝে মাঝে তোমাদের পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যখন আমরা যে ভাবে খেলতে চাই, সে ভাবে খেলতে পারব না। তখন যে ভাবে তা সামলানো প্রয়োজন সে ভাবেই সামলাতে হবে। আমরা তা-ই করেছি”।

এক গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে সতীর্থদের কী বলেছিলেন, তা জানতে চাওয়ায় মুম্বই অধিনায়ক বলেন, “বিরতিতে সতীর্থদের আমার বেশি কিছু বলার ছিল না। কারণ, ওদের ওপর আমার সম্পুর্ণ আস্থা ছিল। প্রত্যেকেই আত্মবিশ্বাসী ও ইতিবাচক ছিল। আমরা আগে গোল খেলেও প্রথমার্ধে ওদের আর কোনও সুযোগ দিইনি। যে ভাবে আমরা খেলছিলাম, তা খুবই ইতিবাচক। জানতাম, যদি এ ভাবেই খেলে যেতে পারি, তা হলে গোল আসবেই। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম সাত মিনিটের মধ্যেই বোধহয় আমরা গোল পেয়ে যাই। তার পরেই সব কিছু বদলে যায়”।

সমতা আনার পরেও দলের দুই বিদেশী তারকা জর্জ পেরেইরা দিয়াজ ও আলবার্তো নগুয়েরা চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে আসেন। তাঁদের জায়গায় যাঁরা নামেন, তাঁরাই গোল করে দলকে জেতান। দুই বিদেশী মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার পর যে মানসিক চাপে পড়ে যাননি তাঁরা, তা জানিয়ে মুম্বই শিবিরের দলনেতা বলেন, “দিয়াজ, নগুয়েরা চোট পেয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নার্ভাস হয়ে যাইনি। গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে আমাদের দেশীয় ফুটবলাররা বাইরের মাঠে খুবই ভাল খেলেছিল এবং ৬-৭ মিনিটে তিনটে গোল করেছিল। প্রত্যেকেই জানত, কাকে কী করতে হবে। বেঞ্চ থেকে যারা নেমেছিল, তাদেরও প্রমান করার ছিল। এ রকম বড় ম্যাচে প্রত্যেকেই ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে চায়, নিজেকে প্রমাণ করতে চায় এবং প্রত্যেকেই তা করতে পেরেছে”।

শনিবারের ম্যাচে লিস্টন কোলাসোকে আটকে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাহুল। সেই ভূমিকা তিনি যথাযথ ভাবে পালনও করেন তিনি। সেই প্রসঙ্গে বলেন, “লিস্টন কত ভাল খেলোয়াড় তা আমরা জানি। ওর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার। তাই ওকে আটকানোর জন্য সব সময় তৈরি ছিলাম। সেমিফাইনালে যে রকম খেলেছিলাম, তা আমাকে আরও উজ্জীবিত করে তুলেছিল। জানতাম , ফাইনালে লিস্টনকে আটকে রেখে দলকে সাহায্য করতে হবে আমায়। মনে হয়, নিজের সেরাটা দিতে পেরেছি এবং দলকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে পেরেছি”।

শিল্ড খোয়ানোর বদলা নিতে পেরে উচ্ছ্বসিত রাহুল ভেকের সতীর্থরা। প্রায় সবার মুখেই বদলার কথা। লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে যেমন বলেন, “আমরা এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম এতদিন। ওদের (মোহনবাগান) শিল্ড জয়ের ম্যাচে হারের বদলা নেওয়ার জন্য। শুরু থেকেই দল হিসেবে খেলেছি আমরা। প্রতিপক্ষের ষাট হাজার সমর্থকের চিৎকারে খুব একটা মন দিইনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, যে ভাবেই হোক ম্যাচটা জেতা। আমাদের দলের ছেলেরা সবাই এই ম্যাচে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে”।

ছাঙতের সতীর্থ উইঙ্গার বিক্রম প্রতাপ সিং বলেন, “আইএসএল কাপ জিততে পেরে খুবই ভাল লাগছে। এখানে এসে খেলা ও জেতা মোটেই সহজ নয়। সবাই জানি ওদের দল কী রকম এবং ওদের সমর্থকেরা কী রকম। কিন্তু শিল্ড জয়ের ম্যাচের পর আমরা উপলব্ধি করি কোথায় কোথায় আমাদের ভুল হয়েছিল। সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাইনি”।

মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গত ম্যাচের পর যে কোচকে তাঁদের ভুল ধরিয়ে দিতে হয়নি, নিজেরাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলান, তা তানিয়ে বিক্রম প্রতাপ সিং বলেন, “আমাদের কিছু বলতে হয়নি। আমরা নিজেরাই বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা সেই স্তরের ফুটবল সে দিন খেলতে পারিনি। সবাই-ই জানতাম আমাদের আরও ভাল খেলতে হবে। এখন দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। পরের মরশুমে আরও ভাল খেলতে চাই”।

ডিফেন্ডার মেহতাব সিং বলেন, “আমরা লিগের শেষ ম্যাচে হারের বদলা এই ম্যাচে নিলাম। আমি এই মাঠে খেলে বড় হয়েছি। তাই জানতাম, এখানে খেলার চাপ কী করে সামলাতে হয়। তাই মোহনবাগান সমর্থকদের চিৎকার নিয়ে চিন্তায় ছিলাম না। জিততে পেরে দারুন লাগছে”।

শনিবার ম্যাচের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কোচ পিটার ক্রাতকি বলেন, “আমরা ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করেছি এবং নিজেদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছি। প্রথম গোলটা করার পরই আমরা বুঝতে পারি, আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোলটার পরই বুঝতে পারি, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছি”।

নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়ে ক্রাতকি বলেন, “প্রথমার্ধে আমরাই এগিয়ে ছিলাম। এই ম্যাচে আমাদের কৌশল দু’সপ্তাহ আগের ম্যাচে চেয়ে পুরোপুরি অন্য রকম ছিল। ছেলেরা সেই কৌশল কার্যকর করেছে বলেই জিততে পেরেছে”।