দুই অস্ট্রেলীয়র গোলে ফের কলকাতা ডার্বি জিতে দু’নম্বরে মোহনবাগান এসজি
দুই উইং দিয়ে সমানে আক্রমণের ঝড় তোলেন লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং। ম্যাচের সেরা গ্রেগ স্টুয়ার্ট ও জেমি ম্যাকলারেন মাঝ বরাবর আক্রমণে উঠে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে বারবার চিড় ধরান।

ফের মোহন-ইস্ট কলকাতা ডার্বি। ফের মোহনাবাগানের দাপুটে জয়। আইএসএলে কলকাতার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যোগ দেওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ ডার্বিতেই যে ছবি দেখা গিয়েছে, শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনেও সেই চেনা ছবিই দেখা গেল। ইস্টবেঙ্গলকে ২-০-য় হারিয়ে লিগ টেবলের দ্বিতীয় স্থানে উঠে পড়ল গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। চলতি ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এই নিয়ে টানা পাঁচটি হারের মুখোমুখি হতে হল ইস্টবেঙ্গলকে।
শনিবার সারা ম্যাচে দাপুটে পারফরম্যান্স দেখিয়ে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে ৪১ মিনিটের মাথায় এগিয়ে দেন অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেন। ম্যাচের শেষ দিকে নেমে পেনাল্টি আদায় করে তা থেকে ৮৯ মিনিটে দলকে দ্বিতীয় গোল এনে দেন আর এক অস্ট্রেলীয় তারকা দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এ দিন সারা ম্যাচে মোহনবাগান যেখানে সাতটি শট গোলে রাখে, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের মাত্র একটি শট লক্ষ্যে ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে তাদের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস নামলেও প্রতিপক্ষের রক্ষণকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী।
মোহনবাগান এ দিন রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণ— সর্বত্র ইস্টবেঙ্গলকে পিছনে ফেলে দেয়। বিশেষ করে দুই উইং দিয়ে সমানে আক্রমণের ঝড় তোলেন লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং। ম্যাচের সেরা গ্রেগ স্টুয়ার্ট ও জেমি ম্যাকলারেন মাঝ বরাবর আক্রমণে উঠে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে বারবার চিড় ধরান। ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার প্রভসুখন গিল যেখানে পাঁচটি সেভ করেন, সেখানে বাগান গোলকিপার বিশাল কয়েথকে সারা ম্যাচে একটির বেশি শট সেভ করতে হয়নি।
মোহনবাগান যেখানে ১৮টি গোলের সুযোগ তৈরি করে, সেখানে ইস্টবেঙ্গল চারটির বেশি সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। ইস্টবেঙ্গল প্রতিপক্ষের বক্সে যেখানে কুড়িবার ঢোকে, সেখানে তাদের বক্সে বাগান অ্যাটাকাররা প্রবেশ করেন ৩৭ বার। ফাইনাল থার্ডে যেখানে ১০৪ বার পাস বাড়ান সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়রা ৭১টি পাস বাড়ান প্রতিপক্ষের ফাইনাল থার্ডে। এই পরিসংখ্যানগুলিই বুঝিয়ে দেয়, শনিবার যুবভারতীতে মোহনবাগানের দাপট ঠিক কতটা ছিল।
ক্লেটন সিলভা ও সল ক্রেসপো ছন্দে না থাকা, নাওরেম মহেশের অনুপস্থি এবং প্রায় দিয়ামান্তাকস অর্ধেক ফিট থাকায় ইস্টবেঙ্গলকে এদিন যথেষ্ট ভুগতে হয়। তাও আনোয়ার আলি, হেক্টর ইউস্তে, মাদি তালালদের উদ্যোগে তারা ম্যাচের কিছু অংশে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিপক্ষের সঙ্ঘবদ্ধ, অলরাউন্ড পারফরম্যান্সকে টেক্কা দেওয়ার জন্য এই কয়েকজনের প্রচেষ্টা যথেষ্ট ছিল না।
মোহনবাগান এসজি অপরিবর্তিত দল নামালেও ইস্টবেঙ্গল এফসি এ দিন তিনটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান তাদের কোচ বিনো জর্জ। নবাগত স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোনকে এ দিন লাল-হলুদ ডাগ আউটে দেখা যায়। প্রভসুখন গিল, মহম্মদ রকিপ ও ডেভিড লালনসাঙ্গা এ দিন মাঠে নামেন দেবজিৎ মজুমদার, লালচুঙনুঙ্গা ও নাওরেম মহেশের জায়গায়। আহত মহেশ এ দিন স্কোয়াডেই ছিলেন না।
শুরু থেকেই এ দিন দুই উইং দিয়ে আক্রমণ শুরু করে মোহনবাগান। ডানদিক দিয়ে মনবীর ও বাঁ দিক দিয়ে কোলাসো প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দু’টি কর্নার আদায় করে নেয় তারা। মনবীরের লো ক্রস গোললাইনের সামনে থেকে ক্লিয়ার করেন ইউস্তে। কোলাসোর গোলমুখী শট আটকান গিল।
মিনিট দশেক পর থেকে পাল্টা আক্রমণে ওঠা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। ১২ মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে নন্দকুমারের ক্রস পেয়ে গোলে শট নেন ক্লেটন, যা আটকে দেন বিশাল। প্রথম ১৫ মিনিটে দুই দলই একটি করে শট গোলে রাখে। কিন্তু তার পরে সারা ম্যাচে লাল-হলুদ বাহিনীর আর একটিও শট গোলের লক্ষ্যে ছিল না।
তবে ১৮ মিনিটের মাথায় যে সুযোগ পেয়েছিলেন জেমি ম্যাকলারেন, তাকে অনায়াসে সিটার বলা যায়। বক্সের মাথা থেকে গ্রেগ স্টুয়ার্টের হাওয়ায় ভাসানো ক্রস গিলের সামনে থেকে বাঁ পায়ে গোলে ঠেলার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু তা গিলের বুকে লাগে। পরের মিনিটেই কোলাসোর কর্নারে হেড করে বল জালে জড়িয়েও দেন মনবীর। কিন্তু সেই গোল রেফারি বাতিল করে দেন অফসাইডের কারণে।
মাদি তালাল মাঝমাঠে তৎপর হয়ে ওঠায় ইস্টবেঙ্গল ক্রমশ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। ম্যাচের প্রথম কর্নারটি তারা পায় ২৩ মিনিটের মাথায়। সেই কর্নারের পর বিশালের দূরপাল্লার শটে ইস্টবেঙ্গলের অর্ধে প্রায় ফাঁকা অঞ্চলে বল পেয়ে যান কোলাসো। কিন্তু রকিপ তাঁকে বাধা দেওয়ায় ও গিল এগিয়ে এসে তা ক্লিয়ার করায় সেই সুযোগ হাতছাড়া হয় তাঁর। ৩০ মিনিটের মাথায় ফের তাঁর শট অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়। ২৫ মিনিটের মাথায় স্টুয়ার্টের কর্নারে ফের হেড করে গোলের চেষ্টা করেন মনবীর। কিন্তু তা অনবদ্য সেভ করেন গিল।
এ দিন দুই দলেরই ট্রানজিশন ছিল দ্রুত ও কার্যকরী। একটা আক্রমণ হয়ে যাওয়ার পরই প্রতি আক্রমণ হয়েছে বারবার এবং দ্রুত নেমে এসে বারবার কাউন্টার অ্যাটাক সামলেঠেন ডিফেন্ডাররা। তবে মোহনবাগান আক্রমণে যতটা উইং ব্যবহার করে, ইস্টবেঙ্গল কিন্তু মাঝ বরাবর আক্রমণেই বেশি জোর দেয়। যার ফলে মোহনবাগান রক্ষণের কাজ তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়ে ওঠে।
৪০ মিনিটের মাথায় ফের ম্যাকলারেনের কাট ব্যাক থেকে গোলের সুযোগ পান কোলাসো। বক্সের মাঝখান থেকে তিনি গোলে শটও নেন, যা আটকে দেন গিল। তবে সে যাত্রা গোল না পেলেও তার পরের মিনিটেই গোল পেয়ে যায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। ডানদিক দিয়ে ওঠা মনবীর গোলের সামনে ক্রস পাঠান ম্যাকলারেনকে এবং সেই ক্রসে গোলে বল ঠেলতে কোন অসুবিধাই হয়নি প্রায় অরক্ষিত ম্যাকলারেনের (১-০)।
যখন মনবীরের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বক্সে ঢোকেন ম্যাকলারেন, তখন তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেননি কোনও লাল-হলুদ ডিফেন্ডার। আনোয়ারের সামনে দিয়েই বল পৌঁছয় গোলদাতার পায়ে। তখন তাঁর পিছনেই ছিলেন ইউস্তে। তিনি বাধা দেওয়ার আগেই গোলে বল ঠেলে দেন ম্যাকলারেন। প্রথমার্ধের শেষ দিকে সবুজ-মেরুন ব্রিগেডেরই দাপট ছিল বেশি। ইস্টবেঙ্গল ক্রমশ খেলা থেকে হারিয়ে যায়। প্রথমার্ধে বল দখলের লড়াইয়েও অনেকটাই এগিয়ে (৬৩-৩৭) ছিল মোহনবাগান।
ডেভিডের জায়গায় পিভি বিষ্ণুকে এনে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু শুরুতেই ব্যবধান বাড়ানোর যে সুযোগ পেয়ে যায় মোহনবাগান, তা থেকে গোল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক ছিল। সেন্টারলাইনের পিছন থেকে বাঁ প্রান্তে যে অনবদ্য দূরপাল্লার পাস বাড়ান স্টুয়ার্ট, তা নিয়ে অনেকটা উঠে বক্সের বাঁদিক থেকে গোলের সামনে ক্রস বাড়ান কোলাসো। কিন্তু বলের নাগাল পাননি ম্যাকলারেন। ডানদিক দিয়ে ওঠা সম্পুর্ণ অরক্ষিত মনবীরের পায়ে বল পড়ে। তিনি ফের ম্যাকলারেনকে ক্রস দিতে যান, যা আটকে দেন গিল। বাগানের তিন ফরোয়ার্ড একসঙ্গে আক্রমণে ওঠার সময় ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ ছিল প্রায় ফাঁকা।
দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশ মিনিটে যেখানে অন্তত চারটি গোলের সুযোগ তৈরি করে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড, সেখানে একবারও প্রতিপক্ষের রক্ষণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী। আক্রমণে ধার বাড়াতে ৬৫ মিনিটের মাথায় ক্লেটনকে তুলে দিয়ামান্তাকসকে নামায় ইস্টবেঙ্গল। বিষ্ণু আগেই নেমেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দিয়ামান্তাকস যোগ দেওয়ায় কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসে তারা। তবে তাদের রক্ষণ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ঘন ঘন দুই উইং দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যান মনবীর, কোলাসোরা।
রকিপ এবং নন্দকুমারকেও ৭০ মিনিটের মাথায় তুলে নেয় ইস্টবেঙ্গল। তাঁদের জায়গায় নামেন লালচুঙনুঙ্গা ও জেসিন টিকে। একই সঙ্গে ম্যাকলারেনকে তুলে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে নামায় মোহনবাগান। তিন ফরোয়ার্ড একসঙ্গে খেলায় ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে কিছুটা হলেও ধার বাড়ে। ড্রিঙ্কস ব্রেকের পরেই ইস্টবেঙ্গল বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে ওঠে এবং বক্সের বাঁ দিক থেকে দিয়ামান্তাকসের উদ্দেশে কাট ব্যাক করেন জেসিন। কিন্তু বল গ্রিক ফরোয়ার্ডের হাতে লাগায় সেই পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোনও ভাবেই প্রতিপক্ষকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেয়নি মোহনবাগান। বরং তারা দ্বিতীয় গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ৮৪ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলের বক্সের বল নিয়ে গোলের দিকে এগনোর সময় গ্রেগ স্টুয়ার্টকে বাধা দেন আনোয়ার। পেনাল্টির জোরালো আবেদন করেও পায়নি মোহনবাগান। কিন্তু এর তিন মিনিট পর স্টুয়ার্টের পাস পেয়ে পেট্রাটস যখন তাদের বক্সে ঢুকে পড়েন, তখন এগিয়ে এসে ডাইভ দিয়ে গিল তাঁকে বাধা দেওয়ায় পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। ৮৮ মিনিটের মাথায় স্পট কিক থেকে দ্বিতীয় গোল করতে ভুল করেননি পেট্রাটস (২-০)। এই গোলের পর ইস্টবেঙ্গল কার্যত হাল ছেড়ে দেয়। ফলে ছ’মিনিটের বাড়তি সময় পাওয়া সত্ত্বেও একটিও গোল শোধ করতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী।
ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৪-২-৩-১): প্রভসুখন সিং গিল (গোল), মহম্মদ রকিপ (লাল চুঙনুঙ্গা-৭১), হেক্টর ইউস্তে, আনোয়ার আলি, প্রভাত লাকরা (মার্ক জোথানপুইয়া-৮৪), শৌভিক চক্রবর্তী, সল ক্রেসপো, নন্দকুমার শেকর (জেসিন টিকে-৭১), ক্লেটন সিলভা (দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস-৬৫), মাদি তালাল, ডেভিড লালনসাঙ্গা (পিভি বিষ্ণু-৪৫)।
মোহনবাগান এসজি দল (৪-৪-১-১): বিশাল কয়েথ (গোল), আশিস রাই, আলবার্তো রড্রিগেজ, টম অ্যালড্রেড, শুভাশিস বোস, গ্রেগ স্টুয়ার্ট (জেসন কামিংস-৯২), অনিরুদ্ধ থাপা (দীপক টাঙরি-৯০), আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো (আশিক কুরুনিয়ান-৯২), জেমি ম্যাকলারেন (দিমিত্রিয়স পেট্রাটস-৭২), মনবীর সিং (সহাল আব্দুল সামাদ-৯০)।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৪২.৪% - মোহনবাগান এসজি ৫৭.৬%, সফল পাসের হার: ৮০%-৮৬%, গোলে শট: ১-৭, ফাউল: ৮-১৩, ইন্টারসেপশন: ৭-১৩, ক্রস: ৭-২৩, কর্নার: ২-১২, হলুদ কার্ড: ২-৩।
ম্যাচের সেরা: গ্রেগ স্টুয়ার্ট (মোহনবাগান এসজি)