মোহনবাগানর সুপার জায়ান্টের কাছে এখন সব ম্যাচই ফাইনালের মতো মরণ-বাঁচন লড়াই, তা আগেই জানিয়েছেন দলের কোচ-অধিনায়কেরা। এই রকম একটি কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের যাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেই হেড কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস বেশ অসুস্থ। শনিবার পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচ দিল্লিতে। তার আগের দিনও দলের অনুশীলনে যোগ দিতে পারলেন না তিনি। এতটাই কাহিল ও দুর্বল তিনি যে, শুক্রবার দলের সঙ্গেও দিল্লিতে যেতে পারলেন না। 

তাঁর সহকারী জানিয়ে দিলেন শনিবার সুস্থ থাকলে সকালে দিল্লিতে যাবেন তিনি। না পারলে যাবেন না। এর মধ্যে গত ম্যাচে ঘরের মাঠে অপেক্ষাকৃত দুর্বল চেন্নাইন এফসি-র কাছে হেরে গিয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ফলে তাদের লিগ-শিল্ড জয়ের রাস্তা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় হেড কোচকে ছাড়াই নিজেদের উজ্জীবিত করে তোলার কাজটা করে যেতে হচ্ছে ফুটবলারদের, যার অনেকটাই দায়িত্ব রয়েছে দলের অন্যতম অধিনায়ক শুভাশিস বোসের কাঁধে।  

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ১৩৬টি ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞ শুভাশিস বোসের মতে, “আমাদের হেড কোচ হাবাস দলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উনিই দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কৌশল, ফরমেশন থেকে শুরু করে সব কিছুই উনি দেখেন। ওঁর ভূমিকা দলের জন্য অপরিহার্য্য। উনি এখন অসুস্থ। আশা করি, তাড়াতাড়ি ফিট হয়ে যাবেন। তবে আমরা যেহেতু পেশাদার খেলোয়াড়, তাই দল সমস্যায় পড়লে ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। দলকে জেতানোর দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে”।

শুধু হাবাস নন, নেই-এর তালিকায় রয়েছেন নির্ভরযোগ্য উইঙ্গার সহাল আব্দুল সামাদও। জনি কাউকো ও দীপক টাঙরিও গত ম্যাচের শেষ দিকে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁরা এই ম্যাচে খেলবেন বলে জানা গেলেও সহাল যে খেলবেন না, তা জানিয়ে দিলেন সহকারী কোচ মানুয়েল পেরেজ।  

তবে শুভাশিস মনে করেন, “এই মরশুমে অনেক ম্যাচে অনেক খেলোয়াড়ই ছিল না, চোট ছিল। অনেকেই অনেকের জায়গায় এসে খেলেছে, যেমন আনোয়ারের জায়গায় দীপ্পেন্দু এসে খেলেছে, তখনও আমরা জিতেছি। আমাদের যে কোনও খেলোয়াড় মাঠে নামলে নিজেদের সেরাটা দেয়। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। প্রত্যেকেই দলকে জেতাতে চেষ্টা করে। আমরা কালও সবাই মিলে দলকে জেতানোর চেষ্টা করব। জানি, হাবাসের ভূমিকা ও প্রভাব এই দলে অনেক বেশি। উনি নেই, সহালও নেই। কিন্তু যারা খেলবে, তারা নিজেদের সেরাটা দিয়ে দলকে জিততে সাহায্য করবে”।

লিগের শেষ তিন ম্যাচে জিততেই হবে মোহনবাগানকে, এমনই পরিস্থিতির মধ্যে শনিবার দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে নামছে তারা। দিল্লির গরমে ম্যাচ বিকেল পাঁচটা থেকে। বাকি তিন ম্যাচ নয়, আপাতত এই ম্যাচেই মনোনিবেশ করেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী।   

দলনেতা শুভাশিস বলছেন, “ভারতে সব জায়গাতেই গরম ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। সে জন্য আজ আমরা সকালে গরমের মধ্যেই অনুশীলন করেছি। আশা করি, দলের সকলেই মানিয়ে নেবে ও পরের ম্যাচে হয়তো আমরা বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ব না, ভাল খেলব। এ রকম পরিস্থিতিতে মানসিক ভাবে দৃঢ় থাকা জরুরি। আশা করি, আমাদের ছেলেরা পারবে”।

এ রকম পরিস্থিতিতে মোহনবাগান আগেও পড়েছে বলে মনে করিয়ে দিয়ে শুভাশিস বলেন, “মোহনবাগানের মতো ক্লাবে খেলতে গেলে ফুটবলারদের চাপ নেওয়ার মানসিকতা ও ক্ষমতা থাকতে হয়। ট্রফি ছাড়া এই ক্লাব কিছু ভাবতে পারে না। আশা করি এ বছরও ট্রফি আসবে দলের পরিবেশ যথেষ্ট ভাল আছে। এখন আমাদের বাকি তিনটি ম্যাচই জিততে হবে। আমাদের খেলোয়াড়রা প্রতি ম্যাচেই জেতার মানসিকতা নিয়ে নামে। পরের ম্যাচগুলোতেও সেটাই থাকবে”। 

গত ম্যাচে চেন্নাইনের কাছে হার ভুলে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে তারা। শুভাশিস বলেন, “দলের প্রত্যেক ম্যাচেই নিজেদের সেরাটা দিয়েছে সবাই। তবে গত ম্যাচে জিততে পারিনি। এখন বাকি তিনটি ম্যাচেই জিততে হবে আমাদের। এটাই এখন লক্ষ্য আমাদের। আপাতত কালকের পাঞ্জাব ম্যাচটাতেই মনোনিবেশ করছি আমরা। তার পরে ঠিক করব আমাদের কী করতে হবে”। 

কোচ অসুস্থ, নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়ের চোট তো আছেই। এ ছাড়াও শনিবারের ম্যাচে দিল্লির গ্যালারিতে সমর্থকেরা থাকবেন না, যা তাদের উজ্জীবিত করে তোলার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি ছিল। এই প্রসঙ্গে শুভাশিস বলেন, “সমর্থকেরা আমাদের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৭০-৮০ মিনিটের পর আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলে সমর্থকদের চিৎকারেই আমরা ফের চাঙ্গা হয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, কাল সমর্থকদের গ্যালারিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবু পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ভাল খেলতে হবে আমাদের”। 

হাবাসের তত্ত্ব, আক্রমণ ও রক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে খেলা, তা ইদানীং দেখা যাচ্ছে না মোহনবাগানের পারফরম্যান্সে। যার ফলে গত দুটি ম্যাচে ছ’টি গোল দেওয়ার পাশাপাশি ছ’গোল খেয়েছেও তারা। এই সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠায় শুভাশিস বলেন, “আগের কিছু ম্যাচ আমরা আক্রমণ ও রক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই খেলেছি। কিন্তু এখন আমাদের পরিস্থিতি এমন যে, লিগ শিল্ড জিততে গেলে আমাদের সব ম্যাচে জিততেই হবে। তাই আমরা আক্রমণাত্মক ফরমেশনেই খেলেছি। সে জন্য হয়তো গোল খেয়েছি। কিন্তু গোল করেওছি। সুযোগও অনেক তৈরি করেছি। গত ম্যাচে হেরেছি ঠিকই। কিন্তু ওদের (চেন্নাইন এফসি) গোলকিপার দেবজিৎ অনবদ্য খেলেছে। সে দিন ১০-১২টা সেভ করেছে ও। এর মধ্যে দু-তিনটে অবধারিত গোল ছিল। আমার মনে হয়, দলের মধ্যে ভারসাম্য এখনও আছে। কিন্তু আক্রমণে উঠতে গিয়ে মাঝে মাঝে গোল খেয়ে যেতে হয়। আশা করি, পরের ম্যাচগুলোতে আমরা আরও সঙ্ঘবদ্ধ থাকতে পারব ও জিতব। পাঞ্জাবকে হারানোর জন্য কোচের কৌশল ও পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলব। দল হিসেবে খেলব। আক্রমণ, রক্ষণ সবই দল হিসেবেই করব”। 

দলের সহকারী কোচ মানুয়েল পেরেজ বলেন, “চেন্নাইন ম্যাচে কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে, তার বিশ্লেষণ আমরা করেছি। আমাদের এগোতে হবে। কাল সম্পুর্ণ নতুন একটা ম্যাচ রয়েছে আমাদের সামনে। সমর্থকদের ছাড়া খেলা কঠিন। কোভিডের সময় আমাদের ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলতে হয়েছিল। এ দেশে মোহনবাগানের সমর্থকদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি বোধহয়। সমর্থকদের অভাব অনুভব করব আমরা”। 

হাবাসের অনুপস্থিতি নিয়ে পেরেজ বলেন, “আন্তোনিওকে ছাড়া খেলা সত্যিই কঠিন। কারণ, উনি এই বাসের ড্রাইভার। তবে আমাদের জেতার ক্ষমতা আছে। উনি অসুস্থ হলে কিছু করার নেই। আমাদের জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই হবে”।

প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ, “পাঞ্জাব যথেষ্ট ভাল দল। দ্বিতীয় লেগের পরিসংখ্যান যদি দেখেন, তা হলে দেখবেন মুম্বই, মোহনবাগানের পর পাঞ্জাবই সবচেয়ে ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, অনেক গোলও করেছে। ওদের ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে, ভাল কোচ আছে। আমরা এক কঠিন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে চলেছি। কিন্তু ওরা ছ’নম্বর জায়গাটার জন্য লড়ছে, আমরা শিল্ডের দৌড়ে আছি। আমাদের দুই দলেরই এই ম্যাচে জয় চাই”।