এএফসি কাপে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ওডিশা এফসি-র মুখোমুখি মোহনবাগান এসজি
সোমবার যুবভারতীর ম্যাচের আগে ঢাকায় বসুন্ধরা যদি মাজিয়াকে হারিয়ে দেয়, তা হলে মোহনবাগানের সামনে জয় ছাড়া কোনও রাস্তাই বেঁচে থাকবে না।

এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের গণ্ডী কি পেরোতে পারবে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দুই দল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এবং ওডিশা এফসি? সোমবার সন্ধ্যায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দুই দল এশীয় স্তরের এই আন্তঃক্লাব প্রতিযোগিতায় ফিরতি লড়াইয়ে মুখোমুখি হওয়ার আগে এই প্রশ্ন উঠছে তাদের অবস্থানের জন্য।
ভারতের দুই ক্লাবই এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, যেখানে এই ম্যাচ জিততে না পারলে তাদের গ্রুপ লিগেই অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। মোহনবাগান এসজি তাও ওডিশার চেয়ে এক পয়েন্ট বেশি নিয়ে কিছুটা হলেও লড়াইয়ে রয়েছে। কিন্তু এই ম্যাচে পুরো তিন পয়েন্ট অর্জন করতে না পারলে ওডিশার বিদায় অবধারিত।
মোহনবাগানের মতোই সাত পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে বাংলাদেশের বসুন্ধরার কিংস। কারণ, কলকাতার দলকে প্রথম ম্যাচে রুখে দেওয়ার পর দ্বিতীয় মুখোমুখিতে হারিয়েছে বসুন্ধরা। তাই সবুজ-মেরুন বাহিনীর চেয়ে এগিয়ে ঢাকা-বাহিনী। ওডিশা ছ’পয়েন্ট নিয়ে তিন নম্বরে। গ্রুপের চতুর্থ দল মলদ্বীপের মাজিয়া এফসি মাত্র এক ম্যাচ জিতে চার নম্বরে। তাদের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও প্রতি দলেরই এখনও দুটি করে ম্যাচ বাকি।
জটিল, কঠিন অঙ্ক
সোমবার যুবভারতীর ম্যাচের আগে ঢাকায় বসুন্ধরা বনাম মাজিয়া ম্যাচের ফল জানা হয়ে যাবে দু’পক্ষেরই। ওই ম্যাচে ঘরের মাঠে বসুন্ধরা যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী মাজিয়াকে হারিয়ে দেয়, তা হলে মোহনবাগানের সামনে শেষ দুই ম্যাচে জয় ছাড়া পরের রাউন্ডে যাওয়ার আর কোনও রাস্তাই বেঁচে থাকবে না। অবশ্য পরের দুই ম্যাচে জিতলেও মোহনবাগান যে পরের রাউন্ডে যাবে, সে নিশ্চয়তাও নেই। বসুন্ধরাও যদি তাদের শেষ দুই ম্যাচে জেতে, তা হলেও মোহনবাগানের গ্রুপ সেরা হিসেবে পরের রাউন্ডে ওঠা হবে না। তখন তাদের অন্যান্য গ্রুপের ম্যাচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে, যদি দ্বিতীয় সেরাদের মধ্যে শীর্ষে থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়া যায়।
অঙ্ক এমনই জটিল এবং সেই অঙ্ক কষতে না বসে সোমবার জেতার মতো পারফরম্যান্স কী করে মাঠে দেওয়া যায়, সেই নিয়েই বেশি চিন্তিত দুই স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো ও সের্খিও লোবেরা। এমন কঠিন ম্যাচে নামার আগে মোহনবাগানের কোচ রবিবার সাংবাদিকদের বলেন, “দুই দলের কাছেই এটা কঠিন ম্যাচ। কারণ, দুই দলেরই পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য এই টুর্নামেন্টে টিকে থাকার জন্য কাল জেতা”।
চোট-চিন্তা সবুজ-মেরুনে
কিন্তু জিতবেন কী ভাবে? তাঁর দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য ফুটবলারই যে চোটের কবলে পড়েছেন। আশিক কুরুনিয়ান ও আনোয়ার আলি তো আগে থেকেই চোট পেয়ে বসে রয়েছেন। এ বার মনবীর সিং দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট নিয়ে ফিরেছেন মনবীর এবং কলকাতায় অনুশীলন করার সময় চোট পেয়েছেন অস্ট্রেলীয় তারকা পেট্রাটস। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছে মোহনবাগান শিবির। কারা গোল আটকাবেন, কারা গোলের বল সাপ্লাই দেবেন এবং কারাই বা গোল করবেন, তারই তো কোনও হদিশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফেরান্দো অবশ্য সমর্থকদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য বললেন, “আমাদের বড়সড় স্কোয়াডে ওদের বিকল্প হিসেবে খেলার মতো ফুটবলার রয়েছে। তাদের কাছে এটা নিজেদের বড় জায়গায় প্রমাণ করার সুযোগ। আনোয়ার, আশিক, মনবীরদের না পাওয়াটা খুবই হতাশাজনক। কিন্তু ওরা না থাকায় এমন কোনও ফুটবলার পেয়ে যেতে পারি, যে বা যারা ভবিষ্যতে আমাদের কাজে আসতে পারে। আমি সেই আশায় রয়েছি”।
হয়তো তাঁর কথা ঠিক হতে পারে। কিন্তু সেই ফুটবলার কে বা কারা হতে পারেন, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। চলতি এএফসি কাপ গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচে ওডিশা এফসি-কে তাদের মাঠে গিয়ে ৪-০-য় হারিয়ে এসেছিল মোহনবাগান। কিন্তু সে দু’মাস আগের ঘটনা। তার পর দুই দলই একাধিক ম্যাচ খেলেছে এএফসি কাপে এবং আইএসএলে। ওডিশা বসুন্ধরার কাছে যেমন হেরেছে, আবার মাজিয়াকে ৬-১ ও ৩-২-এ হারিয়েওছে। মোহনবাগানও মাজিয়াকে ২-১-এ হারিয়েছে। কিন্তু তার পরে বসুন্ধরার বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের একটিতে ড্র করেছে ও অপরটিতে হেরেছে।
ছন্দে ফিরছে কলিঙ্গবাহিনী
এই অধঃপতনের অন্যতম কারণ অবশ্যই আনোয়ার, আশিকদের অনুপস্থিতি। এ বার সেই অনুপস্থিতির তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে। ওডিশার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। এ দিন তাদের কোচ লোবেরা বলেই দিলেন, তাঁর দলের সব খেলোয়াড়ই সুস্থ। যদিও এই ম্যাচে নামার আগে পর্যন্ত এই ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। লোবেরার বক্তব্য, “চোট-আঘাত, সাসপেনশন, এ সব কিছু সত্ত্বেও মোহনবাগান যথেষ্ট ভাল দল। গত ম্যাচে ওরা আমাদের যথেষ্ট দাপুটে ফুটবল খেলেই হারিয়েছিল। ট্রফি জিততে গেলে পুরো দলটাকেই লাগে। নির্দিষ্ট ১১-১২ জনে কোনও দলকে ট্রফি জেতাতে পারে না। এই ম্যাচে দুই দলের সামনেই নিজেদের প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ। আমরা সেই চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি। আগে কী হয়েছে, সে সব নিয়ে ভেবে নিজেদের চাপে না ফেলাই ভাল। আমাদের বর্তমানেই মনোনিবেশ করতে হবে। তাই কালকের ম্যাচ নিয়েই শুধু ভাবছি”।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে ওডিশা দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে। এএফসি কাপে মাজিয়াকে পরপর দুই ম্যাচে হারানো ছাড়াও আইএসএলে চার দিনের ব্যবধানে ঘরের মাঠে বেঙ্গালুরু এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কেও হারায় তারা। ফলে তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট উচ্চ ধারণা পোষণ করে ফেরান্দো বলেন, “ওরা সম্প্রতি খুবই ভাল ফল করছে। ভাল ফুটবল খেলে পরপর চারটে ম্যাচে জিতেছে। প্রথম ম্যাচের চেয়ে ওদের ড্রেসিংরুমের পরিবেশ অনেক বদলে গিয়েছে। ওরা দ্বিতীয়ার্ধে খেলার ফল বদলে দিচ্ছে। এর অর্থ, ওদের পরিকল্পনা, সিস্টেমের প্রতি ওদের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তাই এই ম্যাচটা সম্পুর্ণ আলাদা। আমাদের কাছে বেশ কঠিন ম্যাচ। ওদের হারাতে গেলে আমাদের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে”।
সেপ্টেম্বরে প্রথম লেগে গত মরশুমের সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন ওডিশা এফসি-কে ৪-০-য় হারায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। সারা ম্যাচে রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে সেই ম্যাচ জিতে নেয় কলকাতার দল। প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পরে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দলকে এগিয়ে দেন সহাল আব্দুল সামাদ। অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ব্যবধান বাড়ান ৬৯ মিনিটে। এর দশ মিনিট পরে তৃতীয় গোল করেন পরিবর্ত হিসেবে নামা লিস্টন কোলাসো এবং ফের পেট্রাটস চতুর্থ গোলটি করেন ৮৩ মিনিটের মাথায়। সে দিন পাঁচ বিদেশিকে প্রথম এগারোয় রেখে দল নামিয়েছিলেন সবুজ-মেরুন কোচ। রক্ষণে ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তে, মাঝখানে হুগো বুমৌস ও আক্রমণে আরমান্দো সাদিকু ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।
চ্যালেঞ্জ কামিংসের
কিন্তু এই ম্যাচে পেট্রাটসকে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে জানা গিয়েছে মোহনবাগান শিবির সূত্রে। ফলে গোল করার প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে জেসন কামিংসকে। কিন্তু তিনি ধারাবাহিক ভাবে গোল পাচ্ছেন না। এএফসি কাপে অক্টোবরে মাজিয়ার বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেছিলেন তিনি। তার আগে বাছাই পর্বের প্লে অফে দুই ম্যাচে দুটি গোল করেন। ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে একটি করে গোল করেন কামিংস। আইএসএলে এ পর্যন্ত তিনটি ম্যাচে দুটি গোল করেছেন। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে চোটের জন্য খেলতে পারেননি। বসুন্ধরা কিংসের বিরুদ্ধে কোনও ম্যাচেই গোল করতে পারেননি, তবে ঘরের মাঠে একটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন।
এ বার গোলের জন্য সেই কামিংসের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন মোহনবাগান সমর্থকেরা। সোমবার সাংবাদিকদের কামিংস বলেন, “দিমি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। অনেকগুলো গোলও করেছে আমাদের হয়ে। ও না খেলতে পারলে আমাদের সেই দায়িত্ব নিতেই হবে। আমরা দীর্ঘ ছুটির পর এই ম্যাচটা খেলতে নামছি। তার ওপর ঘরের মাঠে সমর্থকদের পাব। আমাদের সবাই কালকের ম্যাচের জন্য তৈরি। ভাল একটা ম্যাচের অপেক্ষায় রয়েছি”।
ঘরের মাঠে নিজেদের সমর্থকদের সামনে কতটা উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামতে পারবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট, সোমবার সন্ধ্যার আগে জানার উপায় নেই। তবে ওডিশার কোচের অনুমান, “আমাদের চেয়ে ওরাই বেশি চাপে থাকবে। কারণ, ওরা ঘরের মাঠে খেলছে। প্রত্যাশার চাপ থাকবেই। তা ছাড়া ওরা এএফসি কাপে আমাদের চেয়ে ভাল জায়গায়। সেই জায়গা ধরে রাখার চাপও রয়েছে থাকবে ওপর”। কামিংস অবশ্য বলছেন চাপের মুখে ভাল খেলার অভ্যাস তাঁদের আছে। শেষ পর্যন্ত সোমবার যুবভারতীতে কারা এই টুর্নামেন্টের নিজেদের টিকিয়ে রাখার পরীক্ষায় পাস করতে পারবে, সেটাই এই ম্যাচের সবচেয়ে বড় আকর্ষণের বিষয়।
এএফসি কাপ, ২০২৩-২৪ গ্রুপ লিগ
ম্যাচ- মোহনবাগান এসজি বনাম ওডিশা এফসি
ভেনু- বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, কলকাতা
কিক অফ- ২৭ নভেম্বর, সন্ধ্যা ৭.৩০
সম্প্রচার- ফ্যানকোড অ্যাপ