এএফসি কাপ: রয় কৃষ্ণার ওডিশাকে হারিয়ে আশিককে খোয়ানোর হতাশা কাটাতে চায় সবুজ-মেরুন শিবির
গতবারের আইএসএল কাপ চ্যাম্পিয়নদের সামনে এ বার যে শুধু সেই খেতাব ধরে রাখাই লক্ষ্য, তা নয়। এএফসি কাপ জিতে নতুন নজির তৈরি করার প্রকল্পও হাতে নিয়ে এই মরশুমে অভিযান শুরু করেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। নাম যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে দলের খোলনলচেও।
গতবারের আইএসএল কাপ চ্যাম্পিয়নদের সামনে এ বার যে শুধু সেই খেতাব ধরে রাখাই লক্ষ্য, তা নয়। এএফসি কাপ জিতে নতুন নজির তৈরি করার প্রকল্পও হাতে নিয়ে এই মরশুমে অভিযান শুরু করেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। নাম যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে দলের খোলনলচেও। এএফসি কাপের কঠিন লড়াইয়ে সফল হতে দেশ, বিদেশের এক ঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়েছে তারা। সেই দল নিয়েই মঙ্গলবার এএফসি কাপের আসল অভিযান শুরু করতে চলেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী।
গত বছর সেপ্টেম্বরে এএফসি কাপের ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে কুয়ালালামপুর এফসি-র কাছে ১-৩-এ হেরেছিল তৎকালীন এটিকে মোহনবাগান। ৯০ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর ফারদিন আলি মোল্লার গোলে সমতা আনে তারা। কিন্তু স্টপেজ টাইমে পরপর দু’গোল খেয়ে ম্যাচ হেরে যায়।
গতবার ফাইনালের মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে আসার পরে এ মরশুমে সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এএফসি কাপ। তাই এ বছর ক্লাবের সঙ্গে নতুন চুক্তি করার পরই স্প্যানিশ কোচ হুয়ান ফেরান্দো বলে দেন, “আইএসএলে এ বারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য থাকবে এএফসি কাপে ভাল ফল করা”।
এ বার সেই ভাল ফল করার লক্ষ্যেই যাত্রা শুরু করেছে ফেরান্দো-বাহিনী। প্রাথমিক পর্বে ভূটানের পারো এফসি ও নেপালের মাচিন্দ্রা এফসি-কে হারানোর পরে দেখা হয় ঢাকার আবাহনীর সঙ্গে। ঘরের মাঠে সেই ম্যাচে ভূটানের পারো এফসি-কে ৩-২-এ হারিয়ে মোহনবাগান এসজি-র মুখোমুখি হয় নেপালের মাচিন্দ্রা এফসি। সেই ম্যাচেও জিতে ঢাকার আবাহনী লিমিটেডের বিরুদ্ধে ফের নামে কলকাতার দল। গত মাসে আবাহনীকে ফের ৩-১-এ হারিয়ে অবশেষে গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে মোহনবাগান এসজি।
এই গ্রুপে তাদের সঙ্গে রয়েছে সুপার কাপ ২০২৩ চ্যাম্পিয়ন ওডিশা এফসি, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস এবং মলদ্বীপের এফএ কাপ ও প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন মাজিয়া এসআরসি। মঙ্গলবার ওডিশার বিরুদ্ধে তাদের মাঠে বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়ার পালা।
কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে সবুজ-মেরুন
এই প্রথম এএফসি কাপে অংশ নেওয়া ওডিশা এফসি এ বার কোচ হিসেবে নিয়ে এসেছে এফসি গোয়া ও মুম্বই সিটি এফসি-র প্রাক্তন কোচ সের্খিও লোবেরাকে। তিনি কলিঙ্গ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরে নিয়ে আসেন তাঁর পছন্দের এক ঝাঁক ফুটবলারকে, যারা যে কোনও দলকে ম্যাচ জেতাতে পারে। এ রকম দলের বিরুদ্ধে যে মোহনবাগান এসজি-র কাজটা মোটেই সহজ হবে না তা স্বীকারই করে নিয়েছেন সবুজ-মেরুন বাহিনীর হেড কোচ হুয়ান ফেরান্দো।
সবুজ-মেরুন কোচ ফেরান্দো সোমবার ভুবনেশ্বরে সাংবাদিকদের বলেন, “খুবই কঠিন ম্যাচ হবে। ওদের দলটা খুব ভাল। আমরা তার জন্য প্রস্তুতও। ফোকাসড রয়েছি। ডুরান্ড কাপের সাফল্য এখন অতীত। এটা নতুন টুর্নামেন্ট। বর্তমান আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন শুধু এএফসি কাপের ম্যাচ নিয়েই ভাবছি”।
আশিক কুরুনিয়ান গুরুতর চোট পেয়ে সম্ভবত সারা মরশুমের জন্যই মাঠের বাইরে। অস্ত্রোপচার করতে হবে তাঁর। তিনি ছাড়া দলের সবাই ঠিক আছে বলে জানান ফেরান্দো। বলেন, “আশিকের চোটটা খুবই হতাশাজনক। আমরা খুব ভাল একটা দল গড়েছিলাম। কিন্তু এই চোটটা সেই দলটার ভারসাম্যের ক্ষতি করল। তবে ফুটবলে এটা হয়ই। আমাদের এখন আশিককে বাদ দিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে।
তবে দলের সবার পারফরম্যান্স ভাল। সবাই কালকের ম্যাচে খেলার জন্য মরিয়া। আমাদের দলের ছেলেদের উন্নতি করার মানসিকতা রয়েছে। এখন আমাদের স্বপ্ন হল এএফসি কাপ জেতা। সে জন্য আমরা গত মরশুম থেকে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছি”।
মরশুমের শুরুতেই চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে হেরে বড় ধাক্কা খেলেও সেই ধাক্কা সামলে নিজেদের চেনা ছন্দে ফিরে আসে গতবারের আইএসএল কাপ চ্যাম্পিয়নরা। ডার্বি হারের পরে টানা চারটি ম্যাচ জিতে ডুরান্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ২৩ বছর পর অর্জন করা এই ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টের খেতাব জেতার ফলে যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে মোহনবাগান শিবির, তা কাজে লাগিয়েই এএফসি কাপের প্রথম ম্যাচ জিততে চায় সবুজ-মেরুন শিবির। আশিক কুরুনিয়ানকে কার্যত গোটা মরশুমের জন্য হারানোর দুঃখ তারা ভুলতে চায় এই জয় দিয়ে।
ছয় বিদেশিই তৈরি
গত মরশুমে তাদের গোল করার জন্য বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকার ছিল না। ফলে গোলের সংখ্যাও বেশ কম হয়েছিল। এ বার সে জন্য গোল করার জন্য এক ঝাঁক আক্রমণাত্মক ফুটবলারকে দলে নিয়ে এসেছেন ফেরান্দোরা। গতবার দলে কোনও বিশেষজ্ঞ স্ট্রাইকার না থাকায় দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকেই আক্রমণের সিংহভাগ সামলাতে হয়েছিল। তিনি সেই ভূমিকায় সফলও হন। এ বার অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বকাপর জেসন কামিংস, আলবানিয়ার হয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা আরমান্দো সাদিকু, ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য সহাল আব্দুল সামাদ থাকায় পেট্রাটসকে অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে খেলতে দেখা যেতে পারে।
এমনকী তাঁর আসল ভূমিকা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও মাঠে দেখা যেতে পারে তাঁকে। এএফসি কাপের নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রথম দলে ছ’জন বিদেশি খেলতে পারেন। ফেরান্দোর হাতে যে ছয় বিদেশি রয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই হয়তো তিনি খেলাবেন। ইউস্তেকে রিজার্ভে রেখে তাঁকে পরে নামাতে পারেন। আশিক কুরুনিয়ানের বদলে মনবীর সিং বা লিস্টন কোলাসোকে প্রথম এগারোয় দেখা যেতে পারে।
অপর অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস ও অনিরুদ্ধ থাপা এবং দুই সাইড ব্যাক আশিস রাই ও শুভাশিস বোসও আক্রমণে যথেষ্ট সাহায্য করেন। ফলে দলের আক্রমণ বিভাগ এ বার বেশ শক্তিশালী। রক্ষণেও আনোয়ার আলি, ব্রেন্ডান হ্যামিল এবং হেক্টর ইউস্তে রয়েছেন। মঙ্গলবার ওডিশার বিরুদ্ধে কতটা আক্রমণাত্মক খেলবে তারা এবং রক্ষণ থেকে আক্রমণে ওঠা ও আক্রমণ থেকে কত দ্রুত নেমে আসতে পারবে তারা, বল নিজেদের দখলে কতটা রাখতে পারবে এবং গোলের সামনে কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করছে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা।
নতুন দল নিয়েও আশায় লোবেরা
দু’বার আইএসএল লিগশিল্ড ও একবার আইএসএল কাপ জয়ী কোচ লোবেরার তত্ত্বাবধানে ওডিশা এফসি বেশ আত্মবিশ্বাসী। প্রথমত, লোবেরার মতো কোচ পেয়েছে তারা। দ্বিতীয়ত সুপার কাপ জয়ের পর দলে বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলার সই করেছেন, যাঁরা এ বার এএফসি কাপ ও আইএসএলে দলকে যথেষ্ট শক্তি জোগাবেন। একসময় কলকাতা মাতিয়ে যাওয়া রয় কৃষ্ণা এ বার তাদের শিবিরে এবং মঙ্গলবার পুরনো ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করার জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠবেন। গোলকিপার অমরিন্দর সিংও ২০২১-২২ মরশুমে ছিলেন সবুজ-মেরুন বাহিনীতে।
লোবেরা যখন মুম্বই সিটি এফসি-র কোচ ছিলেন, তখনকার দলের আহমেদ জাহু ও মুর্তাদা ফল এ বার সই করেছেন ওডিশা দলে। এ ছাড়াও সাই গদার্ড, পুইতিয়া, জেরি লালরিনজুয়ালা, প্রাক্তন মোহনবাগানী লেনি রড্রিগেজও রয়েছেন দলে। আর গতবার দলের সর্বোচ্চ স্কোরার ও গত আইএসএলের গোল্ডেন বুটজয়ী ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার দিয়েগো মরিসিও তো রয়েছেনই। জাহু এবং মরিসিওর জুটি যেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তেমনই সেট পিসে যে কোনও সময়ে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারেন দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার মুর্তাদা ফল, ডিফেন্ডার হিসেবে যাঁর সবচেয়ে বেশি (১৭) গোল করার নজির রয়েছে আইএসএলে।
এএফসি কাপের চ্যালেঞ্জ নিয়ে লোবেরার বক্তব্য, “আমার কাছে সব টুর্নামেন্টই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এএফসি কাপ নিয়ে বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। আমাদের কাছে এই টুর্নামেন্ট খুবই আকর্ষর্ণীয়। কারণ, এই প্রতিযোগিতায় আমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করব। এই টুর্নামেন্টে ভাল কিছু করতে পারলে, সেটা হবে বড় প্রাপ্তি”। নিজের দল নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী লোবেরা বলেন, “এই চ্যালেঞ্জের জন্য আমাদের খেলোয়াড়রা তৈরি। আশা করি ঘরের মাঠে জয় দিয়ে এএফসি কাপ শুরু করব। তবে ছেলেদের অযথা চাপ নিতে বারণ করেছি। আমি চাই, ওরা কাল ফুটবলটা উপভোগ করুক”।
প্রতিপক্ষকে নিয়ে লোবেরা বলেন, “আমরা ভারতের অন্যতম সেরা দলের বিরুদ্ধে খেলতে চলেছি। ওদের দলে দুর্দান্ত ফুটবলাররা আছে। খুব ভাল ভাবে মরশুমটা শুরু করেছে ওরা। প্রত্যেক দলের প্রতিই আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। তবে কাউকেই ভয় পাই না। মাঠে নেমে লড়াই করার ক্ষমতা আছে আমাদের। মোহনবাগানের বিরুদ্ধেও লড়বে ছেলেরা। কোচ ফেরান্দোর কৌশল অবশ্যই খুব ভাল। আমরা একে অপরকে ভাল করে চিনিও। তবে ফুটবল কোচেদের নিয়ে হয় না। এখানে খেলোয়াড়রাই সব। যা করার ফুটবলাররাই করবে”।
এএফসি কাপ, ২০২৩-২৪ গ্রুপ লিগ
ম্যাচ- ওডিশা এফসি বনাম মোহনবাগান এসজি
ভেনু- কলিঙ্গ স্টেডিয়াম, ভুবনেশ্বর
কিক অফ- ১৯ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যা ৭.৩০
সম্প্রচার- ফ্যানকোড অ্যাপ