টানা দ্বিতীয়বার আইএসএলের লিগশিল্ড জিতে নতুন নজির গড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। গতবার লিগের শেষ ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে শিল্ড জিতে নিয়েছিল তারা। এ বার লিগের শেষ ম্যাচে তাদের মুখোমুখি হবে এফসি গোয়া, যারা এই মুহূর্তে লিগ শিল্ডের দৌড়ে সবুজ-মেরুন বাহিনীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

গতবারের মতো শেষ ম্যাচ পর্যন্ত শিল্ডজয়ের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে না চাইলে আসন্ন দুই ম্যাচে জিতে শিল্ডের দখল নিতে হবে তাদের এবং সেই শেষ দুই ধাপের প্রথমটি পেরোতে তারা নামবে শনিবার কেরালা ব্লাস্টার্সের ঘরের মাঠে। যেখানে প্রতিপক্ষ শুধু এগারোজন ফুটবলারই নন, গ্যালারিতে উপস্থিত হাজার চল্লিশ সমর্থকও।

গত পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জেতা ব্লাস্টার্স এখন সেরা ছয়ে নেই ঠিকই, কিন্তু তাদের সেরা ছয়ে থেকে লিগ শেষ করার সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সে জন্য তাদের শেষ কয়েকটি ম্যাচে জিততেই হবে। তাই শনিবার ঘরের মাঠে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠবে তারা।

কিন্তু মোহনবাগানকে হারানো এই মুহূর্তে যে কোনও দলের পক্ষেই কঠিন কাজ। গত তিনটি ম্যাচে টানা জয় পাওয়া এবং টানা আট ম্যাচে অপরাজিত সবুজ-মেরুন বাহিনী এখন শিল্ড জয়ের লক্ষ্যে ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছে। এই ঝড় থামানো ব্লাস্টার্সের পক্ষে মোটেই সোজা হবে না।

অদম্য সবুজ-মেরুন বাহিনী

যাঁরা ভাবছেন কোচির মাঠে উগ্র সমর্থকদের চিৎকারে স্নায়ুযুদ্ধে হেরে যেতে পারে কলকাতার দল, তাদের জানিয়ে রাখা ভাল, আইএসএলে নিজেদের মাঠে কখনও মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি কেরালা ব্লাস্টার্স। ২০২২-২৩ মরশুমের প্রথম লিগে মোহনবাগানের ৫-২-এ জেতা নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। সে বার দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের হ্যাটট্রিক সবুজ-মেরুন ব্রিগেডকে অদম্য করে তুলেছিল। এ বারও সেই মেজাজেই আছে তারা। যদিও পেট্রাটসের সেই ফর্ম এ মরশুমে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

গত সাতটি ম্যাচের মধ্যে ছ’টিতে গোল অক্ষত রাখা এবং পাঁচটিতে জেতা মোহনবাগানের শিল্ড জেতার জন্য প্রয়োজন আর মাত্র ছ’পয়েন্ট। শনিবারের ম্যাচ-সহ আর চারটি ম্যাচ বাকি তাদের। এই চার ম্যাচে ছয় পয়েন্ট পেলেই ফের লিগ শিল্ড হাতে তুলে নিতে পারবে বাগান-বাহিনী। তাই আপাতত তাদের লক্ষ্য সে দিকেই।

এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়েও চোট-আঘাতের সমস্যা পিছু ছাড়ছে না বাগান-বাহিনীর। চোটে কাবু সহাল আব্দুল সামাদ, আশিস রাই, অনিরুদ্ধ থাপা। তিন তারকার কেউই এই ম্যাচে মাঠে নামতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেরালা থেকেই উঠে আসা সহাল এই ম্যাচে খেলতে না পারলে, তা তাঁর পক্ষে যে খুবই হতাশাজনক হবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আর এক মালয়লি তারকা আশিক কুরুনিয়ান অবশ্যই সুযোগ পেলে এই ম্যাচে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

এ মরশুমে অবশ্য মোহনবাগান যতবার এমন সমস্যায় পড়েছে, ততবারই তাদের রিজার্ভ বেঞ্চ তাদের ভরসা জুগিয়েছে। ফলে আপাত ভাবে দুর্বল মনে হলেও সাফল্য তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। শনিবারও তেমনই ঘটবে, এমনই আশা মোহনবাগান কোচ হোসে মোলিনার। গত ম্যাচে কার্ড সমস্যার জন্য খেলতে পারেননি সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার টম অলড্রেজ ও মিডফিল্ডার আপুইয়া। সেই জায়গায় দীপেন্দু বিশ্বাস, সহাল আব্দুল সামাদ, দীপক টাঙরিরা ভালই খেলেছেন। এ বারও তাই অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলেই মনে করেন কোচ। শনিবারের ম্যাচে অলড্রেড, আপুইয়া মাঠে ফিরতে পারবেন ঠিকই। কিন্তু কার্ড সমস্যার জন্য খেলতে পারবেন না প্লে মেকার জর্জ স্টুয়ার্ট।

আক্রমণাত্মক হলুদ-ব্রিগেড

অন্য দিকে, এই ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্স হয়তো পাবে না তাদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য অ্যাটাকার নোয়া সাদাউইকে। চোটের কারণে তিনি আগামী দু’টি ম্যাচে নেই তিনি, যা ব্লাস্টার্সের কাছে এক বড় ধাক্কা। এ মরশুমে দলের ১২টি গোলে অবদান রেখেছেন তিনি। সাতটি গোল করেছেন ও পাঁচটি করিয়েছেন। তবে ব্লাস্টার্সের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড ও সর্বোচ্চ গোলদাতা ইয়েসুস জিমিনিজ, আদ্রিয়ান লুনা, কোয়ামে পেপরার আক্রমণ বিভাগ এই ম্যাচে মোহনবাগানকে চাপে রাখতে পারে। চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে দুরন্ত ফর্মে ছিলেন লুনা। সেই ম্যাচে জিমিনিজ (১১ গোল) ও পেপরা (৫) দু’টি গোল করেন। অপর গোলটি করেন তরুণ মিডিও কোরু সিং।

ডিসেম্বরে দলের হেড কোচ মাইকেল স্তাহরে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আপাতত দলের দায়িত্বে রয়েছেন অন্তর্বর্তী কোচ টিজি পুরুষোত্তমন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সাতটি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতে অপরাজিত থেকেছে ব্লাস্টার্স। তবে গত মাসে ইস্টবেঙ্গলের কাছে তাদের ১-২ হার সেরা ছয়ে পৌঁছনোর দৌড়ে তাদের কিছুটা পিছিয়ে দেয়। যার ফলে এখনও তারা ছয়ের বাইরেই রয়ে গিয়েছে।

তাদের মাঝমাঠ আর আক্রমণ নিয়ে তেমন চিন্তায় নেই মোহনবাগান শিবির। দুই বিভাগেই সেরা খেলোয়াড়রা প্রতি ম্যাচে রীতিমতো দাপুটে পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন। তবে গোলের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু কোচ মনে করেন, গোলের সুযোগ বেশি তৈরি হওয়াটা বেশি জরুরি। তা হলে গোলও আসবে।

সুযোগ অনেক, গোল কম

এ পর্যন্ত ২২২টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। গোল পেয়েছে ৩৯টি। অর্থাৎ মাত্র ১৭% গোলের সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পেরেছে। এই পরিসংখ্যানে উন্নতি না করলে লিগ পর্বের শেষ পর্যায়ে সমস্যায় পড়তে পারে তারা।

আসলে তাদের স্ট্রাইকাররা নিয়মিত গোল করতে পারছেন না। জেসন কামিংস, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস— কেউই গোলের মধ্যে নেই। স্বস্তির খবর, চার ম্যাচে গোলহীন থাকার পর জেমি ম্যাকলারেন গত ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেন। তার আগে পর্যন্ত লিগের সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন না তিনি। এখন আট গোল নিয়ে আছেন আট নম্বরে। গত ছ’টি ম্যাচে জেসন কামিংসও গোলহীন। দিমিত্রিয়স পেট্রাটসও শেষ গোল করেছেন ২০ ডিসেম্বরের ম্যাচে। গত ম্যাচে তাঁকে মাঠেই নামাননি কোচ। তিনি অবশ্য আশাবাদী, স্ট্রাইকাররা গোলে ফিরবেন।

শনিবার ঘরের মাঠে মোহনবাগানকে প্রথমবার হারানোর জন্য নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠবে। প্রথম লিগের মতো তাদের দ্বিতীয় লিগের দ্বৈরথও জমে উঠতে পারে। ডিসেম্বরে যুবভারতীতে শেষ দশ মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল করে ব্লাস্টার্সের মুখ থেকে গ্রাস ছিনিয়ে নেয় গতবারের লিগশিল্ডজয়ীরা। সে দিন ৩৩ মিনিটের মাথায় জেমি ম্যাকলারেনের গোলে এগিয়ে যায় তারা। বিরতির পরই ৫১ মিনিটের মাথায় সমতা আনেন ইয়েসুস জিমিনিজ। ৭৭ মিনিটে ডিফেন্ডার মিলোস দ্রিনচিচের গোলে জয়ের কাছাকাছি চলে যায় ব্লাস্টার্স। কিন্তু ৮৬ ও ৯৫ মিনিটের মাথায় পরপর গোল করে দলকে আট নম্বর জয় এনে দেন যথাক্রমে কামিংস ও আলবার্তো রড্রিগেজ।

সে রকমই আরও এক লড়াই দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন দুই ফুটবলপাগল রাজ্যের সমর্থকেরা। কারণ, লড়াইটা শুধু দুই দলের নয়, তাদের সমর্থকদেরও। যুদ্ধ শুধু ফুটবলের নয়, ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা, আবেগেরও।

পরিসংখ্যান তত্ত্ব

গত চার ম্যাচে প্রতিপক্ষকে কোনও গোল করতে দেয়নি মোহনবাগান। শনিবারও যদি একই ঘটনা ঘটে, তা হলে এই প্রথম আইএসএলে টানা পাঁচটি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখবে তারা। শেষ ম্যাচেও (নর্থইস্টের বিরুদ্ধে) গোল করতে পারেনি ব্লাস্টার্স। শনিবারের ম্যাচেও গোল করতে না পারলে ২০১৯-এর পর এই প্রথম তারা টানা দুই ম্যাচে গোল করতে পারবে না।

চলতি আইএসএলে ২৩৬ বার ফাউল করেছেন মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা এবং ৫৪ বার হলুদ কার্ড দেখেছেন তাদের খেলোয়াড়রা। দুই বিভাগেই তারা সর্বোচ্চ। তবে এ মরশুমে তারাই একমাত্র দল, যারা এখনও কোনও লাল কার্ড দেখেনি। তাদের দলে এমন পাঁচজন ফুটবলার আছেন, যাঁরা চলতি লিগে চার বা তার বেশি গোল করেছেন। আর কোনও দলে চার বা তার বেশি গোল করা এত খেলোয়াড় নেই। শনিবার লিস্টন কোলাসো গোল পেলে এই সংখ্যাটা হবে ছয়, যা হবে সর্বোচ্চ।

ঘরের মাঠে আজ পর্যন্ত কখনও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে হারাতে পারেনি কেরালা ব্লাস্টার্স। তাই শনিবার তাদের সামনে সবুজ-মেরুন বাহিনীকে ঘরের মাঠে প্রথম হারানোর সুযোগ। আইএসএলে আর কোনও দলের বিরুদ্ধে এমন নজির নেই ব্লাস্টার্সের। ব্লাস্টার্সের হয়ে প্রথম মরশুমেই জেসুস জিমিনিজ এ পর্যন্ত ১২টি গোলে অবদান রেখেছেন। ১১টি করেছেন ও একটি করিয়েছেন। শনিবার একটি গোলে অবদান রাখলে তিনি আদ্রিয়ান লুনা ও দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের নজির ছুঁয়ে ফেলবেন।

দ্বৈরথের ইতিহাস

ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট ন’বার। তার মধ্যে সাতবারই জিতেছে কলকাতার দল। একটি ম্যাচ ড্র হয়। কেরালা ব্লাস্টার্স গত মরশুমে প্রথম দেখায় প্রথম হারায় সবুজ-মেরুন বাহিনীকে। দুই দলের দ্বৈরথে ২৪ গোল করেছ মোহনবাগান ও ১৫ গোল করেছে ব্লাস্টার্স। ২০-২১ মরশুমে প্রথম ম্যাচে ১-০ ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৩-২-এ জেতে এটিকে মোহনবাগান। ২১-২২ মরশুমে প্রথমে ৪-২-এ জেতে সবুজ-মেরুন বাহিনী ও পরের বার ২-২ হয়। ২২-২৩ মরশুমের প্রথম লেগে ৫-২-এ জেতে কলকাতার দল। সেবার দিমিত্রিয়স পেট্রাটস হ্যাটট্রিক করেন। দ্বিতীয় লেগে ২-১-এ আবার জেতে কলকাতার দল। গত মরশুমে প্রথমে কলকাতায় এসে মোহনবাগানকে ১-০-য় হারিয়ে যায় ব্লাস্টার্স। পরে কোচিতে গিয়ে ৪-৩-এ জিতে বদলা নেয় গত বারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। এ বার প্রথম লিগে মোহনবাগান ৩-২-এ হারায় ব্লাস্টার্সকে।

ম্যাচ- কেরালা ব্লাস্টার্স বনাম মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট

ভেনু- জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, কোচি

সময়- ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.৩০

সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং- স্টার স্পোর্টস ৩- বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ, মালয়ালাম; জিওহটস্টার- বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ, মালয়ালাম