হায়দরাবাদ এফসি-তে যোগ দেওয়ার পরই নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন শৌভিক চক্রবর্তী। গতবারের চ্যাম্পিয়ন দলের এই বঙ্গ তারকা সে জন্য কৃতিত্ব দিচ্ছেন দলের কোচ মানুয়েল মার্কেজকে। শৌভিক মনে  করেন, হায়দরাবাদের দলে যোগ দিয়ে মার্কেজের হাতেই তাঁর ফুটবল কেরিয়ারে সাফল্যের ছোঁয়া লেগেছে।

এই প্রসঙ্গে শৌভিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের কোচ মার্কেজ তরুণ, উঠতি ফুটবলারদের কাছে থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারেন ঠিকই। কিন্তু উনি আমার মতো সিনিয়রদেরও যে ভাবে সাহায্য করেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। স্পোর্টসকিড়া ডট কম ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথাগুলি বলেন তিনি।

কোচের ভূয়ষী প্রশংসা করে ৩১ বছর বয়সি শৌভিক বলেন, মানুষ হিসেবে উনি অসাধারণ। সব সময় দলের খেলোয়াড়দের পাশে থাকেন উনি। মাঠে সব সময় সিরিয়াস থাকেন। কিন্তু মাঠের বাইরে উনি সবসময় আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেন। আইএসএলের কোচেদের ওঁর মতো এত সুকৌশলী কোচ আমি বেশি দেখিনি

নিজের কেরিয়ারের সের সময় যে তাঁর হাতে পড়েই এসেছে শৌভিকের জীবনে, তা স্বীকার করে নিয়ে তিনি এই সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০১৫ থেকে আমাকে ফুল ব্যাক হিসেবে খেলিয়েছেন অন্য কোচেরা। কিন্তু মার্কেজই আমাকে মাঝমাঠে ফিরিয়ে দেন। তাই এই কৃতিত্ব সম্পুর্ণ ওঁকেই দেব

আসলে মিডফিল্ডার হিসেবেই ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন শৌভিক। কিন্তু হিরো আইএসএলে যোগ দেওয়ার পরে তিনি যে ক্লাবগুলির হয়ে খেলেন, তাদের বেশির ভাগ কোচেরা তাঁকে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলান। নিজেকে সেই জায়গায় মানিয়ে নিতে পারলেও পছন্দের জায়গায় খেলতে না পারার আফসোস রয়েই গিয়েছিল। হায়দরাবাদ এফসি-তে যোগ দেওয়ার পরে সেই আফসোস আর নেই তাঁর। মাঠেও তাই অনেক ভাল পারফরম্যান্স দিতে পারছেন তিনি। দলের প্রথম আইএসএল খেতাবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানও ছিল। 

গত মরশুমে ১৬টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। গোল না পেলেও দুটি গোলে সাহায্য করেছেন শৌভিক। হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগের আটটি মরশুমে খেলা হয়ে গেল তাঁর। ১০৪টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে। গত মরশুমে প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ২২টি করে পাস করেছেন তিনি। এর মধ্যে নিখুঁত পাস ছিল ৭৪.৬৫ শতাংশ, যা তার আগের মরশুমের (৭৩.৩৩) চেয়ে ভাল।    

বরাহনগরের এক ডাক্তার পরিবার থেকে যে এমন একজন ফুটবলার উঠে আসতে পারেন, যিনি দেশের এক নম্বর লিগে সাফল্যের সঙ্গে খেলে সারা দেশের ফুটবল মহলের নজর কেড়েছেন, তা কি কেউ কখনও ভাবতে পেরেছে? বোধহয় না। তবে সেই পরিবারের ছেলে শৌভিক চক্রবর্তী কিশোরবেলা থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন ফুটবল খেলেই বড় হবেন। তাই ১৪ বছর বয়স থেকে ফুটবলকেই নিজের পেশা হিসেবে নিয়ে নেন। আশ্চর্যজনক ভাবে পরিবারের সদস্যরা শৌভিককে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে কখনও বাধা দেননি। ফলস্বরূপ যা হয়েছে, তা তো আজ চোখের সামনেই রয়েছে।

ভারতীয় ফুটবলের এমন কোনও বড় টুর্নামেন্টের খেতাব নেই, যা তাঁর ট্রফির আলমারিতে শোভা পায় না। হিরো আইএসএল, হিরো আই লিগ থেকে শুরু করে ডুরান্ড কাপ, ফেডারেশন কাপ সবেতেই সাফল্য পেয়েছে তাঁর দল, উঠেছেন বিজয়ীর মঞ্চে।  

পরিবারের এই সমর্থনের প্রতি কৃতজ্ঞ শৌভিক বলেন, অন্যরকম কিছু করে বড় হতে চাইলে পরিবারের সহযোগিতা খুবই দরকার। শুরুর দিকে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল ঠিকই। তবে আমার বাবা বরাবর আমার পাশে থেকেছেন। উনি একজন ডাক্তার। কিন্তু আমাকে কখনও সেইদিকে যাওয়ার জন্য চাপ দেননি কখনও। পরিবারে আমাদের প্রজন্মের অন্যরাও পড়াশোনায় খুব ভাল। তা সত্ত্বেও আমাকে ফুটবল খেলতে কেউ বাধা দেয়নি

মোহনবাগান, দিল্লি ডায়নামোজ, জামশেদপুর এফসি, মুম্বই সিটি এফসি-র পর ২০২০-তে তিনি যোগ দেন হায়দরাবাদ এফসি-তে। ২০১১-য় মোহনবাগানের সিনিয়র দলে যোগ দেন তিনি। তার আগের পাঁচ বছর ফুটবলের তালিম নেন মোহনবাগান অ্যাকাডেমিতে। ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১৫ দলের হয়ে খেলতেন তিনি। পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ২০১১-র নভেম্বরে ডেম্পোর বিরুদ্ধে। ২০১৫-য় মোহনবাগানের আই লিগ জয়ী দলে ছিলেন তিনি। সেই জয় ছিল স্মরণীয়।

কিন্তু গত মরশুমে হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনাই এখন পর্যন্ত সেরা প্রাপ্তি বলে মনে করেন শৌভিক। বলেন, হিরো আইএসএল জয় খুবই স্পেশ্যাল ছিল। কারণ, বাংলার বাইরে এসে এটাই আমার প্রথম সাফল্য। কলকাতার ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হলে সবার নজরে আসা যায় ঠিকই। কিন্তু কমফর্ট জোনের বাইরে গিয়ে সফল হওয়াটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ

গত মরশুমের ফাইনালে নির্ধারিত সময়ে ১-১ হওয়ার পরে দুবারের রানার্স আপ কেরালা ব্লাস্টার্কে টাই ব্রেকারে ৩-১-এ হারায় নিজামের শহরের দল। চার বছর পরে নক-আউটে ওঠা কেরালা ব্লাস্টার্সকে তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়নশিপের দোরগোড়া থেকে ফিরে আসতে হয়। টাই ব্রেকারে তিন-তিনটি শট আটকে হায়দরাবাদের জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন হায়দরাবাদের গোয়ানিজ গোলকিপার লক্ষ্মীকান্ত কাট্টিমণি।

এই সাফল্যের কৃতিত্ব কোচ মার্কেজকে দিয়ে শৌভিক বলেন, দলের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর। কৌশল তৈরিতে অসাধারণ। বিরতিতে ওঁর বলা কথাগুলোই আমাদের উদ্দীপ্ত করে তুলত। অনুশীলনে সেট পিস রপ্ত করার জন্য আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করিয়েছেন। এর ফল তাঁরা হাতে নাতে পেয়েছেন।

নিজের পারফরম্যান্সের উন্নতির জন্য শৌভিক শুধু কোচ নয়, ক্লাবের প্রতিও কৃতজ্ঞ। বলেন, ২০২০-র জানুয়ারিতে যখন আমি (মুম্বই সিটি এফসি থেকে) এই ক্লাবে যোগ দিই, তখন দল মোটেই ভাল পরিস্থিতিতে ছিল না। তা সত্ত্বেও আমার ওপর যথেষ্ট ভরসা করে আমার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাব দেন ক্লাব কর্তারা। সেই সময়ে আমার কাছে এটা ছিল বিশাল ব্যাপার। ২০২০-২১ মরশুমের মাঝামাঝি আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। সেই সময় দশটা ম্যাচে খেলতে পারিনি আমি। তা সত্ত্বেও ক্লাব কিন্তু সেই সময়ে সমানে আমার পাশেই ছিল। আইএসএলে আরও অনেক দলে খেলেছি। কিন্তু এত সাহায্য আর কোনও ক্লাব থেকে পাইনি। সে জন্যই কোচ মার্কেজ ও ক্লাব কর্তাদের কাছে আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব