এশিয়ান কাপ ২০২৩-এর যোগ্যতা অর্জন পর্বে গ্রুপ সেরার শিরোপা জিতে মূলপর্বে উঠল ভারত। মঙ্গলবার কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে হংকংকে ৪-০-য় হারিয়ে গ্রুপের এক নম্বরে হয়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে খেলার টিকিট জিতে নিল অপরাজিত ভারত। এই নিয়ে টানা তৃতীয় জয় তাঁদের। এবং এই নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ভারত এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলবে। যা এর আগে কখনও হয়নি এবং এই ঘটনা ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। ২০১৯-এও এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলেছিল ভারত।

এ দিন যুবভারতীর ভরা গ্যালারির সামনে আক্রমণের ঝড় বইয়ে দেন সুনীল ছেত্রীরা। গোলের ফোয়ারাও ছোটান। যত সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, তার অর্ধেকও যদি কাজে লাগাতে পারতেন ভারতীয়রা, তা হলে হয়তো আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারত ভারত।  

এ দিন প্রথম মিনিটেই গোল করে ভারতকে এগিয়ে দেন তরুণ ডিফেন্ডার আনোয়ার আলি। প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে ব্যবধান বাড়ান সুনীল ছেত্রী। ৮৫ মিনিটের মাথায় মনবীর সিং ও ম্যাচের শেষে বাড়তি সময়ে গোল করে দলের জয় সুনিশ্চিত করেন ইশান পন্ডিতা।

এই তরুণ ব্রিগেডকে নিয়ে সুনীলের এমন অভিযান এক বছর পরেও দেখা যাবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে ভারতের এই দাপুটে সাফল্য যে এ দেশের ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

এ দিন ৪-৪-২-এ দল সাজায় ভারত। গত ম্যাচের দল থেকে এটিকে মোহনবাগানের দুই তারকা ফরোয়ার্ড লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংকে বাইরে রেখে প্রথম এগারো বাছেন ভারতের কোচ ইগর স্টিমাচ। গত ম্যাচে শেষ মুহূর্তে গোল করে যিনি দলকে জেতান, সেই সহাল আব্দুল সামাদ এবং উদান্ত সিংকে শুরু থেকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

এই ম্যাচে নামার আগেই অবশ্য লক্ষ্যপূরণ হয়ে গিয়েছিল সুনীলদের। দুপুরে বাছাই পর্বের গ্রুপ ‘বি’-তে প্যালেস্টাইন ৪-০-য় ফিলিপিন্সকে হারানোয় এ দিন মাঠে নামার আগেই গ্রুপের দু’নম্বর দল হিসেবে এশিয়ান কাপ ২০২৩-এর মূলপর্বে ভারতের খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু গ্রুপের দ্বিতীয় দল হিসেবে যে মূলপর্বে উঠতে একেবারেই রাজি নয় তারা, তাদের খিদে যে আরও বেশি, সেটাই বুঝিয়ে দেয় ভারতীয় ফুটবলের নতুন প্রজন্ম। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে টানা দুই ম্যাচ জেতা হংকংকে রীতিমতো কোণঠাসা করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভারত।

প্রথম মিনিটেই ভারত গোল পেয়ে যাওয়ায় হংকং আরও চাপে পড়ে যায়। বাঁ দিক থেকে রোশন নাওরেমের ক্রস পেয়ে বক্সের মধ্যে থেকে আনোয়ার আলি সোজা গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দিতেই যুবভারতীর আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে দর্শকদের উল্লাসে (১-০)। বক্সের মধ্যে জনা পাঁচেক ডিফেন্ডার থাকলেও আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যান তাঁরা।

এর পর থেকেই ঘন ঘন দুই উইং দিয়ে আক্রমণ শানায় ভারত। আশিক কুরুনিয়ান ও উদান্ত সিংকে এ দিন ইনভার্টেড উইঙ্গারের ভূমিকায় দেখা যায়। তাঁরা দুই দিক দিয়েই বারবার বিপজ্জনক ভাবে আক্রমণে উঠতে শুরু করেন। তবে নিজেদের গোলের মুখে বারবার ভিড় বাড়িয়ে ভারতের আক্রমণ রুখে দেয় হংকংয়ের রক্ষণ।

১৭ মিনিটের মাথায় ব্যবধান দ্বিগুন করার জায়গায় চলে গিয়েছিল ভারত। ডানদিক থেকে আশিকের ক্রস থেকে গোল করার জন্য একেবারে সামনে চলে যান সুনীল ছেত্রী। কিন্তু তিনি বলের নাগাল পাওয়ার আগেই গোলকিপার ইয়াপ হুং তা বিপদসীমার বাইরে বার করে দেন। সারা ম্যাচেই যথেষ্ট চাপে ছিলেন হংকংয়ের গোলপ্রহরী।

২৭ মিনিটের মাথায় ফের ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পায় ভারত। এ বার ডানদিক দিয়ে বল নিয়ে উঠে বক্সের মধ্যে সুনীলের উদ্দেশ্যে ক্রস দেন রোশন। সুনীল সেই ক্রস ধরতে না পারায় বল তাঁর পিছনে আশিকের কাছে গিয়ে পৌঁছয় এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে গোলে জোরালো শট নেন, যা গোলকিপারের হাতে ও বারে লিগে ফিরে আসে সহালের কাছে। কিন্তু বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন গত ম্যাচের গোলদাতা।

খেলা ৩০ মিনিট গড়ানোর পর থেকে হংকংও পাল্টা চাপ দেওয়া শুরু করে এবং ভারতের রক্ষণকে ব্যস্ত রাখা শুরু করে। তবে স্টিমাচ-বাহিনীর ডিফেন্ডাররাও তৈরি ছিলেন প্রকিপক্ষকে আটকানোর জন্য। আকাশ মিশ্র যেমন আক্রমণে উঠছিলেন, তেমনই রক্ষণেও ছিলেন সদা তৎপর। সন্দেশ, আনোয়ার, রোশনরাও তাঁদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করেন। ম্যাচের বয়স যখন ৩৫ মিনিট, তখন শুরু হয় বৃষ্টি। গোলের বৃষ্টিও যে হতে পারে, তার ইঙ্গিতও তখন পাওয়া যাচ্ছিল।

৪০ মিনিটের মাথায় প্রায় গোল শোধ করে দিচ্ছিল হংকং। ডান দিক থেকে উঠে আসা জু ইংঝির ক্রস থেকে গোলমুখী হেড করেন তাদের সেরা গোলদাতা ম্যাথু এলিয়ট অর, যা গোলকিপার গুরপ্রীতের হাতে লেগে বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

তবে প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে হংকংয়ের লড়াই আরও কঠিন করে তোলে ভারতের দ্বিতীয় গোল, যা আসে সুনীল ছেত্রীর পা থেকে। এই গোলের অর্ধেক কৃতিত্ব অবশ্য দাবি করতেই পারেন জিকসন সিং। হংকংয়ের বক্সের অনেকটা দূর থেকে বক্সের মধ্যে ডানদিকে প্রায় আনমার্কড সুনীলকে দেখে নিয়ে হাওয়ায় বল ভাসিয়ে দেন জিকসন। নিখুঁত ও মাপা ছিল তাঁর সেই শট। উড়ে আসা বল ডান পায়ে রিসিভ করে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে বাঁ পায়ে গোলে ঢুকিয়ে দেন ভারত অধিনায়ক (২-০)।

এই নিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৮৪তম গোলটি করে ফেললেন সুনীল। বিশ্বের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় তিনি উঠে এলেন পাঁচ নম্বরে, যেখানে রয়েছেন হাঙ্গেরির কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাসও। বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে তিনি তিন নম্বরে, লিওনেল মেসির (৮৬) ঠিক পিছনেই।

দ্বিতীয়ার্ধে সুরেশের জায়গায় গ্ল্যান মার্টিন্সকে নামান স্টিমাচ। গোলের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই এই পরিবর্তন। ভারতের আক্রমণ যথারীতি ধারালো হয়ে ওঠে দ্বিতীয়ার্ধেও। ৫০ মিনিটের মাথায় মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে সুনীল একাই উঠে যান বিপক্ষের গোলের দিকে, যেখানে সামনে গোলকিপার ইয়াপ ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। বক্সে ঢুকে তাঁর মাথার ওপর দিয়ে গোলে বল পাঠানোর চেষ্টা করলেও সুনীলের প্রায় অবধারিত গোল বানচাল করে দেন ইয়াপ।

সুনীলের এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে হংকং এবং আক্রমণের ধার বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। ৫৫ থেকে ৫৭ মিনিটের মধ্যে তাদের পরপর জোড়া আক্রমণ ব্যর্থ করেন গুরপ্রীত ও রোশন। পুরোপুরি সুস্থ না লাগলেও সন্দেশ এ দিন নিজেকে উজাড় করে দেন নিজেদের গোলের সামনে। আনোয়ার আলি তাঁকে সমানে সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন এবং রক্ষণের দুই দিকে রোশন ও আকাশও হংকংয়ের ফরোয়ার্ডদের কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।  

আক্রমণে আরও ধার বাড়াতে শেষ আধ ঘণ্টার জন্য লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংকে নামান ভারতের কোচ। তুলে নেন উদান্ত ও সহালকে। কোলাসো মাঠে নামার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাঁ দিক দিয়ে উঠে গোলের সুযোগ তৈরি করেন ও ৬৫ মিনিটের মাথায় তাঁর পরিচিত ভঙ্গিতে কাট ইন করে বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলকিপারের হাতে বল জমা করে দেন। মনবীরও ম্যাচের শেষ দিকে আরও ধারালো হয়ে ওঠেন।  

সুনীল ছেত্রীকে এ দিন নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে তুলে নেন কোচ ও তাঁর জায়গায় নামান ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজকে। ৮০ মিনিটের মাথায় আশিকের জায়গায় নামেন ইশান পন্ডিতা। শেষ ১০ মিনিটে গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে হংকং এবং দুই উইং দিয়ে ঘনঘন আক্রমণে ওঠে তারা। ৮১ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক দিয়ে ওঠা ওং ওয়াই-এর কোমাকুনি শট বাঁচিয়ে দেন গুরপ্রীত।

এর আগে যতবার আক্রমণে ধার বাড়ানোর চেষ্টা করে হংকং, ততবারই প্রতি আক্রমণে তাদের বিপদে ফেলে দেয় ভারত। এ বারেও সেটাই হয়। ৮৪ মিনিটের মাথায় তৃতীয় গোল খায় হংকং। ডানদিক থেকে ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ যে লো ক্রস রাখেন, বক্সের মধ্যে সেই ক্রস থেকেই সোজা শটে বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেন মনবীর সিং (৩-০)। তার আগের মুহূর্তেই রোশনের ঠিক একই রকম ক্রসে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ভুল শুধরে এ বার সফল হন পঞ্জাবের তরুণ ফরোয়ার্ড। শুধু গোল করেননি তিনি, করিয়েছেনও।

স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে ফের যে গোল পায় ভারত, তা আসে মনবীরেরই অ্যাসিস্টে। এ বার ভারতের জয় একশো শতাংশ নিশ্চিত করে ফেলেন সুপার সাব ইশান পন্ডিতা। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ডানদিক দিয়ে উঠে বক্সের মধ্যে পন্ডিতার উদ্দেশ্যে নিখুঁত ক্রস দেন মনবীর। বিপক্ষের দুই ডিফেন্ডার মিলেও ইশানকে ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর গোড়ালির এক মোচড়ে বল ঢুকে পড়ে হংকংয়ের গোলে (৪-০)। এর পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি হংকং।     

ভারতীয় দল: গুরপ্রীত সিং সান্ধু (গোল), নাওরেম রোশন সিং, সন্দেশ ঝিঙ্গন, আনোয়ার আলি, আকাশ মিশ্র, জিকসন সিং, সুরেশ সিং ওয়াঙজাম (গ্ল্যান মার্টিন্স), সাহাল আব্দুল সামাদ (লিস্টন কোলাসো), উদান্ত সিং (মনবীর সিং), আশিক কুরুনিয়ান (ইশান পন্ডিতা), সুনীল ছেত্রী (অধি) (ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ)।