হার-জিত নিয়ে বেশি ভাবছেন না ভারতীয় দলের নয়া হেড কোচ মানোলো মার্কেজ। দলের ফুটবলারদেরও এই নিয়ে বেশি ভাবতে বারণও করছেন তিনি। বরং তাঁদের ভাল পারফরম্যান্সের ওপর বেশি মন দিতে বলছেন তিনি। সোমবার হায়দরাবাদের জিএমসি বালাযোগী স্টেডিয়ামে চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের শেষ ম্যাচে ভারত মুখোমুখি হবে বিশ্ব ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকা সিরিয়ার। সেই ম্যাচেই দলের কাছ থেকে ভাল ফুটবল চান মার্কেজ।

টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে মরিশাসের বিরুদ্ধে কোনও গোল খায়নি, প্রতিপক্ষকে গোল করতেও দেয়নি ভারত। মাত্র দু’দিনের অনুশীলনের পর এই ফল ইতিবাচকই ছিল। ত্রিদেশীয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ সে দিন গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু করেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতেরা। কিন্তু মরিশাসের চেয়ে সিরিয়া যে অনেক শক্তিশালী, তা গত শুক্রবার তাদের মধ্যে হওয়া ম্যাচেই বোঝা গিয়েছে, যেখানে সিরিয়া ২-০ গোলে জেতে।

টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে তাই জেতার তাগিদ নেই ভারতীয় কোচের। কিন্তু ভাল ফুটবল খেলার তাগিদ অবশ্যই রয়েছে। এই ম্যাচই কার্যত টুর্নামেন্টের ফাইনাল। যে দল জিতবে, তারা তো চ্যাম্পিয়ন হবেই, তবে ড্র করলেও খেতাব জয় করতে পারবে বিশ্বের ৯৩ নম্বর দলটি।

গত বছর জুনে ফিফা ক্রমতালিকায় তাদের চেয়ে দু’ধাপ এগিয়ে থাকা লেবাননকে ফাইনালে ২-০-য় হারিয়ে চার-দেশীয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল টুর্নামেন্টের খেতাব জিতে নেয় ভারত। ৪৬ বছর পরে লেবাননকে হারায় তারা। ফাইনালে প্রতিপক্ষকে কার্যত ছাড়খাড় করে দিয়ে দলকে কাপ জেতান দুই ‘ছ’। সুনীল ছেত্রী ও লালিয়ানজুয়ালা ছাংতের গোলে ভারত এই খেতাব অর্জন করে। এ বারও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবে কি না তারা, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

তবে খেতাব জয় হোক বা না হোক, ভাল ফুটবল খেলতে চান ভারতীয় কোচ। রবিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “দুই দলের কাছেই এটি কঠিন ম্যাচ। যে দল জিতবে, তারাই ট্রফি জিতবে। আমরা ভাল ফুটবল খেলে খেতাব জয়ের আশা রাখি। তবে আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, খেতাব জয় নাকি ভাল ফুটবল খেলা, তা হলে আমি দ্বিতীয়টাই বেছে নেব”।

কেন এ কথা বলছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে কোচ বলেন, “যে করেই হোক, সে হাত দিয়ে গোল করে হলেও ১-০-য় জিততে চাই না আমি। আমি চাই দলের ছেলেরা আমাদের পরিকল্পনা ও আইডিয়া বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী ভাল খেলুক। জেতা বা হারাই সবচেয়ে বড় কথা নয়। একটা নির্দিষ্ট স্টাইল দলের খেলায় আনা দরকার এবং এখন আমাদের তাতেই মনোনিবেশ করতে হবে। জিতলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে ঠিকই। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসটাও আসা দরকার যে আমরা যে কোনও দলের বিরুদ্ধেই ভাল খেলতে পারি”।

দলের ডিফেন্ডার জয় গুপ্তাও কোচের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, “এই ম্যাচে জিতে চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে আমাদের কঠিন লড়াই করতে হবে ঠিকই। কিন্তু কোচ আমাদের কাছ থেকে যা চান, তার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়াই এই মুহূর্তে আমাদের ফোকাস। আমাদের সাজঘরের পরিবেশ খুবই ইতিবাচক। মানোলোকে কোচ করে নিয়ে আসার জন্য ফেডারেশনকে ধন্যবাদ। ওঁর ওপর আমাদের যথেষ্ট আস্থা আছে। উনি যে রকম ভাবে এগোতে বলছেন, আমরা সে ভাবেই এগোতে বদ্ধপরিকর”।

গত ম্যাচের রিপোর্ট কার্ড অনুযায়ী, প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়েই ছিল ভারত। তাদের বল পজেশন ছিল ৬৫ শতাংশ। কিন্তু সারা ম্যাচে দশটি শটের মধ্যে মাত্র একটি গোলের লক্ষ্যে রাখতে পেরেছিলেন মনবীর সিংরা। যদিও মরিশাসও একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি। ভারতের মতো সমস্যা তাদেরও ছিল, যা সিরিয়ার আছে বলে মনে হয় না। গোলের সুযোগ পেলে তারা তা কাজে লাগিয়ে নেবে।

তবে ভারতীয় ফুটবলের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির সঙ্গে তাদের ফুটবলেরও মিল আছে। কোরিয়া ও জাপানের কাছে হেরে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে উঠতে না পারায় হেক্টর কুপারকে কোচের পদ থেকে সরে যেতে বলা হয়। তাঁর বিদায়ের পর স্প্যানিশ কোচ হোসে লানাকে নিয়ে আসে সিরিয়ার ফুটবল সংস্থা। ২২ অগাস্টই তিনি দলের দায়িত্ব নেন এবং ভারতে পাড়ি দেন এক সপ্তাহ পরই।

অনেকের মনে থাকতে পারে, জানুয়ারিতে এই সিরিয়ার কাছে এক গোলে হেরেই এএফসি এশিয়ান কাপ থেকে ছিটকে যায় ভারত। ওমর খ্রিবিনের ৭৬ মিনিটের গোলে সুনীল ছেত্রীদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেই সিরিয়াকে হারিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিততে পারলে মধুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে ঠিকই। কিন্তু ভারতীয় কোচ বা খেলোয়াড়রা বদলার মেজাজে আছেন বলে মনে হচ্ছে না।

তবে সেই তারকা স্ট্রাইকার খ্রিবিন এই দলে নেই। তাঁর জায়গায় দলের আক্রমণের ভার অভিজ্ঞ মাহমুদ আল মাওয়াস ও কলম্বিয়াজাত পাবলো সাবাগের ওপর। গত ম্যাচে গোলও করেন মাওয়াস। আইএসএলে খেলা এক সেন্টার ব্যাকও রয়েছেন সিরিয়ার এই দলে, মুম্বই সিটি এফসি-র থায়ের ক্রুমা। এশিয়ান কাপের দলের অনেকেই এই দলে নেই, রয়েছেন তরুণ প্রতিভারা। বিদেশী লিগে খেলা দালেহো ইরানদাস্ত, নোয়া শামৌন, আলহাম ওউসুরা দলের সঙ্গে এসেছেন ভারত সফরে। গত ম্যাচের গোলদাতা মুস্তাফা আব্দুল্লতিফও নজর কেড়েছেন। তাঁরাই সোমবার রাহুল ভেকেদের পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারেন।

গত ম্যাচে ভারতের গোলে ছিলেন অমরিন্দার সিং, যিনি ক্লিন শিট রেখে মাঠ ছাড়েন। এ দিন তিনিই থাকবেন, না শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বলে অভিজ্ঞ গুরপ্রীত সিংকে দায়িত্ব দেবেন কোচ, সেটা যেমন প্রশ্ন, তেমনই গত ম্যাচে পরিবর্ত হিসেবে নামা সহাল আব্দুল সামাদ ও নন্দকুমার শেকরকে প্রথম এগারোয় দেখা যাবে কি না। তা-ই যদি হয়, তা হলে অনিরুদ্ধ থাপা, লিস্টন কোলাসোকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে হতে পারে। রক্ষণে নিখিল পূজারী, শুভাশিস বোসরা প্রথম এগারোয় এলে আশিস রাই, জয় গুপ্তারা শুরু থেকে খেলার সুযোগ পাবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।

তবে ভারতীয় দলের গোলের সুযোগ তৈরি করেও তা কাজে লাগাতে না পারার পুরনো রোগ যে এখনও রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গত ম্যাচে দশটি শটের মধ্যে মাত্র একটি গোলের লক্ষ্যে রাখতে পেরেছিল ভারত। এই দিক থেকে আরও উন্নতি করতে হবে মানোলোর দলের অ্যাটাকারদের। প্রতিপক্ষের গোলের সামনে, তাদের রক্ষণের চাপে খেই হারিয়ে ফেলার সমস্যা না মেটাতে পারলে সাফল্যের মুখ দেখা কঠিন।

ভারত সম্পর্কে সিরিয়ার কোচ লানা বলেন, “নতুন কোচের তত্ত্বাবধানে ভারত যে ভাবে খেলছে, তা প্রশংসনীয়। দলটাতে গতি আছে। ওরা সংগঠিত ফুটবল খেলে। ওদের দখলে বল না থাকা অবস্থাতেও কেমন খেলতে হয়, তা ওরা জানে। প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করে ওরা। আর বল দখলে এলে ওরা গতি বাড়িয়ে দিয়ে দুই প্রান্ত দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। আমাদের পক্ষে ম্যাচটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এই ম্যাচে আমাদের লক্ষ্য গত ম্যাচের চেয়ে ভাল খেলা”।

সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে ভারত বনাম সিরিয়া ম্যাচ সরাসরি দেখা যাবে স্পোর্টস ১৮ ৩ টিভি চ্যানেলে ও জিও সিনেমা অ্যাপে।