কঠিন দ্বৈত দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ নিতে আমি প্রস্তুত: ভারতের হেড কোচ মানোলো মার্কেজ
‘ভারতীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে আমি বসে দীর্ঘ আলোচনা করতে পারি। তাদের পরিবার নিয়েও কথা বলি’।
একই সঙ্গে ক্লাব ও জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করাটা যে মোটেই সোজা কাজ নয়, তা স্বীকার করেই নিয়েছেন ভারতীয় দল তথা এফসি গোয়ার হেড কোচ মানোলো মার্কেজ। তাঁর কাছে এটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে পাশাপাশি তিনি দুই দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসীও।
সম্প্রতি ভারতীয় দলের হেড কোচের পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয় ক্রোয়েশিয়ার ইগর স্টিমাচকে। জানুয়ারিতে এএফসি এশিয়ান কাপে ব্যর্থতার পর বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ দুই ম্যাচে কুয়েত ও কাতারের কাছে হেরে ছিটকে যায় ভারতীয় দল। তার পরেই স্টিমাচকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফেডারেশন।
তাঁর জায়গায় এফসি গোয়ার স্প্যানিশ কোচ মানোলো মার্কেজকে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ)। একই সঙ্গে ২০২৪-২৫ মরশুমে তিনি এফসি গোয়ার দায়িত্বও সামলাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছে ফেডারেশন। এই মরশুমের পর মার্কেজ ভারতীয় দলের পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন বলে জানানো হয়। অর্থাৎ চলতি মরশুমে তাঁকে দ্বিগুন দায়িত্ব পালন করতে হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তিনি? দুই দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার পরিকল্পনা কী ভাবে করেছেন, তা জানাতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ বলেন, “এখানে পেশাদার হওয়া জরুরি। এই প্রথম যে কেউ এটা করছে, তা নয়। সঠিক ভাবে সময় দিতে হবে এবং আমার জন্য এটা কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। যখন আইএসএলে বিরতি থাকবে, তখন আমি জাতীয় দলের সঙ্গে থাকব। এটা আমার কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তবে আমি এ ব্যাপারে উৎসাহী”।
এই প্রসঙ্গে মার্কেজ আরও বলেন, “আমি জানি যে, প্রশংসা এবং সমালোচনা দুইই পাব। এমনকী, আমি যদি একটা দল বেছে নিই, আমার পাশের ব্যক্তি আমার সঙ্গে সব সময় একমত নাও হতে পারে। নিশ্চিত করতে হবে, আমরা যেন সবাই একই পথে হাঁটি। আমরা এফসি গোয়ায় প্রাক-মরশুম শুরু করেছি এবং অবশ্যই আমাদের ফোকাস ঠিক রয়েছে। তবে আমি ডুরান্ড কাপে সব দল এবং জাতীয় দলের প্রতিও নজর রাখছি”। ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলি বলেন ভারতীয় দলের স্প্যনিশ কোচ।
দ্বৈত দায়িত্ব পালন করা যে বেশ কঠিন, তা স্বীকার করে নিয়ে এই সাক্ষাৎকারে মার্কেজ বলেন, “অবশ্যই এটা কঠিন কাজ। তবে ভারত আমার দ্বিতীয় দেশ হয়ে উঠেছে কারণ আমি এখানে চার বছর কাটিয়েছি। আমি আইএসএল এবং আই-লিগের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের চিনি এবং হায়দরাবাদের সঙ্গে থাকার সময় আমি সন্তোষ ট্রফি থেকে একজন খেলোয়াড়কেও সই করাই। আমি এখানকার ঐতিহ্য জানি এবং এই দেশ সম্পর্কে আমার ভাল অনুভূতি আছে। আমার মনে হয়, এই দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য আমি প্রস্তুত”।
ক্লাবের কোচ ও জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বের ফারাক নিয়ে এখনই কিছু বলতে রাজি নন আইএসএল জয়ী কোচ। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “প্রথম ম্যাচের পরেই আমি এর উত্তর দিতে পারব। ভারতীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে আমি বসে দীর্ঘ আলোচনা করতে পারি। তাদের পরিবার নিয়েও কথা বলি। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির পার্থক্য সম্পর্কেও জানি। জাতীয় দলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল যে দলে বিদেশী খেলোয়াড় নেই। এটা অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ, তবে এটা আমার পছন্দেরও। আমার মনে হয় যে, আমরা আগামী কয়েক মরশুমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন করব”।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতীয় দল নিয়ে পরিকল্পনাও শুরু করে দিয়েছেন মার্কেজ। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ভারতীয় দল পরপর দু’টি টুর্নামেন্ট খেলবে। সেপ্টেম্বরে হায়দরাবাদে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও অক্টোবারে ভিয়েতনামে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। এই দুই টুর্নামেন্ট নিয়ে তাঁর মত, “মার্চ মাসে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের তৃতীয় রাউন্ড হবে। তার প্রস্তুতির জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক উইন্ডো রয়েছে আমাদের সামনে। আমাদের আসন্ন তিনটি ফিফা উইন্ডোতে (সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর) ভাল ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।
সেপ্টেম্বর একটু আলাদা হবে, কারণ তখন আইএসএল মরশুম তখন শুরু হবে না। অক্টোবরের ফিফা উইন্ডোর আগে আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার ছবি থাকবে, কারণ তখন পর্যন্ত ক্লাবগুলো কয়েকটি আইএসএল ম্যাচ খেলে ফেলবে। এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর বাছাইপর্বের তৃতীয় রাউন্ডের জন্য দল প্রস্তুত করার জন্য আমাদের সামনে মূলত ছ’টি ম্যাচ রয়েছে। এগুলোতে ভাল খেলতে হবে”।
ভাল প্রস্তুতির জন্য ভাল দলের বিরুদ্ধেই খেলতে চান ভারতীয় দলের কোচ। তিনি ক্রমতালিকায় এগিয়ে থাকা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলার পক্ষপাতী। এই নিয়ে বলেন, “এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের ড্রয়ে আমরা এক নম্বর পটে থাকতে চাই। এতে আমাদের সুবিধা হবে। উন্নতির জন্য আমাদের ভাল ম্যাচ খেলতে হবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের এখনই সবচেয়ে শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলতে হবে। ভিয়েতনাম, লেবানন, সিরিয়ার মতো দলগুলো এশিয়ার ভাল মানের দল। এই দলগুলো এই মুহূর্তে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে ভারতের জন্য এই ধরনের দলের সঙ্গে খেলা সবচেয়ে ভাল হবে। একবার আমরা এই দলগুলির বিপক্ষে উন্নত পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে আরও ভালো দলের সঙ্গে খেলার কথা ভাবতে পারি”।
ভারতীয় দলে কী ধরনের পরিবর্তন আনার কথা ভাবছেন, জানতে চাইলে নয়া কোচ জানান, “এমন এক পুলের প্রয়োজন যেখান থেকে জাতীয় দলের ফুটবলার বাছাই করা যেতে পারে। প্রত্যেকবার তো ২০ জন ভিন্ন খেলোয়াড় ডাকতে পারব না। ফর্মে থাকার সময় সঠিক মুহূর্তে সঠিক খেলোয়াড় বাছাই করাই গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে একজন তুলনামূলকভাবে অজানা খেলোয়াড় হঠাৎ অনেক গোল করা শুরু করল এবং তখন সেই খেলোয়াড়কে ডাকতে হবে এবং তাকে সুযোগ দিতে হবে”।
জাতীয় দলের দায়িত্ব পেলেও নিজের ফুটবল দর্শন পাল্টাতে রাজি নন হায়দরাবাদ এফসি-কে আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন করা কোচ। বলেন, “সাধারণভাবে, আমি অনেক সংগঠন এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে খেলতে পছন্দ করি, এবং আমি উইং দিয়ে খেলা পছন্দ করি। প্রতিটি কোচ চায় তাদের দল ভাল আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলুক, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সাফল্য পাওয়া। কীভাবে জিতছি, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে আমাদের শক্তিশালী দল হতে হবে”।
চার বছর ধরে ভারতে কোচিং করার পর এ দেশের ফুটবলে পরিবর্তন নিয়ে নবনিযুক্ত জাতীয় কোচের বক্তব্য, “প্রথমত, আমি মনে করি ইন্ডিয়ান সুপার লিগ আগের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, আমরা আরও ম্যাচ পাচ্ছি। আমি যখন প্রথমে এসেছিলাম, খেলোয়াড়রা তেমন ধারাবাহিক ছিল না। তারা এক মরশুমে ভাল খেলত কিন্তু পরবর্তী মরশুমে ম্লান হয়ে যেত। এখন বেশিরভাগ খেলোয়াড়রা জানে যে, তাদের কী করতে হবে, তারা আরও পেশাদার এবং মনোযোগী। ডায়েট, বিশ্রাম বা অনুশীলন হোক, তারা অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে সমস্ত নির্দেশ অনুসরণ করে। আমি সাধারণভাবে বলতে পারি যে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেক উন্নতি এসেছে, তবে আমার মনে, ভারত আরও হাজার গুণ উন্নতি করতে পারে”।
ভারতীয় কোচেদের নিয়েও যথেষ্ট আশাবাদী মানোলো মার্কেজ। তাঁদের নিয়ে স্প্যানিশ কোচের পর্যবেক্ষণ, “এখানে আমার চারটি মরশুমে আমি দেখেছি যে, ভারতীয় কোচদের মান প্রতি মরশুমে উন্নত হচ্ছে। গত মরশুমে দু’জন ভারতীয় প্রধান কোচ ছিলেন - থাংবই সিংতো (হায়দরাবাদ এফসি) এবং খালিদ জামিল (জামশেদপুর এফসি)। ক্লিফোর্ড (মিরান্ডা) এর আগে ওডিশা এফসি-কে সুপার কাপ জিতিয়েছে। গত চার বছরে আমি অনেক প্রতিভাবান ভারতীয় সহকারী কোচও দেখেছি।
আগামী কয়েক বছরে, লক্ষ্য হওয়া উচিত যে পরবর্তী জাতীয় দলের প্রধান কোচকে ভারতের হতে হবে। এটা শুধু জাতীয় দলের জন্য নয়, ক্লাবের জন্যও। ক্লাবের প্রত্যেক ভারতীয় সহকারী কোচের লক্ষ্য হওয়া উচিত পরবর্তী কয়েক বছরে প্রধান কোচ হওয়া। সে জন্য সিনিয়র দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে অনূর্ধ্ব-১৭ বা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রধান কোচ হিসেবে তাদের কাজ করা উচিত”।
জাতীয় দলে তরুণ ভারতীয় ফুটবলারদেরও সুযোগ দিতে চান মার্কেজ। এই আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “বয়স কোনো সমস্যা নয়। কে কতটা পরিণত, সেটাই আসল। এই বিষয়ে প্রতিটি খেলোয়াড় অন্যদের থেকে আলাদা হয়। কেউ ১৭ বছর বয়সে পরিণত হতে পারে, আবার অন্যরা ২৩ বা ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত অপরিণত থাকতে পারে। যাদের শুরুর দিকে পরিণত দেখায় তারা হঠাৎ করে পরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আমি মনে করি সঠিক প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি একজন খেলোয়াড় অনূর্ধ্ব-২০ বা অনূর্ধ্ব-২৩-এ ভাল জায়গায় থাকে, তবে তার পরবর্তী স্তরের জন্য লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সিনিয়র দলের সঙ্গে খেলার চেষ্টা করতে হবে”।