গোয়া মানে যেমন সমুদ্র, গোয়া মানে তেমন ফুটবলও। এই উপকূল-রাজ্যে চারদিকে তাকালে দেখা যায়, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা চুটিয়ে ফুটবল খেলে চলেছে। কখনও মাঠে। কখনও সমুদ্রতটের বালির ওপর। ছোটবেলা থেকেই যেখানে ফুটবল রক্তে মিশে থাকে, সেই ফুটবলপাগল রাজ্য যে কত ফুটবলার দিয়েছে ভারতকে, তার সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন।

গত শতকের ষাটের দশকে মেনিনো ফিগেরেডো, অ্যান্ড্রিউ ডিসুজা সত্তরের দশকে নিকোলাস পেরেইরা, ব্রহ্মানন্দ, আশির দশকে ক্যামিলো গঞ্জালেস, স্যাভিও মেডেইরা, নব্বইয়ের দশকে ব্রুনো কুটিনহো, এই শতকের প্রথম দশকে মহেশ গাওলি, আলভিটো ডিকুনহা থেকে আজ পর্যন্ত গোয়ার ফুটবলারদের ছাড়া ভারতীয় ফুটবলের কথা ভাবাই যায় না। এখন যেমন লিস্টন কোলাসো। তিনিই এখন গোয়ানিজ ফুটবলারদের মধ্যে সেরা, এ কথা বললে কি কেউ তাতে দ্বিমত পোষণ করবেন? মনে হয় না।

কোলাসো শুধু গোয়া থেকে উঠে আসা বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে সেরা, তা নয়। সেরা ভারতীয় ফুটবল তারকাদেরও অন্যতম। তাই ভারতীয় দল বাছাইয়ে তাঁর নাম আপনা আপনিই এসে যায়। গোয়ায় ঘরে ঘরে আজ লিস্টন কোলাসো অতি পরিচিত এক নাম, যিনি এখন মাতাচ্ছেন এ দেশের আর এক ফুটবলপাগল শহর কলকাতাও। সত্যি বলতে, নিজের রাজ্য গোয়ায় যত না সাফল্য পেয়েছেন তিনি, তার চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য তাঁকে দিয়েছে কলকাতা। তাই ‘সিটি অফ জয়’-কে কোনও দিন ভুলতে পারবেন না লিস্টন।

গোয়ার দেভোরলিমে জন্ম লিস্টনের। কিশোর বয়সে সালগাওঁকরে খেলতেন। পরে এফসি গোয়ার যুব দলে যোগ দেন। ক্রমশ এফসি গোয়ার এক নম্বর দলে জায়গা পান তিনি। সন্তোষ ট্রফিতেও গোয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

নিজের ফুটবলজীবনের শুরুর দিনগুলো নিয়ে লিস্টন বলেন, “খুব ছোটবেলায় গ্রামের রাস্তায় ফুটবল খেলা শুরু করি। আমার পরিবার সবসময় আমাকে ফুটবল খেলার জন্য উৎসাহ জুগিয়ে এসেছে। ভাল ও খারাপ, সব রকম সময়েই পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। আমার কাছে ফুটবলই সব। খেলাটাকে খুবই উপভোগ করি। এখন ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে খেলাটাই আমার স্বপ্ন”।

যখন এফসি গোয়ায় খেলতেন, তখন থেকেই লিস্টনকে নিয়ে আলোচনা হত ভারতীয় ফুটবল মহলে। পরে যখন হায়দরাবাদ এফসি-তে যোগ দেন ও তাদের হয়ে মাঠে নেমে হিরো আইএসএলে চার গোল করেন, তখন তাঁকে নিয়ে আলোচনাটা আরও বাড়ে। কিন্তু দলবদল করে এটিকে মোহনবাগানে যাওয়ার সিদ্ধান্তই তাঁকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যার পর থেকে শুধু সাফল্যের রাস্তাতেই হাঁটা শুরু হয় এই ফরোয়ার্ডের।

হিরো আইএসএল বিশেষজ্ঞ খুরি ইরানি সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন, “দলবদলে এটিকে মোহনবাগানের চমকে দেওয়া কাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম একেবারে সঠিক সময়ে লিস্টন কোলাসোকে হায়দরাবাদ এফসি থেকে তুলে আনা। ওখানে যাওয়ার পর থেকেই লিস্টন ভারতীয় দলে ডাক পায় এবং সারা দেশের নজর কেড়ে নেয়। এখন সারা দেশ চেনে ওকে এবং সেই এটিকে মোহনবাগানেই রয়েছে ও”।

মুম্বই তথা ভারতীয় দলের প্রাক্তন মিডফিল্ডার ও বর্তমানে হিরো আইএসএলের ভাষ্যকার ড্যারেন ক্যালডেরাও লিস্টনের ভক্তদের তালিকায় রয়েছেন। কেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “সবুজ-মেরুন জার্সি ওর গায়ে ওঠার পর থেকেই যেন আকাশে উড়তে শুরু করে লিস্টন। কী অসাধারণ সব গোল করেছে এটিকে মোহনবাগানের হয়ে! দূরপাল্লার শটে ওর অনবদ্য, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর গোলগুলো চিরকাল মনে রাখার মতো”।

কেন লিস্টনের গোলগুলি তাঁকে ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীদের মনে নায়কের আসনে বসিয়ে দিয়েছে, সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিরো আইএসএলের ধারাভাষ্যকার জন হেল্ম বলেন, “লিস্টন কোলাসো নামটা শুনলেই প্রথমেই মনে পড়ে, তার ক্ষিপ্রতা, ছটফটানি এবং অসাধারণ সব গোলের কথা। যেন ফ্যান্টাসি ফুটবল খেলে ছেলেটা। কয়েকটি এমন চমকে দেওয়া গোল করেছে, যেগুলো দম বন্ধ করে দেওয়ার মতো”।

ফুটবলপ্রেমীরা যেখানে চান গোল এবং ধারাভাষ্যকাররা পছন্দ করেন গতিময় ও দক্ষ ফুটবলারদের, সেখানে লিস্টন যে দু’পক্ষেরই পছন্দের পাত্র হয়ে উঠবেন, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? নিজের কমেন্ট্রিতে তাই বহুবার লিস্টনের ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন জন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওর মধ্যে এমন এক অমূল্য গুণ আছে, যা খুব কম ফুটবলারদের মধ্যেই থাকে এবং তা হল গতি। গতির বিকল্প কিছু হয় না। লিস্টনকে আটকে রাখার ক্ষমতা কারও হয় না”।

ব্যক্তিগত দক্ষতার জন্য লিস্টন যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁর ড্রিবলিং, শুটিং, বল পায়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাটানোর দক্ষতার কম প্রশংসা হয়নি। কিন্তু ক্রমশ নিজেকে যথার্থ টিমম্যান করে তুলেছেন লিস্টন। চলতি হিরো আইএসএলে তিনি নিজে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি গোল করেছেন। কিন্তু অ্যাসিস্ট করেছেন তিনটিতে। দলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এই গোলগুলি হওয়ায় তিনি কার্যত সমর্থকদের নয়নে মণি হয়ে উঠেছেন। দলে তাঁর ভূমিকা ঠিক কী, তা ভাল মতো বুঝে নিয়েছেন তাঁর সতীর্থরাও।

“ওর গতি, ওর ড্রিবলিং এবং যেভাবে ও জায়গা তৈরি করে, এগুলোই ওর শক্তি। দলকে জেতানোর জন্য যা যা করতে হয়, তা সবই করতে পারে লিস্টন। সেই জন্যই ও দলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য”, বলেন এটিকে মোহনবাগানের আর এক তারকা ফরোয়ার্ড মনবীর সিং।

সবুজ-মেরুন বাহিনীর কোচ হুয়ান ফেরান্দো মনে করেন লিস্টনের উপস্থিতিই দলকে বেশ চাঙ্গা করে তোলে। চলতি মরশুমেই একাধিকবার দলকে চাঙ্গা করার জন্য তিনি লিস্টনকে কাজে লাগিয়েছেন বলেও জানান তিনি, “ওর মধ্যে যে অফুরান প্রাণশক্তি রয়েছে, তা দলের ওপর দারুন প্রভাব ফেলে। ও হল আমাদের দলের ব্যাটারি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওর মুখে যখন হাসি লেগে থাকে, তখন দলের অন্যদেরও দারুন মেজাজে পাওয়া যায়”।

এই দু’বছরে লিস্টনকে যিনি এই জায়গায় নিয়ে আসার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, সেই ফেরান্দো আরও বলেন, “আমার মনে হয়, লিস্টন ফুটবলে আক্রমণ ও রক্ষণের ধারণাটা বোঝার চেষ্টা করে সব সময়। কোন সময় বিপক্ষের ওপর চাপ বাড়াতে হবে, কখন ফাঁকা জায়গা কাজে লাগিয়ে আক্রমণে উঠতে হবে, কখন সতীর্থদের কাছাকাছি আনতে হবে এবং পায়ে বল রাখতে হবে, এগুলো ভাল বোঝে ও। এই মরশুমে এগুলো খুব বেশি করে দেখা যাচ্ছে ওর মধ্যে”।

তাঁর পারফরম্যান্স যে দলকে উজ্জীবিত করে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি লিস্টন কোলাসোর। কিন্তু তিনিও যে সতীর্থদের কাছ থেকে উত্তাপ নেন, তাও জানাতে দ্বিধা করেননি, “নিজেকে উজ্জীবিত করতে না পারলে মাঠে নেমে ভাল খেলা কঠিন। আমি উজ্জীবিত হই অনুশীলনে আমার সতীর্থদের কঠোর পরিশ্রম দেখে। এমন একটা অসাধারণ, সুন্দর দল রয়েছে যাদের, তাদের প্রতি ম্যাচই জেতা উচিত”।

গত দু’বছরে একাধিক সন্মান অর্জন করেছেন লিস্টন। গত হিরো আইএসএলে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতা, ফুটবল প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার বিচারে বর্ষসেরা ফুটবলারের সন্মান। কিন্তু ২৪ বছর বয়সি তারকার মধ্যে সাফল্যের খিদে কমেনি এখনও, বরং বেড়েছে।

শেষ করা যাক লিস্টন কোলাসোর সোজা ও স্পষ্ট কথা দিয়ে, “আমি সবসময় একটা লক্ষ্যস্থীর করে নিই। প্রথমত, দলকে জেতাতে হবে এবং যখনই সুযোগ আসবে বা প্রয়োজন হবে, তখন গোল করে দলের সাফল্যে আমাকে অবদান রাখতে হবে। এটাই আমার লক্ষ্য”। এই লক্ষ্যের দিকে এগোতে এগোতেই কখন যে দেশের সেরা ফুটবলারের জায়গাটা ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি, তা নিজেই জানেন না।