বাঙালির ফুটবল-প্রেম তখন চরমে ওঠে, যখন মাঠে মুখোমুখি হয় বাংলার দুই ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল, যা ‘বড় ম্যাচ’ বলে পরিচিত বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। এ প্রজন্মের ফুটবলপাগলদের কাছে আবার এই ফুটবল-যুদ্ধ ‘ডার্বি’ নামে জনপ্রিয়। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘কলকাতা ডার্বি’।

কথায় বলে ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’। বাংলার মানুষ যে সারা বছর ধরে তেরো রকমের উৎসবে মেতে থাকে, তা বোঝাতেই এই প্রবাদ। তবে প্রবাদটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, এই ডার্বি-ও বাঙালির আর এক উৎসব। তাই সেই প্রবাদে তেরো পার্বণ না বলে চোদ্দ পার্বণ বললে খুব একটা ভুল হয় না বোধহয়। সারা বছরে যতবার কলকাতা ডার্বির যুদ্ধ লাগে, ততবার সারা বাংলা জুড়ে উৎসবের মেজাজ দেখা যায়। বাঙালি তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল সবুজ-মেরুন বাহিনী, অর্থাৎ মোহনবাগানের সমর্থক। অন্য দল, লাল-হলুদ ব্রিগেড, অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক।

যারা এ পার বাংলার আদি ও অকৃত্রিম পরিবারের সদস্য, তাদের ‘ঘটি’ বলা হয়ে থাকে। আর যাঁরা ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ বা ওপার বাংলা অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশ থেকে এ পার বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ও সেই সময় থেকে এ দেশেরই স্থায়ী নাগরিক হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ‘বাঙাল’ বলা হয়। এই দুই শ্রেণির মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করে এই দুই ক্লাব। ‘ঘটি’-দের ক্লাব মোহনবাগান ও ‘বাঙাল’-দের ক্লাব। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল-যুদ্ধ মানে ঘটি-বাঙালেরও লড়াই। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ আদতে দুই শ্রেণির বাঙালির মান-সম্মান, আবেগ ও আত্মাভিমানের দ্বৈরথ।

ফুটবল মাঠে কলকাতার দুই প্রধানের রেষারেষি কখনও থামার নয়। বরং আরও বাড়তে থাকবে। হয়তো একশো বছর পরেও ফুটবলের এই চিরপ্রতিদ্বন্দিতা অমর হয়ে থাকবে। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন বা এএফসি ভারতের এক নম্বর ফুটবল লিগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাকে, সেই হিরো আইএসএলে এই দুই ক্লাব অংশ নেওয়ার পরে এই বিশ্বখ্যাত ডার্বির আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বায়ন ঘটেছে।

কলকাতা ডার্বির এই শততম বর্ষে দেশের সেরা ও আধুনিকতম ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে পা রেখে দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবই বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ফুটবলের বিশ্বায়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার মহাযজ্ঞে সামিল তারাও। যে লিগের প্রতি ম্যাচের টাটকা অ্যাকশন সারা বিশ্বের ৮২টি দেশ ও অঞ্চলের ফুটবলপ্রেমীরা সরাসরি দেখতে পেয়েছেন টিভি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, সেই লিগে বাংলার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্লাবের মুখোমুখি হওয়া মানে সারা বিশ্বে ফুটবল-উৎসব।

বাংলার মানুষ থাকেন না, এমন দেশ খুব কমই আছে আর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়েই হয় লাল-হলুদ, নয় সবুজ-মেরুন জার্সির বসবাস চিরকাল। তাই শুধু ভারত নয়, হিরো আইএসএলের ডার্বিতে মেতে ওঠে সারা দুনিয়াও।

ডার্বি ১.০: সবুজ মেরুন দাপটে দুঃস্বপ্নের অভিষেক লাল-হলুদের

যেমন মেতে উঠেছিল গত বছর ২৭ নভেম্বর কলকাতা ডার্বির প্রথম লেগে । ২-০ গোলে জিতে শেষ হাসি হাসে সবুজ-মেরুন শিবির। ৪৯ মিনিটে রয় কৃষ্ণা ও ৮৫ মিনিটে মনবীর সিংয়ের দুর্দান্ত দুই গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দীদের হারায় তারা। বিপক্ষের কড়া ডিফেন্সের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে গোল করার সে রকম সুযোগ তৈরি করতে পারেনি দেশের সেরা লিগে প্রথম খেলতে নামা লাল-হলুদ বাহিনী। ৫৮ শতাংশ বল পজেশন থাকলেও ম্যাচের দখল নিতে পারেনি তারা।

এটিকে মোহনবাগান সে দিন মাঠে দল সাজিয়েছিল ৩-৫-২-এ। লিগের প্রথম ম্যাচে চোট পেয়ে লিগ থেকে ছিটকে যাওয়া মাইকেল সুসাইরাজের জায়গায় জয়েশ রানেকে মাঝমাঠে রেখে এবং আক্রমণে রয় কৃষ্ণার সঙ্গে ডেভিড উইলিয়ামসকে রেখে। অন্য দিকে, এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোচ রবি ফাউলার তাঁর দল সাজান ৪-২-৩-১-এ। গোলে অভিজ্ঞ দেবজিৎ, রক্ষণে দুই কঠিন বিদেশি প্রহরী স্কট নেভিল ও ড্যানিয়েল ফক্সকে রেখে। পাঁচ মিডফিল্ডারের মধ্যে অ্যান্থনি পিলকিংটন ও জাক মাঘোমা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ও সঙ্গে ফরোয়ার্ড বলওয়ন্ত।

প্রথম ৪৫ মিনিটে এটিকে মোহনবাগানের তারকা স্ট্রাইকার জুটি রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসকে দেখে কিন্তু একবারও মনে হয়নি তাঁরা স্বচ্ছন্দে ছিলেন। তবে দ্বিতীযার্ধের শুরুতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ফিজির তারকা এবং ৪৯ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করে এগিয়ে দেন দলকে।

বাঁদিকের উইং দিয়ে জয়েশ রানে আক্রমণটি তৈরি করে প্রথমে দেন ফাঁকায় থাকা হার্নান্ডেজকে। তিনি বিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে পাস দেন রয়কে এবং নিখুঁত ভাবে কাজটা শেষ করেন তিনি। ড্যানিয়েল ফক্স তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। তাঁর পায়ের তলা দিয়েই রয় দূরপাল্লার শটে ঝড়ের গতিতে বল পাঠান সোজা গোলে, যা বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও আটকাতে পারেননি দেবজিৎ মজুমদার।

এ বারের হিরো আইএসএলে অন্যতম সেরা রক্ষণ ছিল এটিকে মোহনবাগানের। তা প্রথম ডার্বিতেই প্রমাণ করে দেন সবুজ-মেরুন ডিফেন্ডাররা। তাঁদের তৎপরতায় গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যকে ৭০ মিনিট পর্যন্ত মাত্র একটি বল সেভ করতে হয়। অন্য দিকে, দেবজিৎকে কিন্তু সে দিন অনেক বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় এবং মাত্র একবার ছাড়া তিনি প্রতিবারই পাশ করে যান।

গোল পেয়ে যাওয়ার পরে যে ভাবে নিজেদের গোলের সামনে দেওয়াল তুলে দেয় এটিকে মোহনবাগান, তাতে এসসি ইস্টবেঙ্গেলের পক্ষে বিপক্ষের গোলমুখ খোলা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। পিলকিংটন, মাঘোমারা বারবার বল নিয়ে উঠেও সফল হননি। তাঁদের হতাশা বাড়িয়ে তুলতে ৮৫ মিনিটে অসাধারণ একটি গোল করেন মনবীর সিং। ডান দিকের উইং দিয়ে উঠে নিজেই গোল তৈরি করে কোনাকুনি শটে দর্শনীয় গোলটি করেন মনবীর।

ডার্বি ২.০: ফিরতি দানেও বাজিমাত রয়, ডেভিডদের

কলকাতা ডার্বির শততম বর্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও জয়ের হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়ে এটিকে মোহনবাগান। এ বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি গোয়ার ফতোরদায় জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ফিরতি লেগের ম্যাচ ৩-১ গোলে জিতে নেয় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ম্যাচের শুরুতেই রয় কৃষ্ণা ও দ্বিতীয়ার্ধে ডেভিড উইলিয়ামস ও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের গোলে জয় ছিনিয়ে নেয় তারা। তাঁদের সতীর্থ ডিফেন্ডার তিরির আত্মঘাতী গোল এসসি ইস্টবেঙ্গলকে সমতা এনে দেওয়া সত্ত্বেও অবশ্য সেই স্কোর ধরে রাখতে পারেনি লাল-হলুদ শিবির।

এসসি ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠে লড়াই করলেও সে দিন প্রতিপক্ষের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তাদের রক্ষণ ভেঙে পড়ে ও আক্রমণের ব্যর্থতাই তাদের হার মানতে বাধ্য করে। এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণ যেমন বিপক্ষের সামনে দুর্ভেদ্য দেওয়াল হয়ে উঠেছিল, এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডাররা কিন্তু রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসদের ধরে রাখতে পারেননি। সারা ম্যাচে সবুজ-মেরুন ফরোয়ার্ডরা যেখানে সাতবার গোলে শট নেন, ব্রাইট ইনোবাখারে, অ্যান্থনি পিলকিংটনরা সেখানে সারা ম্যাচে একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেননি।

প্রথম ডার্বির সঙ্গে দ্বিতীয় ডার্বির তফাৎ ছিল প্রধানত দুই পক্ষের দলগঠনে। জানুয়ারির দলবদলে এসসি ইস্টবেঙ্গল যেমন নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ব্রাইট ইনোবাখারে, গোলকিপার সুব্রত পাল, ডিফেন্ডার সার্থক গলুই, রাজু গায়কোয়াড়, মিডফিল্ডার অঙ্কিত মুখার্জি, সৌরভ দাসদের সই করিয়ে দলটাকে অনেক গুছিয়ে নিয়েছিল, তেমনই সবুজ-মেরুন শিবিরে গোয়ার মিডফিল্ডার লেনি রড্রিগেজ, ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড মার্সেলো পেরেইরাদের নিয়ে এসে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

শুরু থেকেই চাপ বাড়াতে থাকা সবুজ-মেরুন বাহিনী ১৫ মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় রয় কৃষ্ণার পা থেকে। নিজেদের এলাকা থেকে দেওয়া তিরির উড়ন্ত ভলি পেয়ে যখন মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড় শুরু করেন রয়, তখন তাঁর সামনে এসসি ইস্টবেঙ্গলের কোনও ডিফেন্ডার ছিলেন না। রয়কে তাড়া করেও তাঁর নাগাল পাননি ড্যানিয়েল ফক্স, সার্থক গলুইরা। বক্সে ঢুকে গোলকিপার সুব্রত পালকে বোকা বানিয়ে গোলে বল ঠেলে দেন রয়।

শুরুতেই গোল খেয়ে কার্যত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এসসি ইস্টবেঙ্গল। এই সুযোগে তাদের ওপর আরও চাপ বাড়ান রয় কৃষ্ণারা। কিন্তু একাধিকবার গোলের সুযোগ তৈরি করেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তাঁরা। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ দিকে তিরির আত্মঘাতী গোলে সমতা এসে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারা। ৪১ মিনিটের মাথায় লাল-হলুদ ডিফেন্ডার রাজু গায়কোয়াড়ের বিখ্যাত লম্বা থ্রো হেড করে ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজের গোলেই ঠেলে দেন তিরি। তবে প্রথম ৪৫ মিনিটে এসসি ইস্টবেঙ্গল কিন্তু একটাও শট গোলে রাখতে পারেনি।

বিপজ্জনক ফরোয়ার্ড ব্রাইটকে সে দিন কড়া পাহাড়ায় রেখেছিল এটিকে মোহনবাগান। তা সত্ত্বেও ৬৭ মিনিটে নাইজেরীয় তারকা বিপক্ষের তিন খেলোয়াড়কে ধোঁকা দিয়ে বক্সে ঢুকে গোলের সুযোগ তৈরি করে দেন সতীর্থদের। কিন্তু স্টাইনমান,  পিলকিংটনরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন।

৭২ মিনিটে দ্বিতীয় গোল পেয়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। বক্সের সামনে ড্যানিয়েল ফক্সের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বক্সে ঢুকে ডেভিড উইলিয়ামসকে পাস দেন রয়। বক্সের মাথা থেকে ডেভিডের জোরালো শট সোজা জালে জড়িয়ে যায়। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দুমিনিট আগে ফের গোল করে জয় সুনিশ্চিত করে ফেলেন হাভিয়ে হার্নান্ডেজ। এবারেও তাতে অবদান ছিল রয় কৃষ্ণার। বক্সের ডান দিক থেকে তিনি বল দেন হাভিকে। নিখুঁত ও জোরালো হেডে গোলে বল ঠেলে দেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার।