তিনি বাস্তবাদী। গত বছরেও বলেছিলেন, ইন্ডিয়ান সুপার লিগের সেরা ছয়ে দলকে তুলতে চান, কিন্তু কাজটা সোজা হবে না। সেরা ছয়ের দরজায় এসেও ফিরে যেতে হয় তাঁর দলকে। এ বারও ইস্টবেঙ্গলকে প্লে অফে তোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। কিন্তু ওই পর্যন্তই আপাতত থেমে থাকতে চান। এখন থেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা ভাবতে চান না তিনি।

বুধবার কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে আইএসএল আয়োজিত সাত দলের মিডিয়া ডে-তে কুয়াদ্রাত সাংবাদিকদের বলেন, “গত ১২ বছরে ইস্টবেঙ্গল মাত্র একটা ট্রফি জিতেছে। আমাদের বাস্তবাদী হতে হবে। আমাদের দলটা নতুন, অনেক নতুন খেলোয়াড় আছে এই দলে। আমরা দলকে শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা যদি সেরা ছয়ে থাকতে পারি, তা হলে টানা চারটে ম্যাচ জিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। কিন্তু এই পর্বে যে কোনও দল যে কোনও প্রতিপক্ষকে হারাতে পারে। কয়েক দিন আগেই মোহনবাগান ডুরান্ড ফাইনালে ফেভারিট ছিল। কিন্তু নর্থইস্ট ট্রফি জিতে চলে যায়। প্লে অফে যে কোনও ফল হতে পারে। তাই এখন থেকেই চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে কথা না বলাই ভাল। শুধু পরিশ্রম করে যাব, যাতে সেরা ছয়ে থাকতে পারি”।

এ মরশুমের দল নিয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক কুয়াদ্রাত বলেন, “ক্লাবের এখন ভাল সময় চলছে বলেই মনে হয়। গত কয়েক বছরে এই প্রথম পরপর দুই মরশুমে একই কোচ থাকছে দলে। টানা ৩৫টিরও বেশি ম্যাচে দল নামাতে পেরেছি আমি আর আমার স্টাফ। যা শেষ ট্রেভর মর্গ্যানের সময়ে হয়েছিল। কয়েকজন খেলোয়াড়ও একাধিক মরশুমে আমাদের দলে থাকছে। যেমন শৌভিক, ক্লেটন, হিজাজি, সল। জাতীয় দলেও খেলছে আমাদের একাধিক খেলোয়াড়। এখন আমাদের দলের পরিস্থিতি অন্যরকম। অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটছে। আমরা সঠিক দিশাতেই এগোচ্ছি”।

তবে তাঁর দলে সমস্যাও আছে বলে স্বীকার করে নেন লাল-হলুদ কোচ। বলেন, “আমার দলে একটা সমস্যা নয়, অনেক আছে। দলে একটার বেশি সমস্যা না থাকলে বিশ্বের যে কোনও কোচই খুশি হতে পারে। তবু বলব, দল নিয়ে আমি খুশি। যতটা সম্ভব ভাল দল তৈরির চেষ্টা করেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ডুরান্ড কাপে আমরা ভাল খেলতে পারিনি। শিলংয়ে খুবই খারাপ খেলেছি আমরা। দুই ফুল ব্যাক, নিশু ও রকিপ চোটও পায় সেই ম্যাচে। আমাদের এখন প্রাক মরশুম প্রস্তুতি চলছে। দলে ছ’জন নতুন খেলোয়াড়। দল ওদের কাছে ঠিক কী চায়, তা ওরা সবে বুঝতে শুরু করেছে। আমি ইতিবাচক। এখন হেক্টর ও আনোয়ার—এই দুজন আমাদের রক্ষণে খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ওরাও আমাদের দলে নতুন। রক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দল বেশি ক্লিন শিট রাখতে পারে, তাদেরই সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ে। আমরা ক্রমশ উন্নতি করছি। পুরো দল মাঠে নামলে দল শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়”।

দলের চোট আঘাত নিয়ে অনেক গুজব রটলেও তাতে কান দিতে সমর্থকদের বারণ করেন কুয়াদ্রাত। বলেন, “সমর্থকেরা আবেগের বশে অনেক সময়ই গুজবে কান দিয়ে ফেলেন। আমাদের দলের চোট-আঘাত নিয়েও অনেক গুজব ছড়াচ্ছে জানি। তবে সত্যি বলতে, আমাদের চোট-আঘাত নিয়ে তেমন কোনও সমস্যা নেই। নিশু ও লাকরার শুধু চোট আছে। বাকিরা সবাই ফিট। কিছু খেলোয়াড়ের মাঝে মাঝে অস্বস্তি থাকেই। কিন্তু তাদের অনিশ্চিত বলে দেওয়া যায় না। এমনটা সারা বিশ্বের ফুটবলেই হয়। যে রকম প্রস্তুতি হয়েছে বা চলছে, তাতে আমি খুশি। আমরা লিগের জন্য প্রায় তৈরি”।

এ মরশুমে কলকাতার আরও এক দল মহমেডান এসসি খেলবে আইএসএলে। এই খবরে খুশি লাল-হলুদের স্প্যানিশ কোচ। লিগে দলের সংখ্যা বাড়ায় দেশের ফুটবলেও উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি। এই প্রসঙ্গে কুয়াদ্রাত বলেন, “মহমেডানের সঙ্গে গত মরশুমে একটা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা এবং এক গোলে আমরা জিতলেও ম্যাচটা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। আইএসএলে খেলার যোগ্যতা ওদের প্রাপ্য ছিল। ওদেরও অনেক সমর্থক রয়েছে। ওরাও শক্তিশালী দল নামাবে নিশ্চয়ই। লিগে ১৩টি দল খেলছে, এটা খুবই ভাল খবর। ২০১৬-য় যখন আইএসএলে প্রথম আসি, তখন মাত্র আটটা দল খেলত। এখন যা হচ্ছে তাতে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি হবে। আরও পেশাদারিত্ব এসেছে। আরও ভাল ভাল ফুটবলার আসছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, এর ফলে এ দেশের ফুটবলে উন্নতি হবে”।

গত বছর মোহনবাগানে খেলার পর এ বছর ইস্টবেঙ্গলে সই করা স্প্যানিশ সেন্টার ব্যাক হেক্টর ইউস্তে এ দিন বলেন, “মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে আসাটা পেশাদার সিদ্ধান্ত। পেশাদার ফুটবলে এমন হয়েই থাকে। মোহনবাগানের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ইস্টবেঙ্গলের কাছ থেকে ভাল প্রস্তাব পাই ও রাজি হয়ে যাই। ইস্টবেঙ্গলের এ দেশের অন্যতম বড় ক্লাব। প্রচুর সমর্থক রয়েছে এই ক্লাবের। এই শহরও আমার ও আমার স্ত্রী-র খুব পছন্দের। গত মরশুমে আমরা এই শহরে থাকাটা উপভোগ করেছি”।

তবে গত মরশুমে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের শিবিরে খেলার পর এ বার ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ায় কোনও বাড়তি চাপ নেই তাঁর। হেক্টর বলেন, “যে দলের হয়েই খেলি, একই রকম চাপ অনুভব করি এবং সেটা ফুটবলার হিসেবে। বড় দলে খেলতে গেলে অনেক লড়াই করতেই হবে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না”।

ডিফেন্ডার আনোয়ার আলির সঙ্গে গত মরশুমে হেক্টর খেলেছিলেন মোহনবাগানে। এ বার ক্লাব বদলালেও আনোয়ারকে পাশে পাবেন। এই প্রসঙ্গে স্প্যানিশ ডিফেন্ডার বলেন, “আনোয়ারের খবর শুনে আমি প্রথমে চমকে যাই। ও এই লিগের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। আমি সৌভাগ্যবান যে, ওকে এই মরশুমেও পাশে পাব”।

ইস্টবেঙ্গলের বাঙালি তারকা শৌভিক চক্রবর্তীও কলকাতার তিন দল আইএসএলে খেলায় বেশ খুশি। বলেন, “কলকাতা থেকে আইএসএলে তিনটি দল খেলবে, বাংলার ফুটবলার হিসেবে আমি গর্বিত। আশা করব, তিন দলই আইএসএলে প্রাধান্য রেখে খেলবে। ইস্টবেঙ্গলই সবচেয়ে ভাল ফল করুক, এটাই চাইব। বাংলার ফুটবলারদের জন্য এটা খুবই ভাল খবর। ছোট বয়স থেকে যারা ফুটবল খেলছে, তাদের সামনে আইএসএল প্রেরণা। কারণ, তারাও আইএসএল খেলার সুযোগ পেতে পারে। সেখান থেকে দেশেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এটা আমার কাছে কোনও বাড়তি চাপ নয়, বরং খুশির খবর”।

দলের মাঝমাঠ সামলাতে গিয়ে বারবার হলুদ কার্ড দেখা প্রায় তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠেছে। এই নিয়ে শৌভিক বলেন, “এই ব্যাপারেও নিজেকে শোধারানোর চেষ্টা করছি। রোজই অনুশীলনে সেই চেষ্টা করে চলেছি। বারবার কার্ড দেখাটা মোটেই ভাল না। আসলে আমাকে এটা দলের জন্যই করতে হয়। প্র্যাকটিসে চেষ্টা করছি, যাতে ক্লেটনকে ছুঁতে না হয়”।

ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক ক্লেটন সিলভারও লক্ষ্য সেরা ছয়ে ওঠা। বলেন, “গত বছর আমরা সেরা ছয়ে থাকার মতোই খেলেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় খুব খারাপ লেগেছিল। এই মরশুমে আমরা উন্নতি করেছি। এ বারও আমরা সেরা ছয়ে থাকার জন্যই লড়ব”।

ইস্টবেঙ্গলের প্রতি তাঁর ভালবাসা নিয়ে ব্রাজিলীয় তারকা বলেন, “এই ক্লাবের কিংবদন্তি হওয়া কঠিন। অনেক কিংবদন্তি খেলেছে এই ক্লাবের হয়ে। এই ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভাল হয়ে উঠেছে আমার। তাই ক্লাবটাকে ভালবেসে ফেলেছি। তাই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই”।