চলতি মরশুমে এই প্রথমবার সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রথম এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল কলকাতার ইস্টবেঙ্গল এফসি। শুক্রবার দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের জোড়া গোলে থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে লেবাননের অন্যতম সেরা ক্লাব নেজমেহ এসসি-কে ৩-২-এ হারিয়ে টুর্নামেন্টের শেষ আটে পৌঁছে গেল লাল-হলুদ বাহিনী।

এই ম্যাচে না জিতলে তাদের টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যেতে হত। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াকু ফুটবল খেলে তারা। গত দুই ম্যাচে জয় পাওয়া নেজমেহ-র ফুটবলারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত অপরিহার্য্য জয়টি অর্জন করে তারা।

সাত পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ এ-র শীর্ষে থেকে পরবর্তী রাউন্ডে পৌঁছল ইস্টবেঙ্গল এফসি। গ্রুপ পর্বে একমাত্র ম্যাচ হেরে ছয় পয়েন্ট নিয়ে শেষ করা নেজমেহকে এখন তাকিয়ে থাকতে হবে ইস্ট জোনের অন্য দুই গ্রুপের দিকে। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপ এ থেকে সি-র তিন সেরা দল এবং পশ্চিম এশিয়ার এই তিন গ্রুপের মধ্যে সেরা রানার্স-আপ দল শেষ আটে প্রবেশ করবে। এছাড়া গ্রুপ ডি এবং ই-র বিজয়ী ও রানার্স-আপও কোয়ার্টার ফাইনালে উঠবে। শুক্রবার নেজমেহ-কে হারিয়ে এই আট দলের মধ্যে জায়গা করে নিল ইস্টবেঙ্গল।

নতুন কোচ অস্কার ব্রুজোন দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর দলকে এই দুর্দান্ত সাফল্য এনে দিলেন। এই সাফল্য থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস তাদের আইএসএল অভিযানেও নিশ্চয়ই কাজে লাগবে। ১১ বছর পর এএফসি-র কোনও টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বে প্রবেশ করল তারা। ২০১৩-য় এএফসি কাপের সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল লাল-হলুদ বাহিনী। ২০১৫-য় এএফসি কাপে অংশ নিলেও নক আউট পর্বে পৌঁছতে পারেনি। তার পর এই প্রথম কোনও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের মূল পর্বে খেলে এবং শেষ আটেও পৌঁছল লাল-হলুদ ব্রিগেড।

আইএসএলের টেবলে তারা একেবারে নীচে থাকলেও এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে ক্রমশ অভাবনীয় উন্নতি করে ইস্টবেঙ্গল। থিম্পুর প্রায় আট হাজার ফুট উচ্চতায় এবং গড়ে প্রায় ১৫-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়স তাপমাত্রায় ও কৃত্রিম ঘাসের মাঠে অনভ্যস্ত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখায় তারা। প্রথম ম্যাচে ভুটানের পারো এফসি-র বিরুদ্ধে ২-২ ড্র করার পর বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের বিরুদ্ধে ৪-০-য় জয় পায় ব্রুজোনের দল। সব শেষে নেজমেহ এসসি-কে হারিয়ে কঠিন হার্ডলটি টপকে গেল তারা। আগামী বছর মার্চে সম্ভবত আইএসএলের লিগ পর্ব শেষ হওয়ার পর এএফসি-র এই টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব হবে। তত দিনে নিশ্চয়ই আরও উন্নতি করবে ইস্টবেঙ্গল।

গত দুই ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিট ভাল খেলতে পারেনি কলকাতার দল। সেই অভিযোগ বারবার করেন তাদের কোচ ব্রুজোন। কিন্তু শুক্রবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা ছিল। নেজমেহর চেয়ে দুই পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে ম্যাচে নামা ইস্টবেঙ্গল অষ্টম মিনিটেই এগিয়ে যায়, যখন মাদিহ তালালের কর্নার কিক ক্লিয়ার করতে গিয়ে ভুলবশত নিজেদের জালে বল জড়িয়ে দেন নেজমেহের মিডফিল্ডার বাবা মুসাহ (১-০)।

শুরুতে নেজমেহের ধীরগতিকে কাজে লাগিয়ে ১৫ মিনিটের মাথায় তাদের লিড দ্বিগুণ করে নেন দিয়ামান্তাকস। ডান দিক থেকে নাওরেম মহেশের দেওয়া নীচু ক্রসে টোকা মেরে টানা তৃতীয় ম্যাচে গোল করেন এই গ্রিক ফরোয়ার্ড (১-০)। গত দুই ম্যাচে জয়ী নেজমেহ জোড়া গোল খেয়ে হতবাক হলেও দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং মাত্র তিন মিনিট পর কলিন্স ওপারের উদ্দেশে লব করেন ফরোয়ার্ড রাবি আতায়া। প্রভসুখন গিলকে পরাস্ত করে সোজা গোলে বল ঠেলেন ওপারে (২-১)।

একটি গোল শোধ করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া লেবাননের দলটি প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে সমতা ফেরায়, যখন হুসেইন মনজেরের একটি অসাধারণ ফ্রি-কিক হাওয়ায় বাঁক খেয়ে গোলের ওপরের কোণ দিয়ে ঢুকে পড়ে (২-২)। অসাধারণ এই গোল এক সময় দু’গোলে এগিয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গলকে জোর ধাক্কা দেয়।

পরাজয় মানেই বিদায়—এই কথা মাথায় রেখে দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলই আরও সতর্ক থাকার কৌশল নেয়। যদিও কিছু ভালো সুযোগ তৈরি করে নেয় নেজমেহ। ৪৭ মিনিটের মাথায় হাসান কোরানি একটি হেড দিয়ে প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঢোকানোর সুযোগ পান। কিন্তু সফল হননি। এর পর মাহদি জেইন ও আতায়ার আরও কিছু প্রচেষ্টা প্রতিহত করেন গিল। এই সময় অসাধারণ ডিফেন্সও করে ইস্টবেঙ্গল। গোলের সামনে থেকে বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে ব্যবধান বাড়ানোর একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন তালাল।

ম্যাচের ৭৬ মিনিটের মাথায় আসে সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যখন তালালকে বক্সের ভেতর ফাউল করেন আলি ইসমাইল এবং রেফারি নির্দ্বিধায় পেনাল্টির নির্দেশ দেন। স্পট-কিকটি সহজেই গোলে পাঠিয়ে ৭৭তম মিনিটে ইস্টবেঙ্গলকে ফের এগিয়ে দেন গত আইএসএলের গোল্ডেন বুটজয়ী দিয়ামান্তাকস।

ফের সমতা ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা শুরু করে নেজমেহ এবং বাকি সময় ইস্টবেঙ্গল রক্ষণকে তারা যথেষ্ট চাপের মধ্যে রাখে। তবে কোনও ফল হয়নি। জয়ের লক্ষ্যে অটল থেকে নিজেদের গোলের সামনে কার্যত দেওয়াল তুলে দেয় লাল-হলুদ রক্ষণ। ম্যাচের শেষ দিকে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হলেও তা কড়া হাতে সামলান থাইল্যান্ডের রেফারি সংক্রান বুনমিক্রিয়াত।

অসাধারণ জয়ের পর সাংবাদিক বৈঠকে এসে দিয়ামান্তাকসদের স্প্যানিশ কোচ ব্রুজোন বলেন, “আমরা এই লক্ষ্য নিয়েই ভুটানে এসেছিলাম। যাতে এশীয় স্তরের এই টুর্নামেন্টের পরবর্তী স্তরে পৌঁছতে পারি। দেশের লিগে (আইএসএল) আমরা ভাল অবস্থায় নেই। তাই এই সাফল্য আমাদের ঘরোয়া লিগে ভাল খেলার প্রেরণা জোগাবে। এই স্তরের ফুটবলে সফল হতে গেলে যে রকম পারফরম্যান্স দিতে হয়, আমাদের ছেলেরা সে রকমই খেলেছে আজ। টানা ৯০ মিনিট লড়াই করেছে। দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের প্রতিপক্ষ আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু শেষ কুড়ি মিনিটে আমরা নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এই সাফল্যের জন্য দলের ছেলেদের ধন্যবাদ। তারা অনেক পরিশ্রম করেছে। সমস্ত সমর্থক ও ক্লাব কর্তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আমরা খুশি”।