কোচ বদলেছে, দলে অনেক নতুন খেলোয়াড়ও এসেছেন। মরশুমের শুরুটাও হয়েছে গত তিন মরশুমের তুলনায় অনেক আশা জাগিয়ে। কিন্তু মরশুম যত গড়াচ্ছে, ইস্টবেঙ্গল এফসি-র পুরনো রোগ যেন কিছুতেই সারছে না। তারা শুরুতে গোল করে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তার পরে আর সেই ব্যবধান যে শুধু ধরে রাখতে পারছে না, তা নয়, উল্টে হেরেও যাচ্ছে।

এ ভাবে গত বারে তারা ব্রিটিশ কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইনের প্রশিক্ষণে জেতার জায়গায় পৌঁছেও ১১ পয়েন্ট খুইয়েছিল। এ বার সবে শুরু করেছে তারা। মাত্র চারটি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যেই জেতার জায়গা থেকে ছ’পয়েন্ট খুইয়ে ফেলেছে লাল-হলুদ বাহিনী। এখনও ১৮টি ম্যাচ খেলা বাকি রয়েছে তাদের। তা হলে কি গতবারের নজিরকেও তারা এ বার ছাড়িয়ে যাবে? এই অশনি সঙ্কেতই দেখতে পাচ্ছেন সমর্থকেরা।

কিন্তু বারবার কেন হচ্ছে এমন? কেন পুরনো রোগ সারছে না লাল-হলুদের। লড়াকু দল হিসেবে চিরপরিচিত দলের সুনাম কেন এ ভাবে বারবার নষ্ট হচ্ছে? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। গত ম্যাচে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ৭৩ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। শেষে ১-২-এ হেরে মাঠ ছাড়তে হয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। তার আগের ম্যাচেও বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে একই ঘটনা ঘটে।

এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্প্যানিশ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত বলেন, “আসলে আমাদের দলে এ বার অনেক নতুন খেলোয়াড় আছে। ওদের আরও পরিণত হয়ে উঠতে হবে। এই হারটা আমাদের কাছে একটা বড় শিক্ষা। বেঙ্গালুরুতে শেষ ম্যাচেও এ রকম হয়েছিল। আমাদের মানসিক ভাবে আরও শক্তিশালী হতে হবে, যাতে এই কঠিন দলগুলোর বিরুদ্ধে ভাল খেলতে পারি”।

কোচের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো এই কথাগুলি ঠিকই, কিন্তু তাঁর এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এখনও যদি দলের খেলোয়াড়রা পরিণত হয়ে উঠতে না পারেন, তা হলে গত চার মাস ধরে নিয়মিত একসঙ্গে মাঠে নেমে কী লাভ হল?

যদিও আইএসএল চ্যাম্পিয়ন কোচ কুয়াদ্রাত বলছেন, এমন বেশিদিন চলতে দেবেন না তিনি, “এই ভুলগুলো শোধরাতে হবেই। গত ম্যাচে একটা পেনাল্টি আমাদের শেষ করে দিয়েছিল, এই ম্যাচে একটা ফ্রি কিকের জন্য আমরা খেলা থেকে হারিয়ে গেলাম। এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাদের। প্রতি ম্যাচে এমন হতে দেওয়া যাবে না”।

বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে যতটা ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল তারা এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে কিন্তু ততটা ভাল খেলতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। বেঙ্গালুরুতে সে দিন হারার মতো পারফরম্যান্স ছিল না ইস্টবেঙ্গলের। তারা যে হোম টিমের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তা একেবারেই বলা যায় না। তা সত্ত্বেও হেরেই মাঠ ছাড়তে হয় তাদের।

১৫ মিনিটের মাথায় মহেশ সিংয়ের দুর্দান্ত গোলে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু তাদের ছন্দপতন ঘটে তার ছ’মিনিট পরেই, যখন সুনীল ছেত্রীকে নিজেদের বক্সের মধ্যে ফাউল করে তাদের পেনাল্টির সুযোগ করে দেন মন্দার রাও দেশাই। পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতা আনেন সুনীল। দ্বিতীয়ার্ধে হাভিয়ে হার্নান্ডেজের অসাধারণ বাইসাইকেল কিকের গোলে শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট খোয়ায় ইস্টবেঙ্গল।

সেই ম্যাচের পর কুয়াদ্রাত বলেন, “আমার ভাল লাগছে যে, আমরা আজ সব দিক থেকেই আধিপত্য বিস্তার করেছি। বেঙ্গালুরু যেখানে চারটে শট মেরেছে, সেখানে আমরা ১২টা শট মেরেছি। এর মধ্যে দুটো শট আমরা লক্ষ্যে রাখতে পেরেছি। এই সংখ্যাটা আমাদের বাড়াতে হবে। তবে আমার দলের ছেলেদের কোনও দোষ দেব না। তাদের চাপে ফেলতেও চাই না আমি। সমর্থকদের এবং আমাদেরও সবাইকে বুঝতে হবে, ফুটবলে এ রকমই। বক্সের মধ্যে কে কী রকম খেলছে, তার ওপর নির্ভর করে সব কিছু। ওরা দুটো শট গোলে রেখেছে, দুটো থেকেই গোল পেয়েছে। আমরা কিন্তু অনেক সুযোগ হাতছাড়া করেছি”।

এই সুযোগ নষ্ট করাও ইস্টবেঙ্গলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারার অন্যতম একটি কারণ। এ পর্যন্ত তারা চারটি ম্যাচে মাত্র এগারোটি শট গোলে রাখতে পেরেছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে ২২টি শট। ৩২টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছে তারা, যার মধ্যে গোলে পরিণত হয়েছে মাত্র চারটি। যতই তাদের আক্রমণ বিভাগ খাতায় কমমে শক্তিশালী হোক না কেন, এই পরিসংখ্যানে উন্নতি না ঘটাতে পারলে এ মরশুমেও ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে প্রথম ছয়ে থাকা কঠিন হবে।

লিগের প্রথম ম্যাচে জামশেদপুরের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্রয়ের পর লাল-হলুদ কোচ বলেছিলেন, “আমরা সবে মরশুম শুরু করছি এবং অনেক কিছুই ক্রমশ উন্নতি হবে। অনেক ভাল ভাল সুযোগ তৈরি করেছি আমরা। শুরুতেই আমরা গোল পেয়ে গেলে ছবিটা পুরো বদলে যেত। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ গোল শোধ করার জন্য আরও ওপেন হয়ে যেত এবং আমরাও আরও আক্রমণ করতে পারতাম”।

সে দিন সারা ম্যাচে অনেকগুলি গোলের সুযোগ হাতছাড়া করে ইস্টবেঙ্গল। দলের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিওই সবচেয়ে বেশি সুবর্ণ সুযোগ পান। কিন্তু কোনওটাই কাজে লাগাতে পারেননি। গত মরশুম থেকে আইএসএলে টানা ১১টি ম্যাচে গোল করতে পারলেন না তিনি, যা তাঁর কেরিয়ারে সবচেয়ে খারাপ সময়। এ বার এখন পর্যন্ত একটিও অ্যাসিস্ট করতে পারেননি তিনি। এমনকী একটিও গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। ১৫৮ মিনিট মাঠে থেকে একটি মাত্র শট গোলে রাখতে পেরেছেন তিনি। তাঁর এই খারাপ ফর্ম ভোগাচ্ছে গোটা দলকে।

দুই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা ও সল ক্রেসপোও এ পর্যন্ত কোনও গোল বা অ্যাসিস্ট করতে পারেননি। সেই গতবারের সবচেয়ে সফল জুটি নাওরেম মহেশ সিং ও ক্লেটন সিলভাই দলকে গোল এনে দিচ্ছেন। দলের চারটি গোলের মধ্যে ক্লেটনের দু’টি ও মহেশের দু’টি। অ্যাসিস্টের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নন্দকুমার শেখর। দুটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। কিন্তু কোনও গোল করতে পারেননি। যাদের কাছ থেকে গোল আশা করা উচিত, তাদের কাছ থেকে গোল না পাওয়াটা ইস্টবেঙ্গলের একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠছে।

তেমনই আক্রমণে উঠে ফের নেমে আসার (ট্রানজিশন) গতিও বেশি না হওয়াটা তাদের একটা বড় সমস্যা। যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণ উঠে গোল করাটাও ইস্টবেঙ্গলের প্রতিপক্ষদের কাছে সহজ হয়ে উঠছে। রক্ষণও আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন তাদের। এ পর্যন্ত চারটি গোল করলেও পাঁচটি গোল খেয়েছে ইস্টবেঙ্গল। অনুশীলনে এই বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে তাদের।

কোচ বলছেন, “এ বার দল নতুন কৌশলে খেলছে। তাই সব কিছু গতবারের মতোই হবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। আমরা ভাল ফল করেও কেন তা ধরে রাখতে পারছি না, তার কারণ আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার। তাই সেগুলো নিয়ে এর পরে আমরা কাজ করব”। সত্যিই যদি তা করতে পারে ইস্টবেঙ্গল, তা হলে হয়তো পরের কয়েকটি ম্যাচে অন্য রূপে দেখা যাবে লাল-হলুদ বাহিনীকে। না হলে এই সমস্যা হয়তো চলতেই থাকবে।