ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে না পারলেও ইস্টবেঙ্গল এফসি তাদের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-কে ৪-৩-এ হারিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, আর একটু প্রস্তুতির সময় পেলে নক আউট পর্বে ওঠার মতো দল ছিল তাদের।

শনিবার দক্ষিণ কলকাতার কিশোরভারতী ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমার্ধে ১৭ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য থাকার পরে মাত্র ২৬ মিনিটের ব্যবধানে হাফ ডজন গোল দেয় দুই দল। দ্বিতীয়ার্ধে দুই পক্ষই রক্ষণে প্রায় দেওয়াল তুলে দিলেও জয়সূচক গোলটি পেয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী। ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ক্লেটন সিলভা ও সুমিত পাসি দুটি করে গোল দেন। অন্য দিকে, মুম্বই সিটি এফসি-র ফরোয়ার্ড লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতের পা থেকেও জোড়া গোল আসে। তাদের অপর গোলদাতা গ্রেগ স্টুয়ার্ট। 

গত রবিবার কলকাতা ডার্বিতে যে ঝলক দেখা গিয়েছিল লাল-হলুদ বাহিনীর খেলায়, পাঁচ দিনের বিশ্রামে ও এই ক’দিনের প্রস্তুতিতে যে আস্ত একটা সিনেমা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটাই বোঝা গেল শনিবারের ম্যাচে। কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা পাকা করে ফেলায় হয়তো মুম্বই সিটি এফসি-র খেলোয়াড়দের মধ্যে কিছুটা গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যায়। এই সুযোগেই তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গল এফসি। আসন্ন হিরো আইএসএলের উদ্বোধনী ম্যাচে যদি এই ছন্দ বজায় রাখতে পারে তারা, তা হলে কেরালা ব্লাস্টার্সকে ঘরের মাঠে বেগ পেতে হতে পারে। স্টিফেন কনস্টানটাইনের দলের এই পারফরম্যান্স দেখে তারা হয়তো চিন্তায় পড়ে যাবে।

ডার্বির প্রথম এগারোয় তিনটি বদল করে এ দিন মাঠে নামে লাল-হলুদ বাহিনী। মহম্মদ রকিপ, সেম্বয় হাওকিপ ও ক্লেটন সিলভা নামেন যথাক্রমে ইভান গঞ্জালেজ, ওয়াহেংবাং লুয়াং ও লিয়ান্দ্রো ডস স্যান্টোসের জায়গায়।  

এ দিন চার ব্যাকে খেলা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল এফসি। যার ফলে মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ শুরু করেন অ্যালেক্স, শৌভিকরা। চার মিনিটের মাথাতেই বাঁদিক দিয়ে উঠে গোলের সামনে ক্রস ফেলেন লিমা। কিন্তু মুম্বইয়ের ডিফেন্ডাররা তা ক্লিয়ার করে দেন।

দুরন্ত গতিতে যে খেলা শুরু করে দুই দলই, তা একেবারেই না। বরং একে অপরকে পরখ করে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় দু’পক্ষের পারফরম্যান্সে। কিন্তু ১৫ মিনিটের পর থেকে দ্রুত খেলা বদলে ফেলেন ক্লেটন সিলভারা এবং ১৭ মিনিটের মাথাতেই প্রথম গোল পেয়ে যান।

বাঁ দিক দিয়ে ওঠা জেরির উড়ন্ত ও মাপা ক্রস পেয়ে দ্বিতীয় পোস্টের সামনে থাকা অরক্ষিত সুমিত পাসি গোলে বল ঠেলতে ভুল করেননি (১-০)। ডার্বির আত্মঘাতীয় গোলের শাপমুক্তি হল তাঁর। ইস্টবেঙ্গলের এই হঠাৎ গতিবদল, আক্রমণের প্রবণতা বাড়ায় কিছুটা হলেও ঘাবড়ে যান আহমেদ জাহুরা।

কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটতে না কাটতেই ২২ মিনিটে ফের এক অসাধারণ ফ্রিকিকে বিশ্বমানের গোল করে ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে আরও এগিয়ে দেন ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভা। বক্সের সামনে থেকে নেওয়া ফ্রিকিক সোজা গোলকিপারের বাঁ দিকের কোণ দিয়ে ঢুকে পড়ে গোলে। গোলকিপারের কিছুই করার ছিল না (২-০)।

এর দু’মিনিট পরেই ফের একটি গোলের সুযোগ পান ক্লেটন। মাঝমাঠ থেকে একা বল পেয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে বক্সের মাথা থেকে শট নেন। সামনে থাকা শুধু গোলকিপার মহম্মদ নাওয়াজের ডানদিক দিক দিয়ে বল ঠেললেও তা পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

মুম্বইয়ের ফুটবলাররা দুই গোলের বিস্ময় ঝেড়ে ফেলে খেলায় ফিরে আসতে অবশ্য বেশি সময় নেনন। ২৭ মিনিটেই প্রথম গোল শোধ করে তারা। বাঁ দিক দিয়ে বল নিয়ে ওঠা বিপিন সিংয়ের ক্রস বক্সে বুক দিয়ে নামিয়ে পিছনে গ্রেগ স্টুয়ার্টকে দেন পেরেইরা দিয়াজ। বক্সের মাথা থেকে সোজা গোলে শট নেন স্টুয়ার্ট (২-১)।

এখানেই শেষ নয়। ম্যাচের ৩৪ থেকে ৩৬ মিনিটের মধ্যে আরও দু’টি গোল করে দুই দল। সুমিত পাসিকে অবশ্য গোলটি কার্যত উপহার দেন মুম্বইয়ে গোলকিপার। বক্সের সামনে থেকে ডানদিকে সুমিতকে পাস দেন ক্লেটন। সুমিত গোলের সামনে আসলে ক্রস দিতে চেয়েছিলেন, যা আটকাতে গিয়ে নওয়াজের আঙুলে লেগে গোলে ঢুকে যায় (৩-১)।

এর দু’মিনিট পরেই বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া অসাধারণ শটে গোল করে ফের ব্যবধান কমান লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে (৩-২)। এই গোলের জন্য লাল-হলুদ গোলকিপার কমলজিতেরও সমালোচনা হতে পারে। যে গোলে সমসতা আনে মুম্বই, সেই গোলের জন্যও অনেকটাই দায়ী তিনি।

৪৩ মিনিটের মাথায় প্রথমে নগুয়েরা বক্সের বাইরে থেকে সোজা গোলে শট নন, যা দুই হাত দিয়ে বের করে দেন কমলজিৎ। কিন্তু ফিরতি বল পৌঁছয় বাঁদিক দিয়ে উঠে আসা বিপিনের কাছে। তিনির বক্সের ওপরের কোণ থেকে ক্রস ভাসিয়ে দেন বক্সের মাঝখানে থাকা ছাঙতের উদ্দেশ্যে এবং তাঁর শট সোজা জালে জড়িয়ে যায় (৩-৩)। প্রথম ৪৫ মিনিটের এই লড়াইই পুরো ম্যাচের সুরের মাত্রা বেঁধে দেয়।

তবে প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধে একে অপরকে গোলের মালা পড়ায়নি দুই দল। দ্বিতীয়ার্ধে হাওকিপের জায়গায় ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড লিয়ান্দ্রোকে নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ স্টিফেন। গোলের ব্যবধান ফের বাড়ানোর জন্যই নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর সাত মিনিটের মধ্যে গোলের সামনে থেকে সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান তিনি। কিন্তু বল গোলকিপারের হাতে জমা করে দেন লিয়ান্দ্রো।

এই সু।যোগের পরে বক্সের ডানদিকে ক্লেটনের ক্রস থেকে গোলের সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হন সেই লিয়ান্দ্রো। ঠিকমতো পায়ে বলই লাগাতে পারেননি তিনি। এর পরের মিনিটেই কর্নার থেকেও গোলের কঠিন সুযোগ পেয়ে যায় তিনি। এ বারও ব্যর্থ হন। ৬৩ মিনিটে গোলের সামনে উড়ন্ত ফ্রিকিক রেখেও লাভ হয়নি লিমা বা ইস্টবেঙ্গলের।

এই ম্যাচে নামার আগেই তারা নক আউটে চলে যাওয়ায় এ দিন চাপমুক্ত হয়ে খেলতে নেমেছিল মুম্বই সিটি এফসি। কিন্তু পরপর দু’গোল খেয়ে চাপে পড়ে যায় তারা এবং তার পরেই পুরনো মেজাজে ফিরে আসে তারা। দ্বিতীয়ার্ধে বোধহয় গোল না খাওয়ার সংকল্প নিয়েই নেমেছিল ইস্টবেঙ্গল। তাই তাদের গোলের সামনে সে রকম স্পষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারছিল না মুম্বই সিটি এফসি।

কিন্তু তাদের দেখে স্পষ্ট মনে হয়, যতক্ষণ না জয়সূচক গোল দিতে পারছেন, ততক্ষণ শান্তি পাবেন না। ৭২ মিনিটে ছাঙতের গোলমুখী শট কমলজিতের হাত থেকে ছিটকে গেলে দ্বিতীয় পোস্টে থাকা দিয়াজ তা ফের গোলে মারেন। এ বার গোললাইন সেভ করেন কমলজিৎ।

তবে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ন’মিনিট আগে ঘটে ঠিক উল্টোটা। ক্লেটন তাঁর দ্বিতীয় গোল করে দলকে ফের এগিয়ে দেন। মাঝমাঠের পর থেকে তিনিই আক্রমণ শুরু করেন। মাঝখান দিয়ে উঠে বাঁ দিক দিয়ে ওঠা অমরজিৎ সিং কিয়ামকে বল দেন তিনি। অমরজিৎ বক্সের মধ্যে ক্রস দিলে সেই ক্রস থেকেই সুযোগসন্ধানী গোল করেন ক্লেটন (৪-৩)। অতিরিক্ত পাঁচ মিনিট সময় পেয়েও এই গোল আর শোধ করতে পারেনি চলতি ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালিস্টরা।  

ইস্টবেঙ্গল এফসি দল: কমলজিৎ সিং (গোল) মহম্মদ রকিপ, লাল চুঙনুঙ্গা (সার্থক গলুই), চারালাম্বোস কিরিয়াকু, প্রীতম সিং (অমরজিৎ সিং কিয়াম), সুমিত পাসি (হীমাংশু জাঙরা), শৌভিক চক্রবর্তী, অ্যালেক্স লিমা, জেরি লালরিনজুয়ালা (নাওরেম মহেশ সিং) , সেম্বয় হাওকিপ (এলিয়ান্দ্রো ডস স্যান্টোস), ক্লেটন সিলভা (অধি)।