সদ্যসমাপ্ত আইএসএলের গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল জেতার পর তাঁর দল ও কোচেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির ফরোয়ার্ড আলাদিন আজারেই । ২০২৪-২৫ মরশুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে তাঁকে গোল্ডেন বুট দেওয়া হয়েছে এবং গোল্ডেন বল দেওয়া হয়েছে মরশুমের সেরা ফুটবলার হিসেবে।

একই আইএসএল মরশুমে একসঙ্গে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল দুটোই জেতায় এই লিগে এক নতুন ইতিহাস গড়লেন আজারেই। এর আগে মাত্র দু’জন ফুটবলার এই কীর্তি স্থাপন করতে পেরেছিলেন— স্টিভেন মেন্ডোজা ও ফেরান কোরোমিনাস। তাঁরাও একই মরশুমে জোড়া সম্মান অর্জন করেন।
এ মরশুমে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান আজারেই। ২৩টি গোল এবং ৭টি অ্যাসিস্ট করেন। তার এই পারফরম্যান্সে দলের প্লে-অফে ওঠা নিশ্চিত হয় এবং তিনি দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মরসুমের শুরু থেকেই মরক্কোর এই ফুটবলার টানা আটটি ম্যাচে গোল করে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেন। তিনি আইএসএল ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত ১০ গোল করার নজিরও গড়েন। যদিও তাঁর দল চতুর্থ স্থানে শেষ করে, তবে আজারেইয়ের মোট ৩০টি গোল অবদান তাঁকে এক মরশুমে ক্লাব ও লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার মর্যাদা এনে দেয়।

‘দল ছাড়া কিছুই করতে পারতাম না’

এই অসাধারণ অভিযানে যাঁরা তাঁকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের কথা বলেছেন কৃতজ্ঞ আজারেই। তিনি বিশেষভাবে তাঁর সাপোর্ট সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, "এই মরশুম আমার কাছে অসাধারণ। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না..। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এবং আমার দল, আমাদের স্টাফ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। তাঁদের ছাড়া আমি এই জোড়া খেতাব জিততে পারতাম না। এই দিনটা আমাকে আরও শক্তি দিচ্ছে, যেন আমি এভাবেই চালিয়ে যেতে পারি এবং ভবিষ্যতেও আমার দলকে সাহায্য করতে পারি। এই খেতাব আমার কাছে স্পেশ্যাল। আমার পরিবার, আমার বন্ধুবান্ধব আর আমার দলের জন্য বড় সম্মান। কারণ, দল ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না"। নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করা এক ভিডিওতে তিনি এ সব কথা বলেন।

যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, মরশুমের মধ্যে কোন গোলটি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল, তখন তিনি এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে করা গোলটির কথা বলেন। গোয়ার ফাতোরদা স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচ ৩-৩ ড্র হয়েছিল এবং আজারেই একটি দুর্দান্ত গোল করেন। দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গোলে বল পাঠান তিনি। সেই গোল নিয়ে তিনি বলেন, এটা শুধু একটি গোল নয়, এটা তার কঠোর পরিশ্রম এবং নিয়মিত অনুশীলনের ফল।

"আইএসএলে আমার প্রিয় গোলটি ছিল এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে। আমার পক্ষে ও রকম একটা গোল করা বেশ কঠিন ছিল। কারণ, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি এ রকম একটা গোল করতে। আর যখন করেছি, সেটা ছিল কঠোর পরিশ্রমের ফল," — বলেন মরক্কান তারকা।

মরশুমের সেরা মুহূর্ত

সারা মরশুমে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এবং স্মরণীয় মুহূর্তের কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি চেন্নাইন এফসির মাঠে তাঁদের ৩-০ জয়ের কথা বলেন আজারেই। বলেন, "দলের সঙ্গে আমার সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত ছিল চেন্নাইন এফসির বিপক্ষে ৩-০ জয়। যে জয়ে আমরা সরাসরি প্লে-অফে খেলার যোগ্যতা অর্জন করি"।

ভারতীয় ফুটবলে একজন বিদেশী ফরোয়ার্ড কত উঁচুতে উঠতে পারেন, মরক্কোর এই স্ট্রাইকার সেই ধারণা নতুন করে তৈরি করে দিয়েছেন। এমন এক ক্লাবের হয়ে এই সাফল্য অর্জন করেন তিনি, যার বেশিরভাগ সময় কেটেছে আন্ডারডগ হিসেবে। মরক্কো থেকে আসা এই বাঁ-পায়ের জাদুকরের মধ্যে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি খুঁজে পেয়েছে তাদের এক সুপার হিরোকে। যদিও হাইল্যান্ডারদের অভিযান প্লে-অফেই শেষ হয়, তবে এই নিয়ে সন্দেহ নেই যে, তাঁদের এই কিংবদন্তি স্ট্রাইকার ছাড়া বোধহয় এতদূর পৌঁছানো তাদের পক্ষে সম্ভব হত না।

ভারত অভিযানের স্মরণীয় সূচনা

ভারতের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশি সময় নেননি আজারেই। নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির প্রথম আট ম্যাচেই গোল করে কালু উচের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন এবং আইএসএল ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত ১০ গোলের মাইলফলকে পৌঁছন আজারেই।

এই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, ১১ গোল ও ৪ অ্যাসিস্ট, আইএসএলে এক দারুণ মরশুমে হিসেবে বিবেচিত হয়। বেঙ্গালুরু এফসির ফরোয়ার্ড সুনীল ছেত্রী ১৪ গোল ও ২টি অ্যাসিস্ট করে আজারেইয়ের পেছনেই ছিলেন। কিন্তু আজারেই মাত্র ৮ ম্যাচেই ১৫টি গোল অবদান রাখেন। এতটাই কার্যকরী ছিলেন তিনি।

দুর্দান্ত প্রতিভা ও জনপ্রিয়তা

ভক্তরা শুধু তাঁকে দেখার জন্যই স্টেডিয়ামে আসতে শুরু করেছিল। যাঁর পায়ে বল পেলে মনে হয় কিছুই অসম্ভব নয়, তাঁকে দেখার জন্য তো লোক আসবেই। এমনকী, নিরপেক্ষ দর্শকেরাও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির হয়ে গলা ফাটাতে শুরু করেন।

শুধু নিয়মিত গোলদাতা নন, আজারেই এ মরশুমে হয়ে ওঠেন বহুমুখী এবং নির্মম। এক সপ্তাহে বক্সের বাইরে থেকে এক দুর্দান্ত কার্ল শট, পরের সপ্তাহে শক্তিশালী হেডার, তার পরের সপ্তাহে এক মজার চিপ, আবার কখনও ছ’গজ বক্সে জটলার মধ্যে থেকে গোল। এতটাই অনিশ্চিত তিনি যে, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা জানেই না কখন, কীভাবে তিনি আক্রমণ করবেন।

চমকপ্রদ ড্রিবলিং বা চোখ ধাঁধানো কৌশল হয়তো দেখা যায়নি আজারেইয়ের খেলায়। তাঁর পারফরম্যান্স আসলে মেধা ও কার্যকারিতার মিশেল। বুদ্ধিদীপ্ত মুভমেন্ট, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকা, এবং এক আক্রমণের জায়গা তৈরি করার অদ্ভুত দক্ষতা রয়েছে তাঁর মধ্যে। তিনি দ্রুতগতিসম্পন্ন না হলেও, তাঁর গোলমুখী দৌড়গুলি যেন দাবাড়ুদের মত হিসাব করা।

যেখানেই আলাদিন, সেখানেই গোল

দুই পায়েই ফিনিশ করতে পারেন তিনি, বল ধরে রাখতে পারেন এবং চাপের মধ্যেও তাঁর টাচ যেন এক ব্যালে ড্যান্সারের মতো কোমল। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কোচ হুয়ান পেদ্রো বেনালি তাঁকে খেলায় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন — কখনও বাঁয়ে, কখনও মাঝখানে। কিন্তু ছবিটা তাতে বদলায়নি। আজারেই যেখানেই খেলেছেন, সেখান থেকেই গোল করেছেন।

মরমের শেষে আজারাইয়ের পরিসংখ্যান ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি ২৫ ম্যাচে ২৩টি গোল করেন — প্রতি ৯৮ মিনিটে একটি গোল। সঙ্গে আরও ৭টি অ্যাসিস্ট যোগ করলে, তিনি সরাসরি দলের ৩০টি গোলে অবদান রেখেছেন। নর্থইস্ট ইউনাইটেড পুরো মরশুমে মোট ৪৬টি গোল করেছে। তার মানে আজারেই একাই জড়িত ছিলেন দলের ৬৫% গোলে। যদি তাঁকে বাদ দিতেন, তাহলে হয়তো হাইল্যান্ডাররা লিগ টেবলেই থাকত না। কিন্তু তারা লিগ শেষ করে চতুর্থ স্থানে থেকে, প্লে-অফ নিশ্চিত করে এবং সেমিফাইনালে অল্পের জন্য উঠতে না পারার কষ্ট নিয়ে।

নজির গড়া-ভাঙার নায়ক

আজারাই শুধু সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সবার ওপরে ছিলেন, তা নয়। তিনি একেবারে আধিপত্য করে গিয়েছেন এবং নয়া নজিরও গড়েছেন। ২৩ গোল করে তিনি একই মরশুমে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড গড়েন, ভাঙেন ফেরান কোরোমিনাসের ১৮ গোলের রেকর্ড। তাঁর পারফরম্যান্স ছিল বিস্ময়কর। কারণ, তিনি সর্বোচ্চ গোল অবদান (৩০) রেখেছেন, যা কোরোমিনাসের ২৩ গোলে অবদানের আগের নজিরকেও ছাড়িয়ে যায়।

মরক্কোর এই স্ট্রাইকারের নিরন্তর আক্রমণাত্মক মনোভাবই তাঁকে ৪৭টি অন টার্গেট শট নিতে সাহায্য করে। তাঁর শট-টু-গোল অনুপাত ছিল অসাধারণ — লক্ষ্যে থাকা শটের প্রায় অর্ধেকেই গোল হয়। তাঁর এই অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যের ফলে তিনি একই মরশুমে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসির সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে উঠেছেন। পিছনে ফেলে দিয়েছেন আর এক আইএসএল কিংবদন্তি বারথলোমিউ ওগবেচেকে।

প্রতি মরশুমেই আইএসএলে নতুন তারকারা উঠে আসে। কিন্তু ২০২৪-২৫ মরশুমে আলাদিন আজারেই যা করেছেন, তা একেবারে ব্লকবাস্টার সিনেমার মতো। ডুরান্ড কাপ জয় করার পর নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি আইএসএলে শেষ পর্যন্ত সামান্য পিছিয়ে পড়লেও, তারা এমন এক মরশুম উপহার দিয়েছে যা দীর্ঘদিন ফুটবলপ্রেমীদের মনে থাকবে। এক স্ট্রাইকারের নেতৃত্বে, যাঁর খেলা দেখে মনে হত তাঁর বুটে লুকনো আছে কোনও জাদু। এ জন্য কোনও দৈত্য বা জাদুর প্রদীপের প্রয়োজন পড়েনি। শুধু আজারেই ছিলেন যথেষ্ট।