তিনি কলকাতার জামাই, ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি এবং তিনি যাঁর জামাই, তিনি আবার মোহনবাগানের ঘরের ছেলে বলে পরিচিত। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, কার জামাইয়ের কথা বলা হচ্ছে এখানে এবং কে সেই জামাই। ঠিকই ধরেছেন, সুনীল ছেত্রীর কথাই বলছি এবং তিনি যে বাংলার ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা সুব্রত ভট্টাচার্যের জামাই, তাও অনেকেই জানেন।

সেই সুব্রত ভট্টাচার্য আজ ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ফাইনালে কার সাফল্যে খুশি হবেন, তা বোধহয় তিনি নিজেই জানেন না। আজ সন্ধ্যায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আইএসএল ফাইনালে সুনীল ছেত্রী ভাল খেললে, গোল করলে তিনি যেমন খুশি হবেন, তেমনই মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট কাপ হাতে তুললেও তো কম খুশি হবেন না। কোনটাতে বেশি খুশি হবেন, তা তাঁরই সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রশ্ন হল তাঁর দুই চাহিদাই কি পূরণ হওয়া সম্ভব?

মানেটা খুব স্পষ্ট, সুনীল ছেত্রী ভাল খেললে, গোল পেলে কি মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের দ্বিমুকুট জয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও। কিন্তু চলতি আইএসএল মরশুমে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন সুনীল ছেত্রী, তার পরে তো এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

প্রথম সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে সবাই যখন ধরেই নিয়েছিলেন নির্ধারিত সময়ে এফসি গোয়া দু’গোলে এগিয়ে থাকায় ম্যাচের ফয়সালা হয় অতিরিক্ত সময়ে, নয় পেনাল্টি শুট আউটে হবে, ঠিক তখনই প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে শরীরকে সামনের দিকে ভাসিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত হেড করে যে গোলটি করেছিলেন সুনীল, তা শুধু দর্শনীয় ছিল না, ছিল অভাবনীয়।

ম্যাচের শেষ মুহূর্তে সুনীল ছেত্রীকে নিজেদের বক্সের মধ্যে ছেড়ে রাখলে যে তার কত বড় মাশুল দিতে হয়, সে দিন তা টের পেয়ে যান এফসি গোয়ার ফুটবলাররা। অসাধারণ সেই গোলই বেঙ্গালুরু এফসি-কে ফাইনালে সবুজ-মেরুন বাহিনীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শনিবার ফাইনালে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টও একই ভুল করবে না তো?

লিগশিল্ড জয়ী দলের কোচ হোসে মোলিনা বরাবরই বলে থাকেন, “প্রতিপক্ষের কোনও একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করি না আমি। পুরো দলটাকে কী ভাবে আটকাব, তাদের হারাব, সেই পরিকল্পনাই করি”। কিন্তু সত্যিই ফাইনালে যদি সুনীল ছেত্রীকে আটকে রাখার জন্য আলাদা ও বিশেষ কোনও পরিকল্পনা না থাকে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের, তা হলে জামশেদপুর এফসি-র মতোই আফসোস করতে হতে পারে তাদের।

আইএসএলের পরিসংখ্যান বলছে ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে, সংযুক্ত সময়ে ন’টি গোল করেছেন সুনীল। এই তালিকায় যিনি দ্বিতীয়, তিনি রয় কৃষ্ণা, যাঁর ছ’টি স্টপেজ টাইম গোল রয়েছে আইএসএলে। যদি সুনীলের এ মরশুমের গোলগুলির কথা মনে করেন, তা হলে দেখবেন ১৪টি গোলের মধ্যে বেশ কয়েকটি গোল তিনি ম্যাচের শেষ কোয়ার্টারে ও সংযুক্ত সময়ে করেছেন।

এ মরশুমে বেঙ্গালুরুর দ্বিতীয় ম্যাচেই যে জোড়া গোল করেন সুনীল, দু’টিই ছিল শেষ কোয়ার্টারে, ৮৫ মিনিটের মাথায় ও সংযুক্ত সময়ের চার মিনিটের মাথায়, পেনাল্টি থেকে। হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ৩-০-য় জেতে বেঙ্গালুরু। কলকাতায় মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে ২-১-এ জেতা ম্যাচে দলের প্রথম গোলটি ছিল তাঁরই এবং সেটিও পেনাল্টি থেকে তিনি করেন ৮২ মিনিটের মাথায়।

কান্তিরাভায় কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন সুনীল। সে দিন শেষ গোলটিও তিনি করেছিলেন সংযুক্ত সময়ের আট মিনিটের মাথায়। দ্বিতীয় গোলটি তিনি করেছিলেন শেষ কোয়ার্টার শুরুর ঠিক দু’মিনিট আগে। হায়দরাবাদে তাদের ১-১ ড্রয়ে একমাত্র গোলটি সুনীল করেছিলেন ৭৮ মিনিটের মাথায়।

এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল এফসি-র বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরুর ম্যাচের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ইস্টবেঙ্গলের হাতের মুঠোয় যখন জয় কার্যত চলেই এসেছিল, ঠিক তখনই পেনাল্টি পায় বেঙ্গালুরু এফসি এবং সংযুক্ত সময়ের প্রথম মিনিটে সেই পেনাল্টি থেকে গোল পান সেই সুনীল ছেত্রী। প্লে অফের প্রথম ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে ৫-০ জয়ে সুনীল চতুর্থ গোলটি করেন ৭৬ মিনিটের মাথায়। আর এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে গোলের কথা তো আগেই আলোচনা হয়েছে।

ম্যাচের শেষ দিকে, যখন উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে, তখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে গোল করার মতো মানসিক নিয়ন্ত্রণ রাখাটাই একজন ফরোয়ার্ডের সবচেয়ে বড় গুণ। শেষ দিকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেওয়া মানে প্রতিপক্ষের দিকে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। এই কাজটা সুনীল এ বারের লিগে একবার নয়, বারবার করে এসেছেন। তাই শনিবার তাঁকে আটকে রাখতে না পারলে সমস্যায় পড়তে পারে সবুজ-মেরুন বাহিনী।

আইএসএল প্লে-অফে খেলার যে অভিজ্ঞতা রয়েছে সুনীল ছেত্রীর, সেই অভিজ্ঞতা আজকের ফাইনালে খেলা অন্যান্য ফুটবলারদের কারও আছে বলে মনে হয় না। বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে ১৫টি প্লে-অফ ম্যাচে খেলেছেন তিনি। নক আউট পর্বে দশটি গোল করেছেন তিনি এবং একটি অ্যাসিস্ট করেছেন। ২০১৭-১৮ মরশুমে নক আউট ম্যাচগুলিতে চারটি গোল করেছিলেন। তার মধ্যে একটিতে হ্যাটট্রিক ছিল, দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পুণে সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে। ফাইনালেও চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন তিনি। কিন্তু দলকে জেতাতে পারেননি। ২০১৮-১৯-এও সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে গোল করেছিলেন সুনীল। সে বার চ্যাম্পিয়ন হয় বেঙ্গালুরু এফসি।

আইএসএল প্লে অফে এমন যাঁর সাফল্য, তাঁকে নজরে না রাখাটাই একটা বড় ভুল। আজ মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ডিফেন্ডাররা সেই ভুল করবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সুনীলকে আটকাবেন কে? মোহনবাগানের চার ডিফেন্ডারের সবাইকেই হয়তো সেই দায়িত্ব দেবেন মোলিনা। মাঝমাঠে তাঁকে কড়া পাহাড়ায় রাখার দায়িত্ব নিতে পারেন আপুইয়া। পাশাপাশি রায়ান উইলিয়ামস, আলবার্তো নগুয়েরাদেরও ছেড়ে রাখা যাবে না।

বেঙ্গালুরু এফসি-র কোচ জেরার্ড জারাগোজা তাঁর দলের এই কিংবদন্তি তারকাকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাও বেশ মনে রাখার মতো। শুক্রবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সুনীল ছেত্রী আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ও আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। প্রত্যেকদিন অনুশীলনে ওকে সেরা হতেই হবে। ম্যাচে নামলে ওকে জিততেই হবে। আমার মনে হয় ওর এই লিগের সেরা খেলোয়াড় হওয়া উচিত। আশা করি, কাল রাতটা ওরই রাত হবে”।

সুনীলের দীর্ঘদিনের সঙ্গী গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধু-র মতে, “আগে ওর শরীরে ১১ শতাংশ মেদ ছিল। গত দশ বছরে এখন সেটা ৬ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। এখন সে বাবা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো ওর জীবনে এলেও পেশাদারিত্বে একফোঁটা পরিবর্তন হয়নি। অনেক সুযোগ পেয়েছে, কানসাস সিটিতে গিয়েছিল। সেখান থেকে অনেক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করে ফিরেছে। ও একজন যথার্থ দলনেতা। ভারতীয় দলেও ওর প্রভাব যথেষ্ট। ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে পেরে আমরা খুশি। এই বয়সেও যে ও খেলে যাচ্ছে, এতে আমি অবাক হই না”।

সুনীল নিজে অবশ্য ফাইনালের আগে একটিও শব্দ খরচ করেননি। ক্লাবের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “দু’বছর আগে গোয়ায় যখন ফাইনালে হেরে গিয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল কী করে হেরে গেলাম? সন্দেশ ঝিঙ্গনের সঙ্গে এই নিয়ে কথাও হয় আমার। মোহনবাগানের পাঁচটা অসাধারণ পেনাল্টির জন্যই হেরে গিয়েছিলাম সেদিন। মনে আছে, ৮০ মিনিটে আমরা লিড ধরে রাখতে পারিনি। তবে সে সব অতীত। এখন একটা নতুন ফাইনাল আমাদের সামনে। জানুয়ারিতে যে রকম দুঃসময় এসেছিল, তার পরেও যে আমরা ফাইনালে উঠতে পেরেছি, সে জন্য আমি খুব খুশি। সেই ম্যাচের অপেক্ষাতেই আছি এখন”।

তাঁর দল কতটা উজ্জীবিত হয়ে শনিবার মাঠে নামবে এবং কতটা ভাল ফুটবল খেলতে পারবে তারা, তা তো আজ সন্ধ্যাতেই জানা যাবে। কিন্তু সুনীল ছেত্রী নিজে কতটা উজ্জীবিত হয়ে খেলবেন এবং কোন মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দেবেন, তার ওপর হয়তো অনেকটাই নির্ভর করবে আজকের ম্যাচের ফয়সালা। জারাগোজা যেমন বলেছেন, একটা ভাল ফুটবল ম্যাচ দেখতে চান আজ, সে রকম একই ইচ্ছা নিয়ে অনেকে মাঠে যাবেন, অনেকে টিভি, মোবাইলের সামনে বসবেন।