গত মরশুমে ডুরান্ড কাপে রানার্স আপ ট্রফি জেতার পর কলিঙ্গ সুপার কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। কিন্তু ইন্ডিয়ান সুপার লিগের প্লে অফে উঠতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল এফসি। আগামী মরশুমে তারা আইএসএলেও ভাল কিছু করার আশ্বাস দিচ্ছেন তাদের স্প্যানিশ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। ক্লাবের ওয়েবসাইটকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আগামী মরশুমের জন্য এমন এক দল গড়তে চলেছে ইস্টবেঙ্গল এফসি, যার জন্য গর্ববোধ করতে হবে সমর্থকদের। গত মরশুমের ব্যর্থতার ব্যাখ্যাও তিনি দেন এই সাক্ষাৎকারে।

গত মরশুমেই যে আসন্ন মরশুমে সাফল্যের ইঙ্গিত পেয়েছেন তিনি, তা জানিয়ে কুয়াদ্রাত বলেন, “সমর্থকদের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম একটা টুর্নামেন্টে (সুপার কাপ) চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওরা কত গর্বিত হয়েছে। ওরা বিশ্বাস করে, ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু হতে চলেছে। আমরা এশীয় স্তরের টুর্নামেন্টে খেলতে চলেছি। আমাদের হাতে ভাল দল রয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৭ ও ২১-এ আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি এবং রানার্স হয়েছি। বছর দুয়েকের প্রচেষ্টায় অবশ্যই ভাল কিছু হবে। যে ভাবে গত মরশুমে চেষ্টা করেছি আমরা, একই ভাবে যদি আগামী মরশুমেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি, তা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল”।

সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ইস্টবেঙ্গল কোচ বলেন, “সমর্থকদের আশাবাদী হওয়া উচিত। একটা আকর্ষণীয় মরশুম রয়েছে আমাদের সামনে, যেখানে দেশের নামও উজ্জ্বল করার চ্যালেঞ্জ থাকবে আমাদের সামনে। আমরা আবার এশীয় মঞ্চে ফিরে আসছি এবং এমন একটা দল গড়তে চলেছি, যা নিয়ে সমর্থকেরা গর্বিত হতে পারেন। তাদের বলব আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। নতুন ইস্টবেঙ্গলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছে। আমরা ঠিক দিকেই এগোচ্ছি”।

২০২৩-২৪ মরশুমে ১২ বছর পর কোনও জাতীয় স্তরের খেতাব (কলিঙ্গ সুপার কাপ) জেতে তারা, যার ফলে আসন্ন এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর যোগ্যতা অর্জন পর্বে খেলতে পারবে ইস্টবেঙ্গল। গত মরশুমের পারফরম্যান্স নিয়ে কুয়াদ্রাত বলেন, “আমরা মরশুমের তিনটি টুর্নামেন্টের মধ্যে দু’টির ফাইনালে উঠেছি। একটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। অর্থাৎ, ফল পেতে শুরু করেছি, যা আগের মরশুমগুলিতে পাইনি। ১২ বছর বাদে খেতাব জিতেছি আমরা। যে কোনও দলের কাছেই আমরা কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছি। শেষ বাঁশি বাজার মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার ক্ষমতা আছে আমাদের দলের। সারা মরশুমে যত ম্যাচ খেলেছি আমরা, তার মধ্যে অর্ধেক জিতেছি (৩৩টি ম্যাচে ১৪টি জয়)। সবচেয়ে বড় কথা গোল খাওয়ার চেয়ে বেশি গোল করেছি আমরা। যা গত কয়েক বছরে হয়নি। আমরা একটা ভাল ও ধারাবাহিক দল গঠন করা শুরু করেছি, যারা যে কোনও দলকে হারাতে পারে”।

গত মরশুমে ওডিশা এফসি-কে তাদের ঘরের মাঠে হারিয়ে সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া প্রসঙ্গে কুয়াদ্রাত বলেন, “ফুটবলারদের বুঝিয়েছি যে, তারা এমন একটা ক্লাবের হয়ে খেলে, যারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। লক্ষ্য লক্ষ্য সমর্থক আমাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে সমর্থন করে। এই ক্লাবের ঐতিহ্য, ইতিহাস আছে। এই ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়ার চল্লিশ বছর পরেও অনেক কোচ ও ফুটবলারকে এখনও লোকে মনে রেখেছে। এ মরশুমে ওডিশা এফসি-কে তাদের ঘরের মাঠে একমাত্র ইস্টবেঙ্গলই হারাতে পেরেছে। তাও ফাইনালে এবং বিরতিতে এক গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও।

ঝুঁকি নিয়ে দুটো পরিবর্তন করেছিলাম সে দিন। মন্দার ও সিভেরিওকে তুলে নিই। কঠিন প্রতিপক্ষের ডেরায় গিয়ে তাদের হারিয়ে খেতাব জেতাটা সত্যিই বড় কৃতিত্ব। সমর্থকেরা সেখানে আমাদের জন্য এমন গলা ফাটিয়েছে যে স্থানীয় সমর্থকদের আওয়াজও তাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এটাই দলের ছেলেদের বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এই ক্লাবের সমর্থকদের জন্য লাল-হলুদ জার্সি গায়ে প্রতি মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করা উচিত তোমাদের”।
সুপার কাপ জিতে কলকাতায় ফেরার দিনের কথাও চিরকাল মনে রাখবেন বলে জানিয়েছেন লাল-হলুদ কোচ। বলেন, “জানুয়ারিতে কলিঙ্গ সুপার কাপ নিয়ে যে দিন আমরা কলকাতায় ফিরি, সে দিন ক্লাবের সমর্থকেরা সবাই আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিল। বিমানবন্দরে হাজার হাজার সমর্থক আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল। বিমানবন্দরের রাস্তা দিয়ে যেতে সে দিন আমাদের তিন ঘণ্টা লেগে যায়। টিম বাসের সঙ্গে সঙ্গে বাইকে চেপে সমর্থকেরাও আমাদের সঙ্গে ক্লাব পর্যন্ত যায়। সে এক দেখার দৃশ্য। চারদিকে শুধু লাল-হলুদ জার্সি আর পতাকা। প্রায় সবার চোখেই জল। আসাধারণ এই অভিজ্ঞতা ভোলার মতো নয়। এই দেখে আমার ১৯৯২-তে বার্সার লিগ খেতাব জয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এ বার্সেলোনা ও ইস্টবেঙ্গলের মতো সমর্থকে ভরা ক্লাবেই সম্ভব। আশা করি, এমন উল্লাস, উত্তেজনার ছবি আরও দেখা যাবে ভবিষ্যতে”।

গত মরশুমের আগে বিপন্ন ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল সেটি। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়াই তাঁর কোচিং জীবনের সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন বেঙ্গালুরু এফসি-কে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করা কোচ। এর ব্যাখ্যা দিয়ে কুয়াদ্রাত বলেন, “বার্সেলোনায় থাকতে চাপ সামলাতে শিখেছি আমি। বরং চাপের মুখে আরও মোটিভেশন পাই আর চাপই চরম সঙ্কটে আমার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারে। তাই ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেওয়াটা আমার কাছে খুবই উচিত সিদ্ধান্ত ছিল। আমার কেরিয়ারের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিল ওটা”।

গত মরশুমের আগে যে দলের তারকা উইঙ্গার নাওরেম মহেশ সিং ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে অন্য দলে চলে যেতে চেয়েছিলেন, তা জানিয়ে কোচ বলেন, “আমার মনে আছে, মরশুমের শুরুতে যখন মহেশের সঙ্গে আমি আর দিমাস (দেলগাদো) কথা বলি, তখন ও অনেক জায়গা থেকে ওকে প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে থাকলে কোনও ট্রফি পাবে না। ফলে ওর ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু মহেশ আমাদের প্রকল্পের ওপর আস্থা রাখে ও আমাদের সঙ্গেই থেকে যায়। তার ফল ও চার মাস পরেই পেয়েছে, ট্রফি জিতে”।

দলের কয়েকজন সেরা খেলোয়াড়কে সঙ্গে নিয়েই যে আগামী মরশুম শুরু করবেন, এমনই আশা ব্যক্ত করে কার্লস কুয়াদ্রাত বলেন, “দলের ওপর খেলোয়াড়দের আস্থা বজায় থাকাটা খুবই জরুরি। ফুটবলারদের অনেকেই আমাদের ক্লাবে খেলে খুশি। তারা আমাদের পরিকল্পনা, আমাদের প্রয়োজন, সেট-পিস প্ল্যান, ট্রেনিং পদ্ধতি সবই জানে। সে জন্যই দলের দায়িত্ব পেয়ে এমন কয়েকজন খেলোয়াড়কে দলে এনেছিলাম, যারা আমাকে সেই বেঙ্গালুরু এফসি-র সময় থেকে চেনে। ওদের নিয়েই কাজ শুরু করে আমরা মরশুমের শুরুতে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে উঠি। এখন আমার হাতে যখন একটা কোর টিম আছে, তখন নতুন মরশুমের শুরু থেকেই আমরা একটা সুবিধা পাব এবং সেই সুবিধা আমাদের কাজে লাগাতে হবে”।

আইএসএল ১০-এর প্লে অফে পৌঁছতে না পারা কারণ ব্যাখ্যা করে ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ কোচ বলেন, “ওটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কেরালা ব্লাস্টার্স ও বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারানোর পরে দলের ছেলেরা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সাত দিনে তিনটি ম্যাচ খেলতে হয় আমাদের। পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে ওদের সব কিছু উজাড় করে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু ওরা ৭০ মিনিটের বেশি তা দিতে পারেনি। অজুহাত দিতে চাই না। তবে আসল সময়ে যদি দলের মধ্যে চোট-আঘাত ও কার্ড সমস্যা থাকে, তা হলে আর কীই বা করার থাকতে পারে? আশা করি ভারতীয় ফুটবলের ক্যালেন্ডার আরও উন্নত হবে। মরশুমের ৩৩টি ম্যাচের মধ্যে ১৭টিই আমরা খেলেছি তিন মাসের মধ্যে। এটা যুক্তিপূর্ণ নয়। আমাদের এর মাশুল গুনতে হয়েছে”।