সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের আশা জিইয়ে রাখলেন সেই সুনীল ছেত্রী। রবিবার রাতে মালের ন্যাশনাল ফুটবল স্টেডিয়ামে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আট মিনিট আগে ম্যাচের একমাত্র গোল করে দলকে স্বস্তি এনে দেন ভারত অধিনায়ক। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৭৭তম গোল করে ফুটবল কিংবদন্তি পেলের মাইলস্টোনটি তিনি এ দিনই ছুঁয়ে ফেললেন।

টানা দুই ম্যাচে জিতে প্রায় ফাইনালের পথে পা বাড়ানো নেপালের ওপর রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করে খেললেও ভারত কিন্তু এ দিন সারা ম্যাচে বিপক্ষের গোলের মুখ খুলতে ব্যর্থ হয় বারবার। গত ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যে রোগে ভুগছিল গোটা ভারতীয় দল, এ দিনও সেই রোগের উপসর্গ দেখা দেয় ভারতের পারফরম্যান্সে। সুনীল নিজে যেমন একাধিক গোলের সুযোগ নষ্ট করেন, তেমনই তাঁর সতীর্থ স্ট্রাইকার মনবীর সিংও দুটি সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন। ম্যাচের শেষ দিকে সুনীল গোলটি না পেলে হয়তো এ দিনই সাত বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হত।

  • ৩৪ মিনিট: ডান দিক থেকে বক্সের মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে গোলের সামনে সুনীলের উদ্দেশ্যে মাপা ক্রস করেন প্রীতম। কিন্তু গোলের বাইরে বল পাঠান সুনীল।
  • ৬০ মিনিট: সুনীলের হেড থেকে গোলের সুযোগ পেয়ে যান মনবীর। কিন্তু নেপালের ডিফেন্ডার রোহিত চন্দের বাধায় সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন।
  • ৫৭ মিনিট: বক্সের ডানদিক থেকে গোলের সামনে বল ভাসিয়ে দেন ইয়াসির। মনবীর হেড করে গোলে বল ঠেললেও তা অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় সেভ করেন গোলকিপার কিরণ।
  • ৭৭ মিনিট: হাওয়ায় ভাসানো সেই ফ্রিকিকে মাথা ছুঁইয়ে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন শুভাশিস বসু। সোজা গোলকিপারের হাতে জমা পড়ে যায় তাঁর হেড।
  • ৮২ মিনিট: ব্র্যান্ডন বাঁ দিক থেকে একটি ক্রস করেন বক্সের মধ্যে। সেই ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ফারুখ বল পাঠান সুনীলের কাছে। গোলের সামনে বাঁ দিকে থাকা সুনীল বল গোলে ঠেলতে কোনও ভুল করেননি।

এ দিন ৭৫% বল পজেশন ছিল ভারতের। নেপাল যেখানে একটিও শট বিপক্ষের গোলে রাখতে পারেননি, সেখানে ভারত পাঁচটি গোলমুখী শট নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক গোলের বেশি দিতে পারেননি সুনীলরা। চলতি টুর্নামেন্টের প্রথম জয়ের ফলে ভারত তিন ম্যাচে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে লিগ তালিকার তিন নম্বর জায়গায় উঠে এল। তিনটি করে ম্যাচে ছয় পয়েন্ট করে পেয়ে এক ও দুই নম্বরে রয়েছে যথাক্রমে মলদ্বীপ ও নেপাল। তিন ম্যাচে চার পয়েন্ট পেয়ে বাংলাদেশ চার নম্বরে। গ্রুপ পর্বে আর শুধু বাংলাদেশ-নেপাল এবং ভারত-মলদ্বীপ ম্যাচ বাকি রয়েছে। শেষ ম্যাচে ভারত ও বাংলাদেশ জিতলে এই দুই দলই ফাইনালে খেলবে। তবে এই দুই দলই হেরে গেলে ফাইনালে মুখোমুখি হবে মলদ্বীপ ও নেপাল।

প্রথম একাদশে পাঁচটি পরিবর্তন করে এ দিন মাঠে নামে ভারত। প্রীতম কোটাল, লালেঙমাউইয়া, ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, ইয়াসির মহম্মদ ও মনবীর সিং শুরু থেকে খেলেন অনিরুদ্ধ থাপা, গ্ল্যান মার্টিন্স, সেরিটন ফার্নান্ডেজ, উদান্ত সিং ও লিস্টন কোলাসোর জায়গায়। ৪-২-৩-১ ছকে শুরু করে ভারত।

শুরু থেকেই এ দিন নেপালকে চাপে রাখার চেষ্টা করে। সুনীল ছেত্রীকেও আগের ম্যাচের তুলনায় কিছুটা তৎপর দেখা যায়। কিন্তু নেপালের ডিফেন্ডাররা তাঁকে যথারীতি কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন। প্রথম কুড়ি মিনিটে কোনও দলই ওপেন চান্স পায়নি। তবে বিপক্ষের ডিফেন্সকে বেশ চাপে রেখেছিল ভারত।

মনবীর, ইয়াসিররা বক্সের মধ্যে বল দিলেও কখনও বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের তৎপরতায়, কখনও ভারতীয় ফরেয়োর্ডদের ব্যর্থতায় সেই সুযোগগুলি নষ্ট হচ্ছিল। তবে ৩৪ মিনিটের মাথায় যে ভাবে ফাঁকা গোল পেয়েও তাতে বল ঠেলতে পারেননি সুনীল ছেত্রী, তা অবাক করার মতো। ডান দিক থেকে বক্সের মধ্যে ঢুকে গোলের সামনে সুনীলের উদ্দেশ্যে মাপা ক্রস করেন প্রীতম। কিন্তু গোলের বাইরে বল পাঠান সুনীল, যা তাঁর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত।

ম্যাচের প্রথম পজিটিভ চান্স পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি ভারত অধিনায়ক। গত ম্যাচেও দুটি এমন গোলের সুযোগ হাতছাড়া করতে দেখা যায় তাঁকে, যা তাঁর মতো অভিজ্ঞ তারকার পক্ষে বেশ বেমানান। এ দিনের সুযোগটা আরও সহজ ছিল।

ভারতের মাঝমাঠে ভুলের বহর ও রক্ষণে বোঝাপড়ার অভাব এ দিন কিছুটা কম দেখা গেলেও বিপক্ষের গোল এরিয়ায় অনেক ফাঁক ফোকর দেখা যায়। নেপালের কড়া রক্ষণকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। ৪২ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথায় সুনীলের হেড থেকে গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন মনবীর। কিন্তু নেপালের ডিফেন্ডার রোহিত চন্দ সমানে তাঁর সঙ্গে লেগে থাকায় সেই সুযোগও হাতছাড়া হয়। গোলশূন্য অবস্থাতেই বিরতিতে যায় দুই দল।

ফাইনালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নেপালের এ দিন একটি  ড্র-ই ছিল যথেষ্ট। তাই ভারতকে রোখার দিকেই বেশি নজর ছিল তাদের। সেই কাজটা যথেষ্ট ভাল ভাবে করেনও গৌতম শ্রেষ্ঠা, দীনেশ রাজবংশীরা। ৫৭ মিনিটের মাথায় মনবীর ফের সুযোগ পান একেবারে গোলের সামনে থেকে। বক্সের ডানদিক থেকে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ডজ করে গোলের সামনে বল ভাসিয়ে দেন ইয়াসির। মনবীর হেড করে গোলে বল ঠেললেও তা অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় সেভ করেন গোলকিপার কিরণ লিম্বু।

মনবীরের এই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরেই তাঁকে বাইরে ডেকে নেন কোচ স্টিমাচ ও তাঁর জায়গায় নামান উদান্ত সিংকে। একই সঙ্গে সুরেশের জায়গায় নামান অনিরুদ্ধ থাপাকে। নির্ধারিত সময়ের কুড়ি মিনিট বাকি থাকতে মন্দার ও ইয়াসিরকে বসিয়ে নামানো হয় লিস্টন কোলাসো ও ফারুখ চৌধুরিকেও। ১৫ মিনিটের ব্যবধানে চারটি পরিবর্তন করার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল আক্রমণে গতি বাড়ানো।

তাতে গতি কিছুটা বাড়লেও গোলের মুখ খোলার কাজটা তখনও করে উঠতে পারেনি ভারত। কারণ, খেলা যত শেষের দিকে এগোয়, ততই নেপালের রক্ষণ আরও জমাট বাঁধে। এক্ষেত্রে সেট পিস ছাড়া উপায় ছিল না। সেই সুযোগও পায় ভারত। ৭৭ মিনিটের মাথায় বক্সের সামনে ফ্রি কিক পায় তারা। ব্র্যান্ডনের হাওয়ায় ভাসানো সেই ফ্রিকিকে মাথা ছুঁইয়ে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন শুভাশিস বসু। সোজা গোলকিপারের হাতে জমা পড়ে যায় তাঁর মাথা ছোঁয়ানো বল।        

এর দু’মিনিট পরে ফের ব্র্যান্ডনের কর্নারে হেড করে বিপক্ষের জালে বল জড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান সুনীল। কিন্তু এ বার তাঁর মাথা থেকে বল মাঠে ড্রপ করে বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। অবশেষে ৮২ মিনিটের মাথায় নিজের ৭৭তম আন্তর্জাতিক গোলটি করে দলকে স্বস্তি এনে দেন সুনীল ছেত্রী। ব্র্যান্ডন বাঁ দিক থেকে একটি ক্রস করেন বক্সের মধ্যে। সেই ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ফারুখ বল পাঠান সুনীলের কাছে। গোলের সামনে বাঁ দিক বল গোলে ঠেলতে এ বার কোনও ভুল করেননি তিনি। এই গোলটি করে কিংবদন্তি পেলেকে ছুঁলেন সুনীল। পেলেরও আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যা ৭৭।

গোল খাওয়ার পরেই তা শোধ করার জন্য কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়ে নেপাল। ৮৬ মিনিটের মাথায় অঞ্জন বিস্তা ও ৯০ মিনিটের মাথায় সুমন আরিয়াল সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন সমতা আনার। অনন্ত তামাংও স্টপেজ টাইমে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম দু’বার নিজেদের ভুলে ও শেষবার শুভাশিসের তৎপরতায় গোল শোধ করতে পারেননি তাঁরা।

ম্যাচের শেষে সুনীল টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নেন, “গোলের সামনে আমরা খুবই দুর্বল ছিলাম। তিনটে পয়েন্ট যে অর্জন করতে পেরেছি আমরা, এটাই অনেক। তবে বিপক্ষকে চাপে রাখার কাজে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। এখনও যে টুর্নামেন্টে আমাদের আশা জিইয়ে রইল, এটাই সবচেয়ে বড় কথা”।  

ভারতীয় দল: গুরপ্রীত সিং সান্ধু (গোল), রাহুল ভেকে, প্রীতম কোটাল, শুভাশিস বসু, মন্দার রাও দেশাই (লিস্টন কোলাসো), লালেঙমাউইয়া (সাহাল আব্দুল সামাদ), ইয়াসির মহম্মদ (ফারুখ চৌধুরি), সুরেশ সিং (অনিরুদ্ধ থাপা), ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ, মনবীর সিং (উদান্ত সিং), সুনীল ছেত্রী।