গত হিরো আইএসএলের গোল্ডেন বল জয়ী ফুটবলার রয় কৃষ্ণাকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচশো ফুটবলারদের তালিকায় রাখল বিশ্বখ্যাত ফুটবল ম্যাগাজিন ওয়ার্ল্ড সকার। সম্প্রতি তাদের বিশেষ সংখ্যায় সারা দুনিয়ার যে ৫০০ জন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে এটিকে মোহনবাগানের তারকা ফরোয়ার্ড রয় কৃষ্ণারও প্রশংসা করে তাঁকে নিয়েও বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

যে দেশে ফুটবলের চেয়ে রাগবি অনেক বেশি জনপ্রিয়, সেই ফিজি থেকে উঠে এসে কী ভাবে ফুটবল খেলে নিজেকে ক্রমশ তারকার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করলেন, তার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে এই বিখ্যাত ফুটবল পত্রিকার পাতায়। রয়কে নিয়ে লেখা হয়েছে, শুরুতে ওয়েলিংটন ফিনিক্স থেকে বাতিল হওয়ার পর ২০০৯-এ বিখ্যাত ডাচ ক্লাব পিএসভি-তে ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ পান এই ফুটবলার। ওই দ্বীপরাষ্ট্রের এক ফুটবলারের কাছে যা ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু তিনি এ লিগে খেলার দিকেই বেশি মন দেন এবং ওয়েটাকেরে ইউনাইটেডে সই করে ৭৫ ম্যাচে ৫৫ গোল করে তাঁর বর্ণময় ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেন

যারা তাঁকে প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই ওয়েলিংটন ফিনিক্স-ই রয় কৃষ্ণাকে পাঁচ বছরের মধ্যে রীতিমতো মোটা অঙ্কের প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে আসে ও ১২২ ম্যাচে ৫১ গোল করে তিনি সেই ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসন অর্জন করেন। সেই ঘটনার কথাও লেখা হয়েছে এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। ২০১৬ অলিম্পিক্সে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তাঁর দেওয়া গোলের উল্লেখও রয়েছে এই লেখায়।

ওয়েলিংটন ফিনিক্সের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ২০১৯-এ তাঁর ভারতে চলে আসার কথাও বলা হয়েছে এই পত্রিকায়। এটিকে এফসি-র হয়ে ভারতের এক নম্বর ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে প্রথম বছর খেলেই ১৫ গোল করেন রয়। এটিকে-র সঙ্গে মোহনবাগানের সংযুক্তির পরেও তিনি ভারতেই থেকে যান ও দলের অন্যতম অধিনায়কও হয়ে ওঠেন। নতুন দল লিগে দ্বিতীয় স্থান পেলেও কৃষ্ণা কিন্তু এ বারেও সর্বোচ্চ গোলদাতার শিরোপা অর্জন করেন, লেখা হয়েছে এই প্রবন্ধে।

মন্তব্য করা হয়েছে, মাঠে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা প্যাসিফিক অঞ্চলের ফুটবল মহলে তাঁকে কিংবদন্তির আসনে বসিয়ে দিয়েছে। যার ফলে ওই অঞ্চলের বহু তরুণ ফুটবলারের কাছে এখন তিনি প্রেরণা। অকল্যান্ড সিটির ব্রায়ান ক্যালটাক, পাপুয়া নিউ গিনির স্ট্রাইকার টমি সেমিদের তিনি শিখিয়েছেন রাগবির দেশ থেকে উঠে এসেও ফুটবলার হিসেবে নাম করা যায়। ভারতে যে পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন রয় কৃষ্ণা, তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখন মোটেই তিনি অবসরের কথা ভাবছেন না

আসন্ন হিরো আইএসএলেও গোলের বন্যা বইয়ে দেওয়ার জন্য সবুজ-মেরুন শিবিরে হুগো বুমৌস, ইওনি কাউকোর সঙ্গে থাকছেন রয়। ভারতে এসে প্রথম মরশুমে ১৫টি ও দ্বিতীয় মরশুমে ১৪টি গোল করার পরে এ বার তিনি কতগুলো গোল করেন, সেটাই হতে চলেছে লিগের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়।

গত মরশুমে এটিকে মোহনবাগান সাফল্যের মুকুট জিততে না পারলেও তাদের সেরা তারকা রয় কৃষ্ণা যে খেলা দেখান, তাঁকে অসাধারণ বললেও বোধহয় কম বলা হয়। সারা লিগ জুড়ে যে দাপট ও ক্ষিপ্রতা দেখা গিয়েছিল এই ফিজিয়ান তারকা স্ট্রাইকারের পারফরম্যান্সে, তাতে এটিকে মোহনবাগানের প্রত্যেক প্রতিপক্ষ তাঁকে রীতিমতো সমীহ করে। তাঁকে আটকানোর জন্য আলাদা করে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হয়েছিল প্রত্যেক কোচকে। যাঁদের পরিকল্পনা কার্যকরী হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে রয় হয়তো গোল পাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে পুরোপুরি আটকানোর সাধ্য হয়নি কারও। গোল করিয়ে নিজের কর্তব্য ঠিক পালন করেছিলেন তিনি।

তাঁর অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখে দলের স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস বলতে বাধ্য হন, গত মরশুমের মতোই রয় এ বারও আমার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। প্রথম কয়েকটা ম্যাচে ও নিজের সেরাটা দিতে পারেনি। কারণ, ছমাস ফুটবলের বাইরে ছিল ও। কিন্তু এখন ও আমার কাছে লিগের সেরা খেলোয়াড়

গতবার লিগ পর্বে এটিকে মোহনবাগান যে কটি গোল করেছিল, তার অর্ধেকই রয়ের করা। তিনি স্ট্রাইকার, গোল করাই যে তাঁর কাজ, তা ঠিকই। কিন্তু রয়ের কাজ যে শুধু গোল করা নয়। তা তিনি বহুবার প্রমাণ করেছেন। আক্রমণ বিভাগে তিনি যেমন সর্বদা তৎপর, তেমনই মাঝমাঠের সঙ্গে আক্রমণের যোগসূত্র স্থাপন করার কাজটাও নিয়মিত করেছেন রয়।

এমনকী, মাঝে মাঝে রক্ষণ বিভাগে নেমে এসে তাঁকে বিপক্ষের আক্রমণকারীদেরও সামলাতে দেখা যায়। সে ম্যাচের শুরুর দিকেই হোক বা শেষের দিকে। এ রকম একজন ফুটবলার সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ালে তাঁর সতীর্থরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। তাই যে কোনও কোচের কাছেই প্রিয় ফুটবলার হয়ে উঠতে পারেন রয়। সে জন্যই এ বারও রয় কৃষ্ণাকে হাতছাড়া করেনি এটিকে মোহনবাগান। দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগ হিরো আইএসএলে অংশগ্রহনকারী একাধিক ক্লাব তাঁকে বিশাল অর্থ-সহ প্রস্তাব দিয়ে রাখলেও সবাইকে পিছনে ফেলে কলকাতার ক্লাবই তাদের প্রিয় তারকাকে রেখে দেয় নিজেদের কাছেই।

গোল না করেও যে তিনি দলের সাফল্যে অবদান রাখতে পারেন, তার উদাহরণ রয় দেন নক আউট পর্বে। তিনটি ম্যাচে কোনও গোল পাননি তিনি। কিন্তু এই তিন ম্যাচে যে চারটি গোল পেয়েছে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড, তার প্রত্যেকটাতেই অ্যাসিস্ট করেন তিনি। লিগ পর্বেও চারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ গোলেও সাহায্য করেন তিনি। ১৪টি গোলের সঙ্গে তাই আটটি অ্যাসিস্ট-ও জমা হয় তাঁর পারফরম্যান্সের খতিয়ানে। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে মোট ৩২টি গোলের মধ্যে সব মিলিয়ে ২২টিতেই তাঁর অবদান ছিল। প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে।

গতবারের মতো এ বারও যে তিনি নিজের সেরাটাই দিতে চান, তা জানিয়ে রয় বলেন, দলকে ট্রফি জেতানোর জন্য নিজের সেরাটাই দিই। সব ম্যাচেই জেতাতে চাই দলকে। গত বার ভাল খেলা সত্ত্বেও গতবার আমরা ট্রফি জিততে পারিনি। কিন্তু সে এখন অতীত। এখন আর সে দিকে ফিরে তাকাতে চাই না