বছরের শেষ সপ্তাহে দলকে যে ছুটি দিয়েছিলেন এটিকে এফসি-র কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস, তাতে যে তাঁর দলের ফুটবলাররা কতটা তরতাজা হয়ে উঠেছেন, তা বোঝা গেল শনিবার রাতে মুম্বই ফুটবল এরিনায়। চলতি হিরো আইএসএলের সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়ে এ দিন সমর্থকদের যে ভাবে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন এটিকে-র ফুটবলাররা, তা অনবদ্য। মুম্বই সিটি এফসি-কে তাদের মাঠে ২-০ গোলে হারিয়ে দু’বারের চ্যাম্পিয়নরা ১১ ম্যাচে ২১ পয়েন্ট নিয়ে ফের উঠে পড়ল লিগ শীর্ষে। চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা প্রণয় হালদার ও রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামা মাইকেল সুসাইরাজের দর্শনীয় গোলে ফের এক নম্বরে পৌঁছে গেল। পুরো দলটার মধ্যে যে অনবদ্য টিমওয়ার্ক দেখা গেল এ দিন, তাতে কলকাতার সমর্থকেরা এ বার আইএসএল জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করতেই পারেন।

  • ম্যাচের শুরুতে মুম্বই সিটি এফসি বিপক্ষের ডিফেন্সে চিড় ধরাতে সফল হয়মোদু সুগু তিন মিনিটের মধ্যে দুটি গোলের সহজ সুযোগ পেয়েও নষ্ট করেন।
  • চোট সারিয়ে এই ম্যাচেই মাঠে ফেরেন প্রণয় হালদার ও সদ্য দলে যোগ দেওয়া স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ভিক্টর মনজিলও এ দিন মাঠে নেমে তাক লাগিয়ে দেন।
  • ২৯ মিনিটে বাঁ দিকের উইং বরাবর হাভির ফ্লিক ধরে রয় কৃষ্ণা থ্রু বাড়ান ডেভিড উইলিয়ামসকে। মাঝমাঠ থেকে একটা স্প্রিন্ট টেনে বক্সের ডানদিকে ঢুকে পড়া প্রণয়কে নিখুঁত ক্রস বাড়ান উইলিয়ামস, এবং গোল। কিন্তু গোলের পরেই পেশীতে টান ধরায় মাঠ ছাড়েন প্রণয় ও তাঁর বদলে নামেন সুসাইরাজ।
  • ৪৩ মিনিটে রয় কৃষ্ণার হেড থেকে বল পেয়েই বাঁ দিক দিয়ে তীরের গতিতে বক্সে ঢুকেই অনেকটা দূর থেকে কোনাকুনি শটে গোল করেন সুসাইরাজ।

কয়েক দিন আগেই  কলকাতায় এসে নামা ভিক্টর মনজিল ও চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা প্রণয় হালদারকে নামিয়ে কিছুটা চমকেই দেন  এটিকে-র কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। জয়েশ রানের আক্রমণাত্মক ভূমিকাও এ দিন ছিল চোখে পড়ার মতো। মুম্বইয়ের আক্রমণ আটকানোর জন্য চার ডিফেন্ডারে দল নামান স্প্যানিশ কোচ। মাঝখানে প্রণয়, ম্যান্ডি সোসা ও হাভিয়ে হার্নান্ডেজকে রেখে আক্রমণে রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসের পিছনে জয়েশ। এটাই ছিল হাবাসের ছক।

ভিক্টর মনজিল হিরো আইএসএলের প্রথম ম্যাচে নেমেই এ দিন সমর্থকদের মন জয় করে নেওয়ার মতো ফুটবল খেলেন। ডিফেন্সের বাঁধনটা তিনি প্রায় একাই তৈরি করে রাখেন সারাক্ষণ। ম্যাচের শুরুর দিকে মুম্বই সিটি এফসি বিপক্ষের ডিফেন্সে চিড় ধরাতে সফল হয়েছিল। মোদু সুগু তিন মিনিটের মধ্যে দুটি গোলের সুযোগ পেয়েও নষ্ট করেন। পরের দিকে কিন্তু আর তা হয়নি। ২০-২৫ মিনিট আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের খেলা হলেও তার পর থেকে কিন্তু ম্যাচের রাশ চলে যায় এটিকের হাতে।  হাভিয়ে হার্নান্ডেজ বক্সের সামনে পাওয়া ফ্রিকিক থেকে সোজা গোলে শট নিয়েছিলেন। মুম্বইয়ের গোলকিপার অমরিন্দর সিং দুর্দান্ত সেভ না করলে তখনই এগিয়ে যেত।

২২ মিনিটে জয়েশের পাস থেকে রয় কৃষ্ণাও প্রায় ফাঁকা গোল পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। কিন্তু এর সাত মিনিট পরেই যে ঘটনাটা ঘটে, তা অভাবনীয় বললেও বোধহয় কম বলা হয়। বাঁ দিকের উইং বরাবর হাভির ফ্লিক ধরে রয় কৃষ্ণা থ্রু বাড়ান বন্ধু ডেভিড উইলিয়ামসকে। কিন্তু ডেভিড যখন বল ধরে বক্সের মধ্যে গোলের সামনে বাঁদিকে চলে আসেন, তখন ডান দিকে ক্রস বাড়ানোর মতো কেউ ছিলেন না। ঠিক তখনই মাঝমাঠ থেকে একটা স্প্রিন্ট টেনে বক্সের ডানদিকে ঢুকে পড়েন প্রণয়। তাঁর এই দৌড়টাই কেউ ভাবতে পারেনি । এমনকী বিপক্ষের ডিফেন্ডাররাও না। বক্সে দ্রুত ঢুকে পড়া প্রণয়কে লক্ষ্য করে যে নিখুঁত ক্রসটা বাড়ান অস্ট্রেলিয়ান গোলমেশিন, তা থেকেই বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেন। প্রণয়।

কিন্তু হঠাৎ অত দ্রুত প্রায় ৫০ গজ দৌড়ে বক্সে ঢুকে পড়ায় সদ্য চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা প্রণয়ের পেশীতে ফের টান ধরে। গোলের পরেই তিনি মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। ভাগ্যদেবতা যে এ দিন কলকাতার ফুটবলারদের পাশেই ছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রণয় মাঠ ছাড়ায় মাইকেল সুসাইরাজ নেমে পড়ায়। জয়েশকে একটু ভিতরে নিয়ে এসে সুসাইরাজকে তাঁর নিয়মিত জায়গায়  নামান  কোচ।  এখানেই তাদের দ্বিতীয় গোলের সূচনা হয়।

মুম্বইয়ের রাইট ব্যাক শৌভিক চক্রবর্তীর সঙ্গে একটা এরিয়াল বল হেড করতে উঠে যে সাফল্য পান রয় কৃষ্ণা, সেটাই এই গোলটা তৈরি করে দেয়। কৃষ্ণার হেড থেকে পাওয়া বলটি পেয়েই তীরের গতিতে বক্সের দিকে দৌড়ন সুসাই এবং বক্সে ঢুকেই গোলের অনেকটা দূর থেকে কোনাকুনি শটে গোল করেন সুসাইরাজ। এই নিয়ে চলতি হিরো আইএসএলে প্রথম গোলটাও তামিলনাড়ুর এই উইঙ্গার করেছিলেন অনেকটা এ ভাবেই। ফের একটা অসাধারণ করলেন তিনি।

চলতি লিগের সেরা ম্যাচটা বোধহয় এদিনই খেলে এটিকে এফসি। পুরো দলটা যে টিমগেম এ দিন দেখিয়েছে মুম্বই ফুটবল এরিনার দর্শকদের, তাতে তাদের ফাইনালে ওঠার ইঙ্গিত স্পষ্ট।  মুম্বইয়ের ফুটবলাররা কিছুটা বিপক্ষের মাথা গরম করানোর চেষ্টা করলেও সেই ফাঁদে পা দেননি কলকাতার ফুটবলাররা।

পাওলো মাচাডোর অনুপস্থিতিতে যে মুম্বই সিটি এফসি-র সাপ্লাই লাইন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তা এ দিন তাদের দেখেই বোঝা গিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে পর্তুগীজ ফরোয়ার্ড মোদু সুগুই আক্রমণের কেন্দ্রে থেকে বারবার আক্রমণে তোলার চেষ্টা করছিলেন দলকে। তিনি নিজেও একবার বল বিপক্ষের জালে জড়িয়ে দেন। কিন্তু অফসাইড ছিলেন।  আক্রমণের ধার বাড়ানোর জন্য মুম্বইয়ের রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে কোচ জর্জ কোস্টা তিন মিডফিল্ডার কেভিন সার্জ, মহম্মদ রফিক ও বিদ্যানন্দ সিংকেও নামিয়ে দেন দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে।  কিন্তু এটিকে-র সংসারের নতুন সদস্য মনজিলের নেতৃত্বে বারবার তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। তবে এখানে এটিকে-র গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যের প্রশংসা করতেই হবে। তিনি একাধিক দুরন্ত সেভ করে দলকে বাঁচান এ দিন।

৭৩ মিনিটে অকল্পনীয় সেভ করেন তিনি। আমিন চেরমিতি, প্রতীক চৌধুরি বা সুগু গোল লাইনের সামনে থেকেও গোল করতে পারেননি। প্রথমে পোস্টে লেগে ফিরে আসে। পরে অরিন্দম অভাবনীয় সেভ করেন। যে মুম্বই সিটি এফসি এই আইএসএলে বহু গোল করেছে ৭৫ মিনিটের পরে, সেই মুম্বইকে আটকাতে হিমশিম খেয়ে যায় এটিকে ডিফেন্স ও গোলকিপার। ডিফেন্সে এ দিন মাতিয়ে দিয়েছেন দলের সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার সুমিত রথি। নিজেকে এতটাই ভাল ভাবে মেলে ধরেন তিনি যে, ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও বাছা হয় তাঁকেই।    

এর মধ্যে আবার এটিকে শিবিরের অন্যতম সেরা স্কোরার ডেভিড উইলিয়ামসের পেশীতে টান ধরায় তিনি মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। এটা হ্যামস্ট্রিং পুল হলে ডেভিডকে হয়তো পরের  ম্যাচে (কেরালা ব্লাস্টার্স) ঘরের মাঠে নাও পেতে পারে। তবে এটিকে-র পারফরম্যান্সে এ দিন যে অভূতপূর্ব উন্নতির লক্ষণ দেখা গেল, তাতে সমর্থকেরা লিগসেরা হয়ে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাই পর্বে খেলার ও তৃতীয় হিরো আইএসএল খেতাব দুটোরই স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারেন একসঙ্গে।