চলতি ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এ পর্যন্ত যে ১১২টি ম্যাচ খেলা হয়েছে, তাতে ২৯৪টি গোল হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি ম্যাচে গড়ে আড়াইটারও বেশি গোল হয়েছে এই লিগে। এই পর্যায়ে, মানে ১১২ ম্যাচের পরে অবশ্য এ বার গত দুই মরশুমের তুলনায় কম গোলই হয়েছে। ২০২০-২১-এ সংখ্যাটা ২৯০ হলেও ২১-২২-এ ৩৪৯ ও গতবার ৩৩৭। কিন্তু এ বার গোলের সংখ্যা কম হয়েছে। কারণ, এবার প্রতিটি দলই আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণ ও মাঝমাঠেও বাড়তি দক্ষতা দেখিয়েছে। কোচেরা যে গোল করার পাশাপাশি গোল আটকানোতেও গুরুত্ব দিচ্ছেন, এই পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ।

আবার আক্রমণ বিভাগের খেলোয়াড়দেরও বাড়তি দায়িত্ব নিতে দেখা গিয়েছে। তাঁরা যে শুধু নিজেরা গোল করছেন, তা নয় সতীর্থদের গোল করতেও সাহায্য করছেন। যার পরিসংখ্যানও বেশ ইতিবাচক। আধুনিক ফুটবলে ফরোয়ার্ড, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের দায়িত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তাদের এখন শুধু প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় দেখা যায় না। নেমে এসে প্রায়ই রক্ষণে সাহায্য করতেও দেখা যায় এবং কখনও সখনও মাঝমাঠ সামলাতেও দেখা যায়। যার ফলে অনেকেই এখন গোল করার চেয়ে গোল করানোয়ও সফল হচ্ছেন। কোচেরাও তাঁদের সে রকমই দায়িত্ব দিচ্ছেন।  

এ বারের লিগে বেশ কিছু এমন গোল দেখা গিয়েছে, যা ভোলার মতো নয়। সেই গোলগুলি যাঁরা করেছেন, তাঁরাও যথেষ্ট দক্ষ। তাঁরা যে শুধু গোল করেছেন, তা নয়, সতীর্থদের গোল করতে সাহায্যও করেছেন একাধিকবার। অর্থাৎ, দলের গোলে যাঁদের প্রত্যক্ষ অবদান সর্বাধিক, তাঁদের নিয়ে যদি কোনও তালিকা তৈরি করা যায়, তা হলে তা এরকম দাঁড়াতে পারে:

দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস, কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি – ১৫ (গোল-১২ + অ্যাসিস্ট-৩)

গত মরশুমের সর্বোচ্চ গোলদাতার করা গোলের চেয়ে বেশি গোল ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন এই ব্লাস্টার্সের তারকা ফরোয়ার্ড। এখনও লিগ পর্বে তাদের তিনটি ম্যাচ খেলা বাকি। অর্থাৎ, তিনি আরও গোল করতে বা করাতে পারেন। মোট দশটি ম্যাচে এই ১৫টি গোলে অবদান রেখেছেন এই গ্রিক ফুটবলার। তিনবার জোড়া গোল করেছেন তিনি। চেন্নাইন  এফসি, এফসি গোয়া ও মোহনবাগান এসজি-র বিরুদ্ধে দুটি করে গোল করেন তিনি। আদ্রিয়ান লুনা চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পর তিনিই এখন ব্লাস্টার্সের আক্রমণের প্রধান ভরসা। শুধু যে সবচেয়ে বেশি গোলে তিনি অবদান রেখেছেন, তা নয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগও (২০) তৈরি করেছেন তিনি।

রয় কৃষ্ণা, ওডিশা এফসি – ১২ (গোল-১২ + অ্যাসিস্ট- ১)

পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এ এটিকে এফসি-তো যোগ দেওয়ার পর থেকে রয় কৃষ্ণা এ পর্যন্ত আইএসএলে ৫৪টি গোল করেছেন এবং লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় তিন নম্বরে চলে এসেছেন। ফিজির এই প্রাক্তন অলিম্পিয়ান নিজেকে ক্রমশ উন্নত করে তুলছেন এবং ওডিশা এফসি-তে সের্খিও লোবেরার প্রশিক্ষণে নিজেকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। গত বছর বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে তাঁকে চেনা ছন্দে পাওয়া যায়নি। অনেকেই বলতে শুরু করেছিল, কলকাতা ছাড়ার পর রয়ের ফর্মও তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে এ মরশুমে এক ডজন গোল ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন তিনি। একটি গোলে সাহায্যও করেছেন। একশোর ওপর আইএসএল ম্যাচ খেলা রয় চলতি লিগে এ পর্যন্ত ৩০টি গোলের সুযোগও তৈরি করেছেন।

মাদি তালাল, পাঞ্জাব এফসি (গোল-৪ + অ্যাসিস্ট-৮)

দলের প্রথম মরশুমেই দলের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন এই ফরাসি প্লেমেকার। শুরুর দিকে অতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে না পারলেও যত লিগ এগিয়েছে, ততই অসাধারণ বল ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে নিজেকে নির্ভরযোগ্য করে তুলেছেন তালাল। তাই শুধু দলের নয় সারা লিগেও সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের মালিক হয়ে উঠেছেন তিনি। আটটি অ্যাসিস্ট ছাড়াও চারটি গোল করেছেন তিনি। প্রথম দশটি ম্যাচে তারা জয়হীন থাকার পর ১১ নম্বর ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে প্রথম জয়ের স্বাদ পায়। এর পর বেঙ্গালুরু এফসি, কেরালা ব্লাস্টার্স, হায়দরাবাদ এফসি, নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে হারিয়ে এখন ছ’নম্বরে থাকার দৌড়ে রয়েছে তারা। এই সাফল্যের পিছনে তালালের অবদানই সবচেয়ে বেশি বললে খুব একটা ভুল হবে না।

জেসন কামিংস, মোহনবাগান এসজি (গোল-৯ + অ্যাসিস্ট-২)

কাতার বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা এই ফরোয়ার্ড সবুজ-মেরুন শিবিরে এসে শুরুর দিকে তেমন ভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি। এখানকার পরিবেশ, কোচ, সতীর্থ, সমর্থক, এ সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় নেন তিনি। অবশেষে ছন্দ ফিরে পেয়েছেন তিনি এবং মোহনবাগানের নতুন কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের প্রশিক্ষণে দুরন্ত ফর্মে রয়েছেন। মেরিনারদের গোলদাতাদের তালিকায় এখন এক নম্বরে রয়েছেন কামিংস। পিছনে ফেলে দিয়েছেন সবুজ-মেরুন জনতার নয়নের মণি ও তাঁরই স্বদেশীয় দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে। তাঁরই এই ছন্দে ফেরা দলকে নতুন করে লিগশিল্ড জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। দলের গত তিন ম্যাচেই গোল পেয়েছেন কামিংস। এ ছাড়াও দু’টি অ্যাসিস্টও করেছেন তিনি।

দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, মোহনবাগান এসজি (গোল-৮, অ্যাসিস্ট-৩)

গত মরশুমের মতো এ বারও গোলের ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন গতবারও এটাই করেছিলেন। কিন্তু গত মরশুমে বারবার প্রতিপক্ষের গোলের সামনে  একা পড়ে যেতেন, তাঁকে সাহায্য করার মতো কাউকে পেতেন না সে ভাবে। কিন্তু এ বার তিনি একা নন। একঝাঁক দেশীয় ও বিদেশী সতীর্থরা রয়েছেন তাঁর সঙ্গে। ফলে গোলের ব্যাপারে অনেক নিশ্চিন্ত হতে পারছেন। গতবার দলের দুঃসময়ে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন ত্রাতা। এ বাও কম সাহায্য করেননি তিনি। প্রচণ্ড গোলের খিদে তাঁকে দলের অন্যতম সেরা অ্যাটাকার করে তুলেছে। ১১টি গোলে প্রত্যক্ষ অবদান তো রেখেছেনই, এ ছাড়াও সবচেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করেছেন যাঁরা, তাঁদের তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছেন পেট্রাটস। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট সারিয়ে মাঠে ফেরার পর তিনি যেন আরও ধারালো হয়ে উঠেছেন। গত দশটি ম্যাচে আটটি গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন।