ফোকাস: প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের অচল করে দেওয়াই এখন মহমেডানের লক্ষ্য!
সম্প্রতি দিয়েগো মরিসিও, আলাদিন আজারেই ও সুনীল ছেত্রীদের কতটা অসহায় করে তোলেন সাদা-কালো বাহিনীর ডিফেন্ডাররা, তা তাদের বিরুদ্ধে তারকা স্ট্রাইকারদের পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।

তাদের আইএসএল অভিষেক মরশুমের প্রথম জয় ও দ্বিতীয় জয়ের মধ্যে ছিল দশটি জয়হীন ম্যাচ, যা দেখার পর মহমেডানের সমর্থকেরা আশাহত হয়ে পড়েছিলেন। আদৌ এই দল নিয়ে আর কোনও ম্যাচ জিততে পারবেন কি না রাশিয়ান কোচ চোরনিশভ, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে পড়ে তারা।
অনেকেই ভাবতে পারেননি নতুন বছর তাদের জন্য নিয়ে আসবে আশার আলো। কিন্তু চেরনিশভ ও তাঁর ছেলেরা দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গিয়েছেন, যাতে ফের আনন্দের দিন আসে। আজ হোক বা কাল, নয় পরশু, আরও একটা জয়ের মুখ যেন দেখতে পায় তারা।
অবশেষে সেই দিন আসে গত শনিবার, যখন তারা শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে বেঙ্গালুরু এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে তিন পয়েন্ট ঘরে তোলে এবং পয়েন্ট টেবলে এক ধাপ ওপরে উঠে আসে। লিগের প্রথম জয়ও তারা পেয়েছিল প্রতিপক্ষের মাঠে নেমেই। নিজেদের মাঠে এখন পর্যন্ত একটিও জয় পায়নি মহমেডান। ফলে ঘরের মাঠে জয় দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন সমর্থকেরা।
বুধবার সেই সুযোগ পাবে সাদা-কালো ব্রিগেড। এমনিতেই গত ম্যাচে বেঙ্গালুরুকে হারিয়ে যথেষ্ট উজ্জীবিত ফুটবলাররা। তার ওপর এই ম্যাচের প্রতিপক্ষ চেন্নাইন এফসি-র সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তেমন ভাল নয়। তাই এই সুযোগ হয়তো ছাড়তে চাইবে না তারা।
যদিও কোচ চেরনিশভ বলেছেন, “আইএসএলে কোনও ম্যাচই সহজ নয় এবং কোনও প্রতিপক্ষই দুর্বল নয়। তাই প্রতি ম্যাচেই নিজেদের সেরাটা দিতে হবে আমাদের। কোনও ম্যাচেই সহজেই জয় আসবে না আমাদের। সে জন্য পরিশ্রম করতে হবে এবং সেরা পারফরম্যান্স দিতে হবে। চেন্নাইন এফসি-কে হারাতে গেলেও সেটাই দরকার”।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চেন্নাইনকে যে ম্যাচে হারিয়েছিল তারা, সেই ম্যাচে শুরুর দিকে কোণঠাসা হয়ে গেলেও লড়াইয়ে ফেরে এবং জয় পায় তারা। আইএসএলে প্রথমবার নেমে প্রথম অ্যাওয়ে ম্যাচেই জয় পায় তারা। যে ভাবে পাল্টা আক্রমণ হেনে প্রতিপক্ষকে কাবু করে সাদা-কালো বাহিনী, তা প্রশংসার যোগ্য। এ জন্য অবশ্য চেন্নাইনের রক্ষণও যথেষ্ট দায়ী। তাদের ভুল কাজে লাগিয়েই ৩৯ মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে এগিয়ে দেন মিডফিল্ডার লালরেমসাঙ্গা ফানাই।
সে দিন আরও একটি অবধারিত গোল পেতে পারত মহমেডান। ম্যাচের শেষে বাড়তি সময়ে পেনাল্টি পেয়েও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন সিজার মানজোকি। এ ছাড়াও আরও একাধিক গোলের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি মহমেডানের অ্যাটাকাররা। অসাধারণ ডিফেন্সিভ দক্ষতারও পরিচয় দেন চেরনিশভের দলের ফুটবলাররা। ৮১ মিনিট পর্যন্ত একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি চেন্নাইন। বাড়তি সময়ে তিনটি শট গোলে রাখলেও মহমেডানের দুর্ভেদ্য রক্ষণ সবকটি আটকে দেয়। মহমেডান মোট আটটি শটের মধ্যে ছ’টিই গোলে রাখে।
তাদের এই পারফরম্যান্সের সঙ্গে অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তাদের সাম্প্রতিক তিনটি ম্যাচের পারফরম্যান্সের, যেখানে তারা ওডিশা এফসি, নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করে ও বেঙ্গালুরু এফসি-কে ১-০-য় হারায়। চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে দুর্দান্ত ডিফেন্স করে যেমন ৮১ মিনিট পর্যন্ত একটিও শট তাদের গোলে রাখতে দেয়নি মহমেডান, মনে করে দেখুন, বড়দিনের পরেই ওডিশা এফসি তাদের বিরুদ্ধে সারা ম্যাচে পাঁচটির বেশি শটই নিতে পারেনি। তার মধ্যে কোনও শটই লক্ষ্যে ছিল না, যা ওডিশার মতো আক্রমণাত্মক দলের পক্ষে অস্বাভাবিক।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি তাদের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ১৪টি শট নেয়, যার মধ্যে দু’টির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি আলাদিন আজারেইরা। উইং প্লে-তেও নর্থইস্ট সে দিন অনেক এগিয়ে ছিল। তারা মোট ২৭টি ক্রস দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও গোল করতে পারেনি। সুনীল ছেত্রীর বেঙ্গালুরুও তাদের বিরুদ্ধে তিনটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি।
মহমেডানের বিরুদ্ধে তাঁদের সাম্প্রতিক ম্যাচে তিন তারকা স্ট্রাইকার মরিসিও, আজারেই ও সুনীলের পরিসংখ্যানে যদি চোখ বোলানো যায়, তা হলেই বোঝা যাবে, এই তিনজনকে কতটা অসহায় করে তোলেন সাদা-কালো বাহিনীর ডিফেন্ডাররা।
তিনজনই মহমেডানের বিরুদ্ধে কোনও গোল বা অ্যাসিস্ট কিছুই করতে পারেননি। মরিসিও তিনটির মধ্যে একটিও শট টার্গেটে রাখতে পারেননি। আজারেই আটটির মধ্যে মাত্র একটি শট গোলে রাখতে পারেন ও সুনীল ছেত্রী যে ৬৫ মিনিট মাঠে ছিলেন, তার মধ্যে মাত্র একটি শট নেন তিনি, সেটিই ছিল লক্ষ্যে। মাত্র দু’বার প্রতিপক্ষের বক্সে বল ছুঁতে পেরেছিলেন সুনীল। মরিয়া আজারেই তাও ন’বার বক্সে বল ছুঁয়েছিলেন। মরিসিও মাত্র তিনবার বল ছুঁতে পেরেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে প্রতিপক্ষের প্রধান স্ট্রাইকারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলাই এখন মহমেডান ডিফেন্ডারদের কাজ। যার জন্য ট্রানজিশনেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে তারা। আক্রমণে ওঠা ও রক্ষণে নেমে আসা, দুটোই প্রায় একসঙ্গে করছে তারা।
গত তিনটি ম্যাচে রক্ষণে কতটা উন্নতি করেছে তারা, তা একটু পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই বোঝা যায়। যখন তারা একের পর এক ম্যাচ হারছিল, সেই সময়, অর্থাৎ, ২৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ পাঁচ ম্যাচে ১১ গোল হজম করে মহমেডান। তার পরের তিন ম্যাচে একটিও গোল খায়নি তারা। গত তিন ম্যাচে যেখানে তাদের গোলে মাত্র পাঁচটি শট নিতে পেরেছে তাদের প্রতিপক্ষরা, সেখানে তার আগের পাঁচ ম্যাচে তাদের গোলে ৩০টি শট নেয় অপর দলগুলি। বোঝাই যাচ্ছে, রক্ষণে কতটা শক্তিশালী হয়ে হয়ে উঠেছে চেরনিশভের দল। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা আক্রমণ ও রক্ষণ দুই দিকেই হতাশ করছিল। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বরের ম্যাচ থেকে কৌশল বদলে নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ করে রক্ষণে।
বুধবার চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধেও তাঁরা প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ গোলদাতা উইলমার জর্ডন গিলকে হয়তো অচল করে রাখার চেষ্টা করবে। আজারেইকে যেমন আটকানোর দায়িত্ব ছিল মহম্মদ ইরশাদের ওপর, গিলের দায়িত্বেও হয়তো তিনিই থাকবেন। এ ছাড়া অধিনায়ক আদিঙ্গা, ফরাসি ডিফেন্ডার ফ্লোরেন্ট অগিয়ে, যিনি নর্থইস্টের বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং জুডিকাও যথেষ্ট ভাল ফর্মে রয়েছেন এবং সতীর্থদেরও সাহায্য পাচ্ছেন যথেষ্ট।
মঙ্গলবার কোচ চেরনিশভ জানালেন, জোসেফ আজেইও বুধবার চোট সারিয়ে দলে ফিরতে পারেন। মহম্মদ ইরশাদ বলেন, “জোসেফ আজেই ও ফ্লোরেন্ট অগেই দুজনেই যথেষ্ট উঁচু স্তরের ফুটবল খেলে এসেছে। তাই ওদের অভিজ্ঞতা আমাদের খুব কাজে লাগে এবং নিজেদের উন্নত করে তুলতে সাহায্য করে”।
আজেইকে এগারোয় আনতে হলে মাঝমাঠে কাসিমভ, গোমেজ বা আক্রমণে ফ্রাঙ্কার মধ্যে একজনকে বাদ দিতে হবে কোচকে। তা তিনি করবেন, না কি আজেইকে পরে নামাবেন, সেটাই দেখার। উইনিং কম্বিনেশন নাও ভাঙতে পারেন তিনি। তবে যাই করুন তিনি, প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার ব্রত নিয়েই যে ফের বুধবার মাঠে নামবে সাদা-কালো ব্রিগেড, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।