মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে শিল্ড জেতার পর দিমিত্রিয়স পেট্রাটস বলেছিলেন, “দলে যোগ দেওয়ার পর কোচ আমাদের সব সময় বলেছেন একটা দল হিসেবে খেলতে। আমরা আজ খেলা শুরুর বাঁশি থেকে শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত একদম এককাট্টা ছিলাম, একসঙ্গে লড়েছি। সেই জন্যই জিতলাম”। 
তাঁর সতীর্থ ও স্বদেশীয় জেসন কামিংস সে দিন বলেন, “আমাদের দলটা অসাধারণ, যেখানে একজন মহান কোচ ও একদল দুর্দান্ত স্টাফ আছে। সব মিলিয়ে খুব ভাল দল আমাদের। আমাদের এটা প্রাপ্য ছিল”।

এই আন্তোনিও লোপেজ হাবাস আইএসএলে অতীতে কী করেছেন, তা নিশ্চয়ই শুনেছেন তাঁরা। বিশ্বকাপে খেলে আসা ফুটবলাররা যদি কোনও কোচের এ রকম প্রশংসা করেন, যদি কাউকে কোচ হিসেবে এমন শ্রদ্ধা করেন, তা হলে বুঝতেই হবে, তাঁর এই সন্মান অবশ্যই প্রাপ্য। 

সবুজ-মেরুন বাহিনীকে লিগশিল্ড জেতানোর পর এ বার যিনি কাপ জয়েরও স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন, তাঁকে অবশ্য হাবাস ২.০ বলাই যায়ই। তাঁর প্রত্যাবর্তনে যেখান থেকে উঠে এসে এখন কাপের দোরগোড়ায় মোহনবাগান, তার পরে আর তাঁর ক্যারিশমা নিয়ে বোধহয় কোনও প্রশ্ন তোলাই ঠিক নয়। 

ঘরের মাঠে দাপুটে সূচনা

আইএসএলের দশম মরশুমে দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য তারকাকে ছাড়াই প্রথম সাতটি ম্যাচে অপরাজিত ছিল তারা। শুরুতেই নবাগত পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে ৩-১ জয় দিয়ে শুরু করে বাগান-বাহিনী। ২৮ হাজার দর্শকের সামনে ৩-৪-৩ ছকে দল নামিয়ে দাপুটে জয় পায় গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে মরশুম শুরু করলেও প্রথমেই দুঃসংবাদ আসে, ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে চোট পেয়ে কার্যত সারা মরশুমের জন্যই ছিটকে যান আশিক কুরুনিয়ান। এখান থেকেই বিপর্যয়ের শুরু। 

আশিকের পর ক্রমশ চোটের তালিকায় নাম লেখাতে শুরু করেন আনোয়ার আলি, মনবীর সিংও। এমনই অবস্থা দাঁড়ায় যে, এএফসি কাপের শেষ ম্যাচে মলদ্বীপে দ্বিতীয় সারির দল পাঠাতে হয় প্রাক্তন কোচ হুয়ান ফেরান্দোকে। অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার পেট্রাটসও চোটের তালিকায় ঢুকে পড়েন। জেসন কামিংস, আরমান্দো সাদিকুরা ক্রমশ ফর্ম হারান। 

দুঃসময়ের শুরু 

সব শেষে সর্বনাশটি হয় মুম্বইয়ে গিয়ে। যখন লাল কার্ড দেখে আশিস রাই, হেক্টর ইউস্তে ও লিস্টন কোলাসো সাসপেন্ড হয়ে যান। ডিসেম্বরে সেই ম্যাচে ৪-২-৩-১ ছকে শুরু করা মেরিনার্স ১-২-এ তো হারেই। তার ওপর নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দেরও খোয়ায়। এই ম্যাচের ফলের সঙ্গে ম্যাচের মেজাজের বিন্দুমাত্র মিল পাওয়া যায়নি সে দিন। রেফারি রাহুল গুপ্তা কড়া হাতে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সাতটি হলুদ কার্ড ও সাতটি লাল কার্ড দেখান। একই ম্যাচে এতগুলি লাল কার্ড ও হলুদ কার্ড আর কখনও দেখানো হয়নি ইন্ডিয়ান সুপার লিগে। এই ম্যাচে হার দিয়েই সাত ম্যাচ পর প্রথম ধাক্কাটা আসে ও বছর শেষের দুঃসময় শুরু হয় সবুজ-মেরুন বাহিনীর।

এতদিন যে পরিবারে অভাব থাকলেও শান্তি ছিল,  মাত্র আট দিনের মধ্যে সেই পরিবারেই লাগে অশান্তির আগুন। তাদের আকাশ ঢেকে যায় ব্যর্থতার কালো মেঘে। ডিসেম্বরের ২০ তারিখে মুম্বইয়ে হারের তিন দিন পর নিজেদের শহরে ফিরে যে আরও বড় লজ্জার মুখোমুখি হবে, তা ভাবতেও পারেনি কেউ। ২৩ ডিসেম্বর এফসি গোয়ার কাছে ঘরের মাঠে ১-৪-এ হারে মোহনবাগান। এই দুই হারেই তাদের বড়দিনের আনন্দ উধাও হয়ে যায়। কিন্তু তাদের ক্রিসমাসকে পুরোপুরি বর্ণহীন করে তুলতেই যেন শহরে আসে কেরালা ব্লাস্টার্স, যারা ১-০-য় জিতে সবুজ-মেরুন শিবিরকে বুঝিয়ে দেয় দুঃসময় কাকে বলে।  

পরপর এই বিপর্যয়েই ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে মোহনবাগান এসজি। বছরের শেষে লিগে সাময়িক অবকাশ শুরুর আগে সবুজ-মেরুন শিবির থেকে নেমে আসে পাঁচ নম্বরে। এই অধঃপতনেই ফেরান্দোকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাব। যাতে দল একেবারে লিগ টেবলের তলানিতে চলে না যায়। সিদ্ধান্তটি যে একেবারেই ভুল হয়নি, তা দায়িত্ব নেওয়ার পরেই প্রমাণ করেন হাবাস ২.০। 

নতুন বছর শুরুর পর টানা আটটি আইএসএল ম্যাচে অপরাজিত ছিল মোহনবাগান। যার মধ্যে ছ’টিতে জেতে তারা এবং দু’টিতে ড্র করে। হাবাসের প্রভাব পড়া শুরু হয় সেই সময় থেকেই। এই আটটি ম্যাচের প্রথমটিই ছিল কলকাতা ডার্বি। 

হাবাস ২.০-র প্রভাবে ছন্দে ফেরা

ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে তার চেনা আগুনে মেজাজে ফেরে কলকাতা ডার্বি। দুই দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই তো করেই, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ৯০ মিনিটের সেই লড়াই দেখে ৫৮ হাজার সমর্থক। এই উত্তেজনার মধ্যেই হয় চার-চারটি গোল। তিন মিনিটের মাথায় যেমন গোল হয়, তেমন ৮৭ মিনিটের মাথাতেও গোল হতে দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ২-২-এ খেলা শেষ করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ও ইস্টবেঙ্গল এফসি। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের প্রথম অমীমাংসিত ডার্বি।

এই ডার্বিতেই নতুন কোচ হাবাসের বাহিনী স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে, তারা লড়াইয়ে ফিরে এসেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের দিকেও ফিরতি ডার্বিতে দেখে নেওয়ার স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখে তারা এবং সেই ডার্বি আসে তার পরের মাসেই, ১০ মার্চ। দুই ডার্বির মাঝে আরও পাঁচটি ম্যাচ খেলে মোহনবাগান, যার মধ্যে একটিতেও হারেনি তারা। শুধু ভুবনেশ্বরে গিয়ে গোলশূন্য ড্র করে আসে। বাকি চারটি ম্যাচেই জিতে ফের লিগ টেবলে নিজেদের তুলে নিয়ে যেতে শুরু করেছে হাবাসের বাহিনী।  

ফিরতি ডার্বিতে সাফল্যে ফেরা

ফিরতি ডার্বির প্রথমার্ধে দাপুটে ফুটবল খেলে তারা। ২৭ মিনিটে জেসন কামিংস, ৩৬ মিনিটে লিস্টন কোলাসো ও প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে পেনাল্টি থেকে দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের দেওয়া তিন গোলেই বাজিমাত করে ফেলে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। তাই দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গল এফসি-র দাপট দেখা গেলেও একটির বেশি গোল শোধ করতে পারেনি তারা। ৫৩ মিনিটে সল ক্রেসপোর গোলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।

ফিরতি ডার্বির এই দুর্দান্ত জয়ের পরের দিনই তারা রওনা হয় কোচির উদ্দেশ্যে, যেখানে তিন দিন পরেই তাদের আরও একটি কঠিন ম্যাচ ছিল কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে। চারদিনের মধ্যে দু-দু’টি বড় ম্যাচ। কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল মোহনবাগানের সামনে। তিন দিন আগেই ডার্বি খেলার ক্লান্তি নিয়ে সে দিন জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে নামে সবুজ-মেরুন বাহিনী। এই স্টেডিয়ামে নামা মানে যে শুধু কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে নামা, তা নয়, তাদের অত্যুৎসাহী সমর্থকদের বিরুদ্ধেও নামা। তার ওপর ৭৭ শতাংশ আর্দ্রতা। 

কোচির মাঠে গোল-ফোয়ারা 

কোনও কিছুই সে দিন তাদের অনুকুলে ছিল না। কিন্তু ম্যাচের আগের দিন যে কথা বলেছিলেন তাদের কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস, সেই কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন তাঁর দলের সৈনিকরা। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের শব্দব্রহ্ম থেকেই নিজেদের উজ্জীবিত করে তোলেন তাঁরা। ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই দলকে এগিয়ে দেন আরমান্দো সাদিকু। 

কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে যা হয়, তাকে সাইক্লোন বললেও বোধহয় কম বলা হবে। ওঠে গোলের ঝড়। বিরতির পর ১৪ মিনিটের মধ্যে পরপর চারটি গোলে ম্যাচের ছবিটা পুরো বদলে যায়। প্রথমে ৫৪ মিনিটে মোহননের গোলে সমতা আনে ব্লাস্টার্স। ৬০ মিনিটে দ্বিতীয় গোল করে ফের এগিয়ে দেন সাদিকু। ৬৩ মিনিটে ফের সমতা আনেন গ্রিক ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস। তার পাঁচ মিনিট পরেই কর্নার থেকে হেডের গোলে মোহনবাগানকে ফের এগিয়ে দেন দীপক টাঙরি। স্টপেজ টাইমের শেষ মুহূর্তে গোল করে ব্যবধান বাড়ান বাগান বেঞ্চ থেকে নামা জেসন কামিংস। তারও পরে শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান কমান দিয়ামান্তাকস। 

কোচিতে সেই জয়ের ফলে ১৮ ম্যাচে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে ফের লিগ টেবলে দু’নম্বরে চলে আসে মোহনবাগান এসজি, মুম্বই সিটি এফসি-র পরেই। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের লিগশিল্ডের দৌড়। এই দুই কঠিন ম্যাচের পর আবার সপ্তাহ দুয়েকের আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য অবকাশে নিজেদের তরতাজা করে তোলেন সাদিকুরা। কিন্তু এই অবকাশের শেষ দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন হাবাস, যা প্রভাব পড়ে সরাসরি দলের খেলায়। অবকাশের পর মাঠে ফিরে ঘরের মাঠে চেন্নাইন এফসি-র কাছে ২-৩-এ হারের কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সমর্থকেরা। ফুটবলাররাও কি পেরেছিলেন? বোধহয় না। 

কিন্তু শিল্ডের দৌড়ে শেষ ল্যাপ শুরু করার আগে এই ধাক্কাটা বোধহয় দরকার ছিল তাদের। এই হারের পরেই তারা বুঝে যায় শিল্ড জিততে গেলে শেষ তিন ম্যাচে জিততেই হবে। তখনও হাবাস অসুস্থ। পরপর দুটো অ্যাওয়ে ম্যাচ দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে। পাঞ্জাব এফসি তখন ক্রমশ নিজেদের খোলস ছেড়ে বেরতে শুরু করেছে, সেরা ছয়ে থাকার স্বপ্ন দেখছে। সেই পাঞ্জাবকে ১-০-য় হারিয়ে তারা পৌঁছয় বেঙ্গালুরুতে। 

বেঙ্গালুরুতে বেনজির জয় 

শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে আইএসএলের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে বড় জয়টি অর্জন করে সে দিনই শিল্ড-যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী। রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে সুনীল ছেত্রীর বেঙ্গালুরু এফসি-কে ৪-০-য় হারিয়ে মুম্বই সিটি এফসি-কে বুঝিয়ে দেয়, তাদের লিগ শিল্ড জয়ের রাস্তা বেশ কঠিন হয়ে উঠতে চলেছে। 

সে দিন কান্তিরাভায় প্রথমার্ধে এক গোলে এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র ন’মিনিটের মধ্যে তিন-তিনটি গোল করে লিগ শিল্ডের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় গতবারের নক আউট চ্যাম্পিয়নরা। ১৭ মিনিটের মাথায় প্রথম গোলটি করেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তে। দ্বিতীয়ার্ধে ৫১ থেকে ৫৯ মিনিটের মধ্যে পরপর তিন গোল করে দলের জয় সুনিশ্চিত করেন যথাক্রমে মনবীর সিং, অনিরুদ্ধ থাপা ও আরমান্দো সাদিকু। এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৪০ মিনিটের মাথায় পাওয়া পেনাল্টি হাতছাড়া করেন বেঙ্গালুরু এফসি-র অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। এই ভুলের বড় মাশুল দিতে হয় তাঁর দলকে।

আইএসএলে প্রথম লিগ শিল্ড জয়ের জন্য শেষ ম্যাচে ঘরের মাঠে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারানো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না মোহনবাগানের। যে মুম্বইকে আইএসএলের আসরে কোনও দিন হারাতে পারেনি তারা, সেই মুম্বইকে হারিয়ে লিগশিল্ড জেতার স্বপ্ন দেখা মোটেই সোজা কাজ ছিল না। কিন্তু তাও পেরেছে তারা। 

অবশেষে লিগশিল্ড জয় 

গত আটবার যা পারেনি তারা, এ বার সেটাই করে দেখায় মোহনবাগান। এক নয়, জোড়া অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে প্রথমবার আইএসএলে লিগসেরার খেতাব জেতে এবং লিগের ইতিহাসে প্রথম তারা হারায় মুম্বই সিটি এফসি-কে। এর আগে দু-দু’বার লিগশিল্ড হাতছাড়া করতে হয়েছিল স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে। নতুন বাংলা বছরের দ্বিতীয় দিন যুবভারতীর প্রায় ৬০ হাজার সমর্থকের সামনে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে লিগসেরার খেতাব জিতে নেয় তারা। 

ম্যাচের ২৮ মিনিটের মাথায় লিস্টন কোলাসোর গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান এসজি। ৮০ মিনিটের মাথায় ব্যবধান বাড়িয়ে নেন অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড জেসন কামিংস। সারা ম্যাচে গোলের জন্য মরিয়া মুম্বই সিটি এফসি-কে অবশেষে ৮৯ মিনিটর মাথায় গোল এনে দেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে। এই ম্যাচ ড্র করলেই লিগশিল্ড উঠত মুম্বইয়ের ফুটবলারদের হাতে। কিন্তু ম্যাচের শেষ ১০ মিনিট দশ জনে খেলেও মুম্বইকে সেই আকাঙ্খিত গোলটি করতে দেয়নি মোহনবাগানের দুর্ভেদ্য রক্ষণ। ২২ ম্যাচে ৪৮ পয়েন্ট পেয়ে লিগের সেরার খেতাব জিতে নেয় তারা। যা লিগের ইতিহাসে এক নয়া রেকর্ড।

লিগ তালিকায় এক নম্বরে থাকার সুবাদে সরাসরি সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে কলকাতার দল। সেমিফাইনালে তাদের মুখোমুখি হয় লিগ টেবলের পাঁচ নম্বরে থাকা ওডিশা এফসি, যারা প্লে অফের প্রথম ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-কে হারিয়ে সেমিফাইনালে খেলার ছাড়পত্র পায়। 

সেমিফাইনালে ফের ধাক্কা

কিন্তু সেমিফাইনালের প্রথম লেগেই ধাক্কা খায় লিগশিল্ডজয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে তিন মিনিটের গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হেরে মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। ওডিশা এফসি ২-১-এ প্রথম লেগ জিতে এগিয়ে রইল। মোহনবাগানকে ফাইনালে উঠতে গেলে রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অন্তত দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। তারা এক গোলের ব্যবধানে জিতলে টাই ব্রেকারে খেলার নিষ্পত্তি হবে। 

এ দিন তৃতীয় মিনিটে কর্নার থেকে হেডের গোলে দলকে এগিয়ে দেন মোহনবাগানের তারকা উইঙ্গার মনবীর সিং। কিন্তু এর পর আর কোনও গোল করতে পারেনি তারা। সারা ম্যাচে আটটি গোলের সুযোগ কিন্তু তৈরি করেছিল তারা। ১১ মিনিটের মাথায় কার্লোস দেলগাদো ও ৩৯ মিনিটের মাথায় মোহনবাগানের প্রাক্তনী রয় কৃষ্ণা গোল করে দলকে জয়ের রাস্তা দেখান। সে দিন মোহনবাগানের দুই বিদেশী দিমিত্রিয়স পেট্রাটস ও জনি কাউকো সেরা ছন্দে না থাকায় পুরো দলটারই ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। দুই উইঙ্গার লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিংও সেরা পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। 

ফলে আবার সেই ঘরের মাঠে ভরা গ্যালারির দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় সবুজ-মেরুন শিবিরকে। তাদের চিৎকার থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে দু’গোলে জয়ের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে তারা। যা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সের্খিও লোবেরার মতো ধূর্ত কোচ, রয় কৃষ্ণা, দিয়েগো মরিসিওর মতো ক্ষিপ্র ফরোয়ার্ডদের সামলে দু’গোলের ব্যবধানে ম্যাচ জেতা মোটেই সহজ কাজ ছিল না।

দ্বিতীয় লেগে ফের চেনা দাপট 

কিন্তু সেই কঠিন হার্ডলও পেরিয়ে যান কামিংস, পেট্রাটসরা। প্রথম লেগে হারের বদলা নিয়ে ওডিশা এফসি-কে ২-০-য় হারিয়ে ফাইনালে উঠে পড়ে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। অর্থাৎ, দুই সেমিফাইনাল মিলিয়ে ৩-২-এ জিতে টানা দ্বিতীয়বার আইএসএলের ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা।

গত রবিবার উত্তেজনায় ঠাসা সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে প্রথমার্ধে জেসন কামিংস গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। দ্বিতীয়ার্ধের স্টপেজ টাইমে সহালের গোলে ফাইনালে ওঠে তারা। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে যে রকম দাপট দেখিয়েছিল ওডিশা এফসি, এ দিন সেই দাপট দেখা যায়নি তাদের খেলায়। সারা ম্যাচে যেখানে দশটি শট গোলে রাখেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটসরা, সেখানে চারটির বেশি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি আহমেদ জাহুরা। আটটির বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি ওডিশা এফসি। সেখানে ১৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করে মোহনবাগান। 

এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তন ও মানসিক শক্তিই আগামী শনিবার ফাইনালে মোহনবাগানের সবচেয়ে বড় ভরসা। কোচ হাবাস শিল্ড জয়ের সময়ই দলের খেলোয়াড়দের কড়া বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন, শুধু শিল্ড জয়ে সন্তুষ্ট থাকলেই হবে না, কাপও জিততে হবে, যে ভাবে ২০২০-২১-এ মুম্বই তাদের হারিয়ে জিতেছিল, সে ভাবেই। হাবাসের সেই বার্তাতেই তেতে রয়েছে গোটা শিবির। 

তার ওপর ঘরের মাঠে ভরা গ্যালারির সামনে ফাইনাল। নিজেদের সমর্থকে ঠাসা এই গ্যালারি থেকে যে গগণভেদী আওয়াজ ভেসে আসবে, সেই আওয়াজই ভিতরে ভিতরে আরও তাতিয়ে তুলবে শুভাশিসদের, এমনই আশা করে বসে রয়েছেন লক্ষ্য লক্ষ্য সমর্থক। দুর্ধর্ষ সবুজ-মেরুন বাহিনীকে দমিয়ে রেখে সারা গ্যালারিকে চুপ করিয়ে যুবভারতী থেকে কাপ জিতে নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা মুম্বই সিটি এফসি-র আছে বলেই দাবি করেছেন তাদের কোচ পিটার ক্রাতকি। কিন্তু বলা আর তা করে দেখানোর মধ্যে যে কত হাজার কিলোমিটারের ফারাক, তা শনিবার মাঠে নামলেই টের পাবেন লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতেরা।