গোল পেতে শুরু করেছেন মোহনবাগানের গোলমেশিন জেমি ম্যাকলারেন। পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে জোড়া গোল করার পর গত ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধেও জোড়া গোল করেছেন তিনি। অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার ছন্দে ফেরায় দলও অনেক বেশি সচল হয়ে গিয়েছে। রবিবার যখন তারা শিল্ডজয়ের লক্ষ্যে ঘরের মাঠে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে নামবে, তখনও ম্যাকলারেনের কাছে গোলের আশা নিয়েই গ্যালারিতে ভীড় করবেন সমর্থকেরা।

এর আগে তাদের স্ট্রাইকাররা নিয়মিত গোল করতে পারছিলেন না। জেসন কামিংস, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস— এখনও নিয়মিত গোল পাচ্ছেন না। তাই চার ম্যাচে গোলহীন থাকার পর ম্যাকলারেন যখন পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে জোড়া গোল করেন, তার পর থেকে সবুজ-মেরুন বিজয়রথ ফের ছুটতে শুরু করে। দশ গোল নিয়ে এখন তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছেন। লক্ষ লক্ষ সমর্থকদের জন্যই রবিবার এই ম্যাচ জিতে শিল্ড জিততে চান, জানিয়ে দিলেন অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার ম্যাকলারেন। রবিবারের এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে কী কী বললেন তিনি, জেনে নিন।

রবিবারের ওডিশা-ম্যাচ নিয়ে

আমি শুনেছি গ্যালারি সমর্থকে ভরে যাবে। আমি সত্যিই এর জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের সমর্থকদের জন্য ম্যাচটা জিততে হবে। কারণ, ওদের এটা প্রাপ্য। কারণ, গত ডার্বি কলকাতার বাইরে হয়েছিল। তারা গুয়াহাটিতে আমাদের (ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর) দুর্দান্ত পারফরম্যান্স মিস করেছে। এখন আমরা এই শহরের সবচেয়ে বড় দল, এবং আমাদের সমর্থকেরা আরেকটা ট্রফি জয়ের আনন্দ উপভোগ করার যোগ্য। আমাদের এখনও দুটো হোম ম্যাচ বাকি। তবে আমরা জানি যে, আগামীকাল তিন পয়েন্টই আমাদের শিল্ড জয়ের জন্য যথেষ্ট। যদি স্টেডিয়াম পূর্ণ হয়, তাহলে তো দারুণ হবে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না!

শিল্ড জিতলেও এখন জমকালো সেলিব্রেশন নয়

যদি আমরা রবিবার রাতে সফল হই, তাহলে পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ আছে। তাই তেমন কোনও বড় সেলিব্রেশন হবে না। হয়তো ড্রেসিংরুমে নরম পানীয়ের কয়েক বোতল খুলব, ছোটখাটো সেলিব্রেশন হবে। কিন্তু আমরা জানি যে কাল ৯০ মিনিট আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। আমরা সত্যিই একটি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিতে চাই। আমরা আমাদের ঘরের মাঠে খুব শক্তিশালী। এখানে খেলতে আমরা ভালবাসি। আমি জানি, মোহনবাগান একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এবং আমি এই ক্লাবে যোগ দিয়েছি সফল হওয়ার জন্যই। আশা করি, আগামীকাল রাতে আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারব। আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাব এবং অবসর নেব, তখন আমি গর্বের সঙ্গে ভাবব যে আমরা আইএসএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রহ করেছি। এটা আমার জন্য বিশাল গর্বের বিষয়।

আইএসএলে ব্যক্তিগত লক্ষ্য

আমি ঠিক নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ঠিক করিনি, কারণ প্রতিটি খেলাই আলাদা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই শিল্ড জেতা, এর পর আরেকটি ট্রফিও জেতার সুযোগ আছে। আমরা এই মরশুমে দেখিয়েছি যে, আমরা শুধুমাত্র একজন গোলদাতার উপর নির্ভর করি না। আমাদের দলে অনেক খেলোয়াড় গোল করেছে, আর এটাই ভাল দলের লক্ষণ। দলের রক্ষণ থেকে আক্রমণ, সবাই জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। এই পুরো মরশুমে আমার উপর কোনও চাপ ছিল না, এমন অবস্থায় খেললে সত্যিই ভাল লাগে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় ম্যাচ জেতা এবং আমরা গত ছ’মাসে সেটাই দেখিয়েছি।

এ মরশুমে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে

যখন ডাক্তার এবং কোচেরা আমাকে ফিট ঘোষণা করলেন, তখনই আমি মাঠে নামি। আমি জানতাম, প্রথম ম্যাচেই গোল করতে পারাটা আমার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমাকে ফিট থাকতে হবে, যাতে কোচ এবং ক্লাব আমার ওপর ভরসা করতে পারে। আমি এখন ৩১ বছর বয়সী, আমার প্রায় ৩০০-৪০০ ম্যাচের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই প্রতিটি ম্যাচ আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যতই মরশুম এগিয়েছে, আমি ততই উন্নতি করেছি। এখন আমি ফর্মের শিখরে আছি, আমার শেষ দুটি ম্যাচে চারটি গোল হয়েছে। যেকোনও মুহূর্তে, আমি গোল করার সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুত। আগামীকাল রাতের জন্য আমি মুখিয়ে আছি। যদি আমি প্রথম একাদশে থাকি, আমি তিন পয়েন্ট এনে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং আমি ভারতে প্রথম ট্রফি জিততে চাই!
আমি জানি, কঠোর পরিশ্রম করলে এর ফল আসবেই, তবে সেই পরিশ্রমটা একটু বেশি করতে হয় এবং আমি সেটাই করেছি। আমাদের কোচিং স্টাফ, আমাদের দল সবাই কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা যে লিগ টেবিলের শীর্ষে ১০ পয়েন্ট এগিয়ে আছি, এটা কাকতালীয় নয়। আগামীকাল রাতের ম্যাচের জন্য আমি রোমাঞ্চিত!

গত ম্যাচে জোড়া গোল

দারুণ অভিজ্ঞতা। আমার দ্বিতীয় গোলটা আপুইয়ার হেড ফ্লিক এবং তারপর আমার ও জেসনের সমন্বয়ে আসে। এ রকম খুব বেশি গোল করিনি আমি, যেখানে মাত্র চারটি পাসের মধ্যে বল জালে জড়িয়েছে। খুব দ্রুতগতির গোল ছিল। তবে এটা আমার সেরা দশ গোলের মধ্যে থাকবে। গোলের সময় আমাকে মাথার উপরে তাকিয়ে গোলকিপারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমি জানতাম সে এগিয়ে আসবে, তাই আমাকে বলটা তার মাথার ওপর দিয়ে তুলে দিতে হয়। যদি আমি একবার বল ঠেকাতাম, তাহলে হয়তো সে আমাকে ফাউল করে পেনাল্টি দিত, অথবা বল নিজের দখলে নিয়ে নিত। তাই আমাকে সঙ্গে সঙ্গেই শট নিতে হয়েছিল।

ভারতীয় সুপার লিগের সেরা মানের দিক থেকে বললে, এটি অবশ্যই অন্যতম সেরা গোল। আমি আমার কেরিয়ারে অনেক গোল করেছি, তবে একজন স্ট্রাইকার হিসেবে সব গোলের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবা হয় না।

গোল কখন হয়েছে এবং কীভাবে ম্যাচের মুহূর্তগুলো বদলেছে, সেটাই বড় বিষয়। আমি আমার কিছু ডার্বি গোলকেও সেরা মুহূর্তগুলোর মধ্যে রাখব, বিশেষ করে ভারতে করা কিছু গোল।

কলকাতায় এসে খেলার অভিজ্ঞতা

যে মুহূর্তে আমি কলকাতায় পৌঁছই, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমি সঠিক জায়গায় এসেছি। বিমানবন্দরে যে অভ্যর্থনা পেয়েছি, এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। শুরুটা যেমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন হয়নি। কিন্তু আমি সব সময় বিশ্বাস করি, সব কিছুরই একটা কারণ থাকে। আমি আট সপ্তাহ চোট পেয়ে বসে ছিলাম। ফিটনেস ফিরে পেতে হয়েছে, এবং কোচের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছে। আমি প্রথম দিন থেকেই জানতাম, আমার জন্য ভাল কিছু অপেক্ষা করছে। সত্যি বলতে, মেলবোর্ন সিটিতেও আমিই একমাত্র গোলদাতা ছিলাম। আমাদের মিডফিল্ডারদের থেকেও গোল আসত না। আমি আগেও বলেছি, আমার ওপর কোনও চাপ নেই। মাঠে গিয়ে ভাল ফুটবল খেলা ও ম্যাচ জেতাই বেশি চাপের। আর আমরা ধারাবাহিকভাবে সেটাই করে আসছি। আমরা রিজার্ভ বেঞ্চের বিভিন্ন পজিশনের খেলোয়াড়দের থেকেও গোল পেয়েছি, আর এটাই শক্তিশালী দলের পরিচয়।

আমি জানতাম যে এখানে আসার পর আমার ওপর কিছুটা চাপ থাকবে, এটা স্বাভাবিক। মানুষ আমার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল, কারণ এর আগেও কিছু অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড় এখানে এসে সফল হয়েছে। আমি এমন একজন খেলোয়াড় হতে চাইনি, যে এখানে এসে ব্যর্থ হবে। মরশুমের শুরুতে যখন আমি চোট পেয়ে বসেছিলাম, তখন কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই সময়কে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, কারণ, কলকাতার মানুষ আমাকে সবসময় সমর্থন জুগিয়েছে। সমর্থক, কোচিং স্টাফ— সবাই আমাকে খুব ভাল ভাবে গ্রহণ করেছে।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট প্রসঙ্গে

আমি সবসময় মানুষকে, বিশেষ করে ভক্তদের বলি— আমাদের শুরুতে নয়, শেষের দিকে বিচার করুন। তবে আমরা এখনও আত্মতুষ্ট নই, আমরা সবসময় আরও ভাল করতে চাই। মরশুম যত এগিয়েছে, আমরা ততই উন্নতি করেছি আর সেটাই সত্যিকারের শক্তিশালী দলের লক্ষণ। আমরা ধীরে ধীরে চোট সমস্যা কাটিয়ে মাঠে ফিরছি, আর মরশুমের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রমাণ করছি, কেন আমরা এই জায়গায় থাকার যোগ্য। এখন আমরা সেটপিস থেকে গোল করাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছি। কিন্তু এগুলো ভাগ্যের কারণে নয়। আমরা এ নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করি। আমাদের কোচ তাঁর কৌশল নিয়ে খুবই নিখুঁত, আর আমরা নিয়মিত এই বিষয়গুলো অনুশীলন করি। যখন দলে আলবার্তো, টম, শুভাশিস, দীপেন্দুর মতো মানের খেলোয়াড় থাকে, তখন অবশ্যই গোল আসবে। এতেই প্রমাণ হয়, আমরা সত্যিই দুর্দান্ত একটি দল, কারণ যে কোনো কম্বিনেশনেই আমরা মাঠে সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে পারি। এই ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করা আমার কাছে সম্মানের এবং আমি জানি যে, বিশেষ মুহূর্তে দলের আমাকে প্রয়োজন হবে।

দিমি, গ্রেগ, এবং জেসনের সঙ্গত

পুরো মরশুমে এমন অনেক সময় এসেছে যখন গ্রেগের চোট ছিল, তখন দিমি খেলেছে। তার পর গ্রেগ দলে ফিরেছে। এর পর জেসন খেলেছে। তাই আমি জানি, যখনই আমি ওদের সঙ্গে খেলছি, ওরা সুযোগ তৈরি করবে, আমিও ওদের জন্য সুযোগ তৈরি করব। এটা কোনো নির্দিষ্ট কম্বিনেশনের ব্যাপার নয়, কারণ আমি মনে করি, আমরা, মানে সামনে থাকা সব খেলোয়াড়রা জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছি। আমি দিমির সঙ্গে জিতেছি, গ্রেগের সঙ্গে জিতেছি, জেসনের সঙ্গেও জিতেছি। আমাদের উইঙ্গারদের কথা বললে, এমনকী তরুণ সুহেলও উঠে এসে দারুণ পারফর্ম করেছে। ওদের সঙ্গে খেলাটা সত্যিই আনন্দের। এ কারণেই আমি প্রতিটি ম্যাচে আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব দৌড়াই, এবং কোচ আমাদের যেটা করতে বলেন, তা পুরোপুরি অনুসরণ করি।

দলের শক্তিশালী রক্ষণ বিভাগ প্রসঙ্গে

আমাদের রক্ষণ অনেক কম গোল খেয়েছে। বিশাল অসাধারণ খেলছে। আমাদের চার ডিফেন্ডারও দুর্দান্ত। একজন ফরোয়ার্ড যখন জানে যে তার দল বেশি সুযোগ দেবে না বা গোল খাবে না, তখন তাদের ওপর চাপ কমে যায়। ফলে আমরা মাঠে নেমে আরও স্বাধীন ভাবে খেলতে পারি এবং উপভোগ করতে পারি। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ ছিল না। আমি কোচকে বলতে শুনেছি, যখন অনেক দল আমাদের বিপক্ষে খেলে, তারা পাঁচ-ছ’জন ডিফেন্ডার নিয়ে রক্ষণ সামলায়। ফলে অনেক সময় প্রথমার্ধে খুব একটা সুবিধা হয় না, কিন্তু আমরা লেগে থাকি, ধাপে ধাপে এগোতে থাকি।

যেমন পাঞ্জাব ম্যাচে হয়েছিল। আমাকে ভলি থেকে গোল করার জন্য ৬০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমরা সব সময় সুযোগ তৈরি করি, এটাই আমাদের প্রতিপক্ষের জন্য চিন্তার বিষয়। কারণ আমরা খুবই শক্তিশালী। তাই যদি কেউ আমাদের বিপক্ষে চার, পাঁচ বা ছয়জন নিয়ে রক্ষণ সামলায়, আমরা তবুও সুযোগ তৈরি করব।