গত ম্যাচে পাঁচ গোলে জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারল না ইস্টবেঙ্গল এফসি। ঘরের মাঠে জয়হীন পাঞ্জাব এফসি-কে হারাতে পারল না তারা। শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে গোলশূন্য ড্র করে মাঠ ছাড়ল লাল-হলুদ বাহিনী ও পাঞ্জাব এফসি। এই ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট পাওয়ায় অবশ্য লিগ টেবলে প্রথম ছয়ে চলে এল ইস্টবেঙ্গল। তাদের নর্থইস্টের অর্জিত পয়েন্ট (৯) সমান হলেও গোলপার্থক্যে একধাপ এগিয়েই রইল। অন্যদিকে পাঞ্জাব রয়ে গেল এগারো নম্বরেই। লিগের শুরুতে টানা ন’টি ম্যাচে জয়হীন থাকার নতুন নজির গড়ল তারা, যে নজির আগে ছিল ইস্টবেঙ্গলের দখলে।

গত ম্যাচে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে যে রকম দাপুটে ফুটবল খেলেছিল কার্লস কুয়াদ্রাতের দল, এ দিন সেই দাপট দেখা যায়নি। দফায় দফায় আক্রমণে উঠলেও ফিনিশিং-এর অভাব এবং পাঞ্জাবের অসাধারণ ও সংগঠিত রক্ষণই তাদের এ দিন কোনও গোল করতে দেয়নি। ডিফেন্সে কলকাতার দলও অবশ্য দক্ষতার পরিচয় দেয়। যার ফলে সারা ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল যেখানে মাত্র একটি শট গোলে রাখতে পারে, সেখানে পাঞ্জাব দুটির বেশি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেনি। হোম টিম যেখানে ১২টি গোলের সুযোগ তৈরি করে, সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ দশবার আক্রমণে ওঠে। তাও কোনও পক্ষই একে অপরের জালে বল জড়াতে পারেনি।

এ দিন হরমনজ্যোৎ সিং খাবরার জায়গায় নিশু কুমার ও বিষ্ণু পুথিয়ার জায়গায় নন্দকুমার শেখরকে প্রথম এগারোয় রেখে ৪-৩-৩ ছকে দল সাজায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। হুয়ান মেরা ও লুকা মাজেনকে সামনে রেখে ৪-৪-২-এ দল সাজায় পাঞ্জাব এফসি। গত ম্যাচের দলে তিনটি পরিবর্তন করে এই ম্যাচে নামে তারা।

ম্যাচের শুরু থেকেই এ দিন আধিপত্য বিস্তার করে লাল-হলুদ বাহিনী। পাঞ্জাবের দলকে চাপে রেখে শুরুতেই গোল তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের, তা তাদের খেলা দেখেই বোঝা যায়। দুই উইং দিয়ে ঘন ঘন আক্রমণে ওঠে তারা। মহেশ, ক্লেটন, নন্দ, বোরহারা তো তৎপর ছিলেনই। এমনকী, দুই সাইড ব্যাক মন্দার ও নিশু কুমারকেও ওভারল্যাপ করে উইং দিয়ে আক্রমণে উঠতে দেখা যায়। প্রথম কুড়ি মিনিটের মধ্যে হাফ ডজন ক্রস দেয় তারা এবং তিনটি কর্নারও আদায় করে নেয়। কিন্তু একটিও শট লক্ষ্যে ছিল না।

পাঞ্জাব এফসি মাঝে মাঝে কাউন্টার অ্যাটাকে উঠলেও এ দিন তাদের প্রধান বাধা হয়ে ওঠেন শৌভিক চক্রবর্তী। বাংলার এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার প্রতিপক্ষের বেশিরভাগ আক্রমণের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান। চমৎকার ইন্টারসেপশন ও ট্যাকল করে লুকা মাজেন, হুয়ান মেরাদের আটকান তিনি। লালচুঙনুঙ্গা, হিজাজি মাহেররাও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন রক্ষণে।

অন্যদিকে, ইস্টবেঙ্গল অ্যাটাকারদের বিরুদ্ধেও যথেষ্ট সংগঠিত ছিল পাঞ্জাবের রক্ষণ। লুংডিম, সুরেশ মিতেই, চাটজিলসায়াস, অভিষেক সিংরা কড়া পাহাড়ায় রাখেন লাল-হলুদ আক্রমণ বিভাগের ফুটবলারদের। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার মিতেইকে দেওয়া হলেও অভিষেকও ছিল তার অন্যতম দাবিদার। লাগাতার নিজেদর গোল এরিয়া থেকে প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় ওঠানামা করে গিয়েছেন তিনি।

প্রথম আধঘণ্টার খেলায় কোনও দলই গোলে কোনও শট রাখতে পারেনি। ইস্টবেঙ্গল একটি শট নিলেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কিন্তু পাঞ্জাব এফসি-কে কোনও শটই নিতে দেয়নি তারা। বক্সে ঢুকেও বারবার বলের নিয়ন্ত্রণ খোয়ান মাজেনরা। ৩৫ মিনিটের মাথায় মেরা বক্সের বাইরে থেকে ম্যাচের প্রথম শটটি নেন, যা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। এই প্রথম শৌভিক তাঁকে পাহাড়ায় রাখেননি, যার জেরে বিপদ প্রায় ঘনিয়ে এসেছিল।

শুরুর দিকে ইস্টবেঙ্গলের আধিপত্য বজায় থাকলেও প্রথমার্ধের ড্রিঙ্কস ব্রেকের পর পাঞ্জাব এফসি খেলায় ফিরতে শুরু করে। দুটি লক্ষ্যভ্রষ্ট শটও নেয় তারা। ৪০ মিনিটের মাথায় কৃষ্ণনন্দ সিংয়ের বাঁ পায়ের শট আটকে দেন প্রভসুখন গিল। প্রতিপক্ষের পাল্টা চাপে ক্রমশ খেলা থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে অভিষেক সিংকে গোলের সামনে মন্দার ও প্রভসুখন বাধা না দিলে হয়তো পিছিয়ে যেত ইস্টবেঙ্গল।

বিরতির পরেও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। প্রথমার্ধে যে ছন্দ ফিরে পায় পাঞ্জাব, সেই ছন্দেই দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে তারা। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে যে ইস্টবেঙ্গলকে দেখা গিয়েছিল, তা এই ম্যাচে কখনওই দেখা যায়নি। ৫৮ মিনিটের মাথায় অধৈর্য্য হয়ে বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে সোজা গোলে শট নেন ক্লেটন সিলভা। কিন্তু তা সোজা গোলকিপার কিরণ লিম্বুর হাতে পৌঁছে যায়। পরের মিনিটেই ছ’গজের বক্সের সামনে থেকে নেওয়া কৃষ্ণনন্দ সিং-এর হেড আটকে দেন গিল।

৬২ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে তিনটি পরিবর্তন করেন ইস্টবেঙ্গল কোচ কুয়াদ্রাত। ডিফেন্ডার হোসে পার্দো, মহম্মদ রকিপ ও ফরোয়ার্ড বিষ্ণু পুথিয়া নামেন যথাক্রমে বোরহা, নিশু ও নন্দর জায়গায়। এই পরিবর্তনের পরে ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে ধার বাড়াতে শুরু করে। তবে প্রতিবারই পাঞ্জাবের ডিফেন্ডাররা তাদের আটকে দেন। আক্রমণগুলিও তেমন সুসংগঠিত ছিল না ইস্টবেঙ্গলের। সেটপিসেও বেশ আগোছালো ছিল তারা। সারা ম্যাচে ন’টি কর্নার পেলেও একটিও গোলের কাছাকাছি রাখতে পারেননি মহেশ সিংরা।

এর আগে এই মরশুমে শেষ ১৫ মিনিটে ইস্টবেঙ্গল তিনটি গোল করেছে এবং পাঞ্জাব এফসি এই সময়ে চারটি গোল খেয়েছে। সে জন্যই শেষ দিকে তারা আরও সতর্ক হয়ে যায়। অন্যদিকে, জয়সূচক গোল তুলে নেওয়ার জন্য ৮০ মিনিটের মাথায় হাভিয়ে সিভেরিওকে নামান কুয়াদ্রাত। তুলে নেন সল ক্রেসপোকে। ৮৩ মিনিটের মাথায় বিষ্ণু যে ভাবে বাঁ দিক দিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে তিন ডিফেন্ডারকে ডজ করে গোলের সুযোগ তৈরি করে ফেলেন, তা অনবদ্য। কিন্তু গোলের সামনে সিভেরিও থাকা সত্ত্বেও ফাইনাল পাসটা তাঁকে বাড়াতে না পারায় সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

ম্যাচের শেষ দিকে আক্রমণে ঝড় তোলে ইস্টবেঙ্গল। ৮৬ মিনিটের মাথায় বিষ্ণুর ক্রস থেকে দু-দু’বার গোলে শট নেন ক্লেটন। কিন্তু দু’বারই তাঁর শট ব্লক করে দেন সুরেশ মিতেই। এই সময় লাল-হলুদ অ্যাটাকারদের কড়া পাহাড়ায় রেখেছিলেন পাঞ্জাবের ডিফেন্ডাররা। শেষ দিকে পুরোপুরি রক্ষণাত্মক হয়ে যায় পাঞ্জাব। যার ফলে ইস্টবেঙ্গল প্রতিপক্ষকে প্রবল চাপে ফেলে দিয়েও তিন পয়েন্ট পাওয়ার জন্য যে গোলটি প্রয়োজন ছিল, সেটি আর পায়নি তারা।

ইস্টবেঙ্গল এফসি দল: প্রভসুখন গিল (গোল), নিশু কুমার (মহম্মদ রকিপ-৬১), লালচুঙনুঙ্গা, হিজাজি মাহের, মন্দার রাও দেশাই, শৌভিক চক্রবর্তী, সল ক্রেসপো (হাভিয়ে সিভেরিও-৮০), বোরহা হেরেরা (হোসে পার্দো-৬১), নন্দকুমার শেখর (বিষ্ণু পুথিয়া-৬১), ক্লেটন সিলভা, নাওরেম মহেশ সিং (আমন সিকে-৯১) ।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: ইস্টবেঙ্গল এফসি ৫৮.৩% - পাঞ্জাব এফসি ৪১.৭%, সফল পাসের হার: ৭৭%-৭৬%, গোলে শট: ১-২, ফাউল: ১২-১২, ইন্টারসেপশন: ৪-১৬, ক্রস: ২৯-১৬, কর্নার: ৯-৪, হলুদ কার্ড: ৩-৩।

ম্যাচের সেরা: সুরেশ মিতেই