আগামী মরশুমে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে আছে সুমিত রাঠির জন্য
ছোটবেলায় রোজ ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে সাইকেলে ২০ কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাওয়া, সেখানে গিয়ে ক্লাসের আগে ঘণ্টা আড়াই প্র্যাকটিস করে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত স্কুল করে বাড়ি ফিরে ভাত, রুটি, সব্জি খাওয়ার কঠিন রুটিন মেনে চলতেন। এখনও কঠিন পরিশ্রম করেন প্র্যাকটিসে।


এক ভুলেই শেষ হয়ে যেতে পারে সব। নায়ক থেকে ভিলেনে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না ফুটবল মাঠের ডিফেন্ডারদের। দলের রক্ষণ সামলানো যে তাই যে কোনও ডিফেন্ডারের কাছেই সব সময় বড় চ্যালেঞ্জ, তা জেনেশুনেই মাঠে নামতে হয় তাদের। এটিকে মোহনবাগানের তরুণ ডিফেন্ডার সুমিত রাঠিও জেনেশুনেই এই ভূমিকাটাই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ, চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন তিনি।
আসন্ন মরশুমেও বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ নিতে চলেছেন উত্তরপ্রদেশের এই তরুণ ডিফেন্ডার, যাঁর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, কিন্তু সময় যেন কিছুটা হলেও থমকে গিয়েছে। ২০১৯-২০ মরশুমে এটিকে এফসি-র জার্সি গায়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে সেরা উঠতি খেলোয়াড়ের খেতাব পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে দেশের ফুটবল মহলে তাঁকে নিয়ে কম হইচই হয়নি।
সাফল্যের সেই সোনালী দিন
সে বার হাবাসের দলে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন সুমিত। একটি ম্যাচে সেরা খোলোয়াড়ের খেতাব পান তিনি। তিনবার সেরা উঠতি ফুটবলারও হন। সব শেষে লিগের সেরা উঠতি তারকার পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ১৪ ম্যাচে ১১৫টি ক্লিয়ারেন্স, ১৮টি ব্লক, ১৯টি ইন্টারসেপশন, ২৭টি ট্যাকল করেন তিনি। ১৬টি ফাউলও করেন। তবে একটিও লাল কার্ড দেখেননি, হলুদ কার্ড দেখেন মাত্র দু’টি। এমন খেলোয়াড়কে যে কোনও কোচই পছন্দের তালিকায় রাখবেন।
কিন্তু পরের মরশুমে যে এমন হবে, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি চণ্ডীগড় ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা এই তরুণ। এটিকে মোহনবাগান শিবিরে ঠাঁই পান বটে। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগও পান। কিন্তু প্রীতম কোটাল, তিরি, সন্দেশ ঝিঙ্গন, শুভাশিস বসুদের পিছনে ঢাকা পড়ে যান। সারা লিগে ২৫৫ মিনিটের বেশি খেলার সুযোগ পাননি সুমিত। সব মিলিয়ে ছ’টি ম্যাচ। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এ কতটাই বা সময়? তাঁর প্রথম হিরো আইএসএলের পারফরম্যান্স দেখে ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচও ভারতীয় শিবিরে ডেকেছিলেন তাঁকে।
কঠিন বাস্তবের মাটিতে
২০১৮-য় এটিকে অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার দু’বছরের মধ্যেই অ্যাকাডেমি থেকে এটিকে-র সিনিয়র দলে ও এক মরশুম হিরো আইএসএলে খেলার পরেই জাতীয় সিনিয়র দলের শিবিরে ডাক পাওয়া, সেই সময়টা ছিল তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু তার পর থেকেই ক্রমশ স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করে। বাস্তবের কঠিন মেঝেয় আছাড় খেয়ে পড়েন যেন। করোনার জেরে নেহাৎ ভারতীয় দলের শিবিরে যাওয়া হয়ে উঠল না তাঁর। ২০২০-২১ হিরো আইএসএলের শেষে যখন ফের সম্ভাব্য দল বাছতে বসেন স্টিমাচ, তখন সুমিত রাঠির নামের পাশে মাত্র ছ’টি ম্যাচের পরিসংখ্যান। তাই এ বারের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান। ফুটবল মাঠ এমনই। সেখানে সময় বদলাতে খুব একটা সময় লাগে না।
সুমিত বরাবরই আশাবাদী। হাল ছাড়তে রাজি নন। গত মরশুমে তেমন সুযোগ পাননি তো কী হয়েছে, তাঁর আশা এই মরশুমে নিশ্চয়ই সুযোগ পাবেন তিনি। কোচ হাবাসকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে রেখেছেন তিনি। “স্যার (হাবাস) আমাকে একদিন ডেকে বললেন, প্রস্তুত থাকো। তোমাকে যে কোনও দিন মাঠে নামতে হবে। সে রাতে আমার আর ঘুম হয়নি। ওড়িশার বিরুদ্ধে ম্যাচে চোট পাওয়া আনাসদা-র (এডাথোডিকা) জায়গায় আমাকে সুযোগ দিলেন স্যার। তার পরে প্রায় সব ম্যাচে খেলেছি। উনি আমার কাছে ঈশ্বরের মতো। ক্লাবের দেওয়া ফ্ল্যাটে আমার ছোটবেলার কোচের ছবি রেখেছি। তার পাশে হাবাস স্যারের ছবিও টাঙিয়ে রেখেছি”, হাবাস সম্পর্কে এমনই মন্তব্য সুমিতের।
রক্তে কৃষকের লড়াই
কৃষক পরিবারের ছেলে সুমিত। পরিবারের কয়েক বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে আখ ও বিটের চাষ করেন তাঁর দাদা। তাঁকে সাহায্য করার জন্য মাঝে মাঝে ট্রাক্টরও চালান তরুণ তারকা ফুটবলার। এখনও গ্রামের বাড়িতে থাকলে ট্রাক্টর চালান তিনি। “এটিকে এফসি-র সঙ্গে হিরো আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাড়ি গিয়ে ট্রাক্টর চালিয়েছি, দাদাকে চাষের কাজে সাহায্য করেছি”, বলেন তিনি। কৃষকদের লড়াই করার মানসিকতা তাঁর রক্তে।

ছোটবেলায় রোজ ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে সাইকেলে ২০ কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাওয়া, সেখানে গিয়ে ক্লাসের আগে ঘণ্টা আড়াই প্র্যাকটিস করে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত স্কুল করে বাড়ি ফিরে ভাত, রুটি, সব্জি খাওয়ার কঠিন রুটিন মেনে চলতেন। এখনও কঠিন পরিশ্রম করেন প্র্যাকটিসে।
স্কুলে স্পোর্টস টিচারের পরামর্শে ছোটবেলায় দাদাকে রাজি করিয়ে চণ্ডীগড় ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ট্রায়াল দিতে যান সুমিত। সেখানে সুযোগও পেয়ে যান। পাঞ্জাবের প্রাক্তন ফুটবল তারকা হরজিন্দর সিং ছিলেন সেখানকার কোচ। তাঁর হাতে পড়ে সুমিত রাঠি নামক সোনা আরও ঝকঝকে হয়ে ওঠে। সেখান থেকেই ডাক পান সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের অ্যাকাডেমিতে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তিন বছর বয়সে পিতৃহারা হওয়া সুমিতকে। অনূর্ধ্ব ১৪, অনূর্ধ্ব ১৮ ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেন তিনি। নেপালে অনূর্ধ্ব ১৮ ভারতীয় দলের সঙ্গে সাফ কাপ চ্যাম্পিয়নও হন। আই লিগেও খেলেন ফেডারেশনের দল ইন্ডিয়ান অ্যারোজের হয়ে। তার পর এটিকে অ্যাকাডেমিতে।
একদিন ঝড় থেমে যাবে
গত বার মরশুম শুরুর আগে বলেছিলেন, “এ বার তো পাঁচজন পরিবর্ত খেলোয়াড় মাঠে মাঠে নামতে পারবে। আমিও নিশ্চয়ই সুযোগ পাব। আর সুযোগ পেলে নিজেকে নিশ্চয়ই প্রমাণ করব। কোচ স্যার বরাবরই বলেন, পেশাদারদের যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হয়। আমিও তাই প্রস্তুত রয়েছি”। এ বার পাঁচ পরিবর্তর সঙ্গে আরও একটি নিয়ম চালু হবে, প্রথম এগারোয় সাত ভারতীয়। তাই এ বার সুমিত আরও বেশি আশায় রয়েছেন।
আসন্ন মরশুমে প্রথম দলে চারজনের বেশি বিদেশি থাকতে পারবেন না প্রথম এগারোয়। মাঝমাঠ ও আক্রমণে বিদেশি কমিয়ে হাবাস আপস করতে না চাইলে রক্ষণে তিরির জায়গায় সুযোগ পেতে পারেন সুমিত। এখানেও লড়াই করতে হবে তাঁকে। আশুতোষ মেহতা, দীপক টাঙরি, প্রবীর দাসের সঙ্গে প্রথম এগারোয় থাকার লড়াই। তাই এই মরশুমেও তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ থাকছেই। সেই চ্যালেঞ্জ সুমিত এ বার কী ভাবে নেন, সেটাই দেখার। তবে ভারতীয় ফুটবলের স্বার্থে সুমিতের মতো প্রতিভাবানদের মাঠে নামা যে খুবই জরুরি, এই নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।