আরও একটা এটিকে মোহনবাগান বনাম হায়দরাবাদ এফসি দ্বৈরথ দেখতে চলেছেন ফুটবলপ্রেমীরা। চলতি মরশুমে এই নিয়ে পাঁচ নম্বর মোলাকাত এই দু’পক্ষের।

অতীতে হায়দরাবাদ থেকে একাধিক ফুটবলার বাংলার ফুটবলে এসে বিখ্যাত হয়েছেন। সাব্বির আলি থেকে শুরু করে তুলসীদাস বলরাম, মহম্মদ হাবিব, মহম্মদ আকবর, সৈয়দ নইমউদ্দিন, পিটার থঙ্গরাজদের কথা শোনেননি এমন ফুটবলপ্রেমী খুব কমই রয়েছেন। এঁরা সবাই হায়দরাবাদ থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের সঙ্গে যে এই শহরের সেরা ফুটবল ক্লাবের এ রকম একটা মাঠের শত্রুতা গড়ে উঠবে, তা বোধহয় কেউই ভাবতে পারেনি কখনও।

এই প্রতিদ্বন্দিতা অবশ্য ফুটবল মাঠেই সীমাবদ্ধ এবং খুব সুস্থ একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে এই দুই দলের মধ্যে। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়— এ রকম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে দুই দলের ফুটবল-সম্পর্ক। দুই মরশুম ধরে যার উত্তাপ উঠছে চরমে। ২০২১-২২ মরশুমেও যেমন হিরো ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) চারবার দেখা হয়েছিল দুই দলের, এ বারেও তাই। দুই মরশুমেই লিগ ছাড়াও সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছে এই দু’পক্ষ। এবং দু’বারেই প্রায় একই ধরনের পরিণতি হয়েছে।

গতবার সেমিফাইনালে এটিকে মোহনবাগানকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে এবং ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয় হায়দরাবাদ এফসি। এ বার সেই সেমিফাইনালেই হায়দরাবাদ এফসি-কে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে এবং ট্রফি জিতে নেয় এটিকে মোহনবাগান। যদি দুই পক্ষের মুখোমুখি হওয়ার সার্বিক নজির দেখা যায়, তা হলে যা পাওয়া যাবে, তা হল সব মিলিয়ে দশ বারের মুখোমুখিতে কলকাতার দল জিতেছে চারবার ও দু’বার জিতেছে হায়দরাবাদ এফসি এবং অমীমাংসিত থেকেছে চারবার। বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা এই পরিসংখ্যান দেখে খুশি হতে পারেন। কিন্তু এই পরিসংখ্যান যে আগামী মরশুমের মধ্যে উল্টে যাবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।

চলতি মরশুমে দুই দলের মধ্যে পঞ্চম ম্যাচ হতে চলেছে আজ, বুধবার সন্ধ্যায় কোঝিকোড়ের ইএমএস কর্পোরেশন স্টেডিয়ামে। আগামী এএফসি কাপের বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ পাবে ভারতের কোন দল, তা নির্ধারণ করার জন্যই এই প্লে-অফ ম্যাচ। এই মরশুমে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দিতা দেখা গিয়েছে দুই দলের মধ্যে, তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, দুই দলেরই রক্ষণ প্রায় দুর্ভেদ্য। হিরো আইএসএল ২০২২-২৩-এ সবচেয়ে কম গোল হজম করা ও সবচেয়ে বেশি ‘ক্লিন শিট’ রেখে মাঠ ছাড়া দুটি দলের মধ্যে লড়াইয়ে কেউ যদি গোলের ফোয়ারা আশা করে থাকেন, তার চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না।

এ বারের হিরো আইএসএলে দুই দলের লড়াইয়ে দেখা গিয়েছে দু’টি জয়, দু’টি গোলশূন্য ম্যাচ, মাত্র দু’টি গোল, চারটি ক্লিন শিট এবং একটি উত্তেজনায় ভরপুর পেনাল্টি শুট আউট, যা জিতে ফাইনালে পৌঁছে ট্রফি জিতে নেয় সবুজ-মেরুন বাহিনী। যাদের ম্যাচে এ রকম পরিসংখ্যান, তাদের আরও একটি ফয়সালা যদি ফের পেনাল্টি শুট আউটের মাধ্যমে হয়, তা হলে অবাক হবেন না।

মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে দুই কোচই স্বীকার করেছেন, বুধবার তাদের সাফল্য সহজে আসবে না। যদিও বা তা ৯০ মিনিটের মধ্যে আসে, তা হলে দু-এক গোলের বেশি ব্যবধানে আসা বেশ কঠিন। তার ওপর আবার মানোলো মার্কেজের হায়দরাবাদের কোচ হিসেবে এটাই শেষ ম্যাচ। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই আবেগান্বিত। কিন্তু আবেগে ভেসে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বান্দা তিনি নন। কেরিয়ারের সেরা কৌশলটাই হয়তো এই ম্যাচে প্রয়োগ করবেন তিনি। এতে আর যাই হোক না কেন, সমস্যায় পড়বে সবুজ-মেরুন শিবিরের কোচ ও ফুটবলাররা।

এমনিতে, দুই মরশুমে এতবার দুই দলের মধ্যে খেলা হয়েছে যে একে অপরের শক্তি-দুর্বলতা খুব ভাল করে জানা আছে। তাই নতুন কিছু করে দেখাতে হবে দুই দলকেই, যা অপর পক্ষের কাছে কিছুটা হলেও অচেনা, অজানা লাগে। এমনিতেই গত হিরো আইএসএলে কৌশলে কিছুটা বদল এনেছেন হুয়ান ফেরান্দো এবং তা যে ধরেও ফেলেছেন মার্কেজ, তা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েও দেন তিনি। এ বার তিনি যদি নতুন কিছু এনে এটিকে মোহনবাগানকে চমকে দেন, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তবে এটা নিশ্চিত, যে এই ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটে বা যদি তা আরও ৩০ মিনিট গড়ায়, তার মধ্যে গোলের ফোয়ারা দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রতিপক্ষের ইস্পাতকঠিন রক্ষণে ফাটল ধরিয়ে যে দল আগে গোল করে দিতে পারবে, তারা এই ম্যাচে অনেকটা এগিয়ে যাবে। কারণ, গোল করার পর তারা তাদের গোলের সামনে আরও শক্তিশালী প্রাচীর গড়ে তুলবে। তাই অযথা ঝুঁকি নিয়ে কেউ ‘অল আউট’ আক্রমণে উঠবে, এমন আশা করাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

হিরো আইএসএলের প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় তারকা ফুটবলার ও বর্তমানে টিভি বিশেষজ্ঞ এরিক পার্তালু বলছেন, “মরশুমের শেষে দুই দলের মধ্যে ফয়সালা হওয়ার সম্ভাবনা পেনাল্টি শুট আউটের মাধ্যমেই বেশি। কারণ, দুই দলই ইতিবাচক ফলে মরশুম শেষ করতে চায়”। অন্যদিকে হিরো আইএসএলের টিভি ধারাভাষ্যকার মার্ক টম্পকিন্স, যিনি ধারাবাহিক ভাবে এই দুই দলের খেলা অনুসরণ করে এসেছেন, তিনি বলছেন, “হিরো আইএসএলে মোট ছ’টি গোলশূন্য ম্যাচ হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটাতেই এই দুই দল খেলেছে। ওদের মধ্যে দুটো সেমিফাইনালই গোলশূন্য হয়েছে। লিগে দুই ম্যাচে একে অপরকে হারিয়েছে ১-০-র ফলে। সারা আইএসএলে দুই দল মিলে মাত্র ৩৩টা গোল খেয়েছে। এর পরেও গোলের ফোয়ারা দেখতে চাওয়াটা অন্যায় হবে”।

দুই দলের স্কোরাররা যদি অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখাতে পারে, তা হলে অবশ্য অন্য কিছু দেখা যতে পারে, যা সারা মরশুমে দেখা যায়নি। এটিকে মোহনবাগানের দিমিত্রিয়স পেট্রাটস হিরো সুপার কাপে একেবারেই ভাল ফর্মে ছিলেন না। হায়দরাবাদ এফসি-র বার্থোলোমিউ ওগবেচে এবং হাভিয়ে সিভেরিও সম্পর্কেও এর চেয়ে ভাল কিছু বলার নেই। তাই হয়তো এ বারেও ফয়সালা হতে পারে এক, বড়জোর দু’গোলে। তবে ম্যাচ পেনাল্টি শুট আউটে গেলে সমস্যায় পড়তে পারে হায়দরাবাদ। কারণ, তাদের দুই প্রথম গোলকিপারই এই ম্যাচে খেলতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে হিরো আইএসএলের সেরা গোলকিপার বিশাল কয়েথ তাদের চেয়ে বোধহয় অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন।

কী হতে পারে ম্যাচের ফল? পার্তালু ২-০-য় এটিকে মোহনবাগানের জয়ের আশায় রয়েছেন। তাঁর মতে, “এর আগেও ফেরান্দোকে ভাল কিছু পাওয়ার জন্য অল আউট যাওয়ার ঝুঁকি নিতে দেখা গিয়েছে। এটা তো এএফসি কাপের টিকিটের প্রশ্ন। তার দলের খেলায় প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যেতে পারে”।

অন্যদিকে টম্পকিন্সের ভবিয্যদ্বাণী, হায়দরাবাদ এফসি ১-০ গোলে জিততে পারে। তাঁর যুক্তি, “দুই মরশুমে দলটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেতার মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মার্কেজ। এ মরশুমে ২০টা ম্যাচের মধ্যে ১৩টিতে জিতেছে ওরা। মার্কেজের শেষ ম্যাচে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জিততে মরিয়া হয়ে উঠবে ওগবেচেরা। এই ব্যাপারটাই তাদের মধ্যে বাড়তি উদ্দীপনা জাগাবে। এ জন্যই তাদের হয়তো উজ্জীবিত ফুটবল খেলতে দেখা যাবে। তবে ১-০-র বেশি ব্যবধান দেখছি না আমি”। শেষ পর্যন্ত কার কথা মেলে, তা জানতে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।