মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের প্রাক্তন কোচ হুয়ান ফেরান্দোকে দলের কোনও একজন বা দু’জন ফুটবলারের কথা আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘আমি দলের দু-একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। কারণ, দলের সবার প্রতিই আমার আস্থা, বিশ্বাস আছে। কোনও একজন বা দুজনের ওপর আলাদা করে নয়’।

চলতি আইএসএলে তাদের প্রথম ম্যাচের পরই যখন সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকে নিয়ে, সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত সবাই হয়তো ভেবেছিলেন, একই উত্তর আসবে ফেরান্দোর কাছ থেকে। কিন্তু তা হয়নি।

সবাইকে একটু অবাক করে দিয়েই ফেরান্দো বলেন, “দিমিত্রি ওর পরিশ্রমের জন্য দলের অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের তো জাদু জানা নেই, পরিশ্রম করেই নিজেদের উন্নত করে তুলতে হবে। দিমির প্রতি দলের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। ওকে সবাই যদি অনুসরণ করে, তা হলে আশা করি আমরা আরও ভাল ফল করতে পারব”।

সেই ম্যাচে দলের ৩-১ জয়ে একটি গোল করেছিলেন ও একটি করিয়েছিলেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। তার আগেই ডুরান্ড কাপের ফাইনালে তাঁর গোলেই ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এএফসি কাপেও তিন গোল করেছেন তিনি।

সব মিলিয়ে এই মরসুমে আইএসএলের দশটি গোল-সহ মোট ১৫টি গোল করেছেন অস্ট্রেলীয় তারকা ফরোয়ার্ড। চলতি মরশুমে আইএসএলে এ পর্যন্ত মোট চারটি অ্যাসিস্ট দিলেও অন্যান্য টুর্নামেন্ট-সহ সারা মরশুমে তাঁর অ্যাসিস্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট। অর্থাৎ, মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে এ মরশুমে এখন পর্যন্ত ৩১টি ম্যাচ খেলে তিনি ২৩টি গোলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অবদান রেখেছেন। দলের এমন এক নির্ভরযোগ্য সদস্যকে নিয়ে কোনও কোচ আলাদা করে কথা বলতে চাইবেন না, তা আবার হয়?

ব্যারেটোদের উত্তরসূরী

পেট্রাটসের পায়ে বল পড়া মানেই যে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যাওয়া, গত মরশুম থেকে বারবার এমনই দেখা গিয়েছে মোহনবাগান ম্যাচে। গত আইএসএলে তিনি ২৩টি ম্যাচে মোট ২০৯১ মিনিট মাঠে থেকে ১২টি গোল করেছিলেন ও সাতটি করিয়েছিলেন। সেবার ৬১টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন তিনি। এ বার এ পর্যন্ত ১৯টি ম্যাচে ১৫৩৬ মিনিট মাঠে থেকে দশটি গোল করেছেন ও চারটি করিয়েছেন। মোট ৫০টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। গতবার তাঁর কনভারশন রেট বা শটকে গোলে রূপান্তরিত করার শতকরা হার ছিল ১৬.২২% যে এ বার সেটা এখন পর্যন্ত ১৪.২৯-এ এসে দাঁড়িছে। এখনও লিগ ও প্লে-অফ মিলিয়ে ২-৫টি ম্যাচ বাকি। নিজেকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে চান এই বিশ্বকাপার, সেটাই এখন দেখার।

কলকাতার দুই প্রধানে এ রকম মহা তারকা হয়ে উঠেছেন অনেকেই। কোচেরা বলেন ঠিকই যে, ফুটবল আসলে টিমগেম, এই খেলায় ভাল হলেও যেমন দলের কৃতিত্ব, তেমনই খারাপ হলেও দলেরই দায়। কিন্তু কলকাতার দুই প্রধানে চিরকালই তারকাদের উদয় হতে দেখা গিয়েছে, যাঁদের দেবতার আসনে বসিয়ে প্রায় পূজা করেছেন সমর্থকেরা। সবুজ-মেরুন বাহিনীতে এক সময়ে দেখা গিয়েছে চিমা ওকেরিকে, দেখা গিয়েছে হোসে রামিরেজ ব্যারেটোকে, তার পরে এসেছেন সনি নর্দে, রয় কৃষ্ণারা। এখন দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের যুগ।

এখনও পাড়ায় পাড়ায় আলোচনা হয়, কোন তারকা সর্বকালের সেরা, ব্যারেটো, রয় না দিমি। অনেকে সনি নর্দেকেই সর্বকালের সেরার আসনে বসান। কিন্তু ইদানীং দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের সমর্থকের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে। এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব যদি নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে কোনও সমীক্ষা করে বা কোনও ভোটাভুটির আয়োজন করে, তা হলে দিমি যে মোটেই খারাপ ভোট পাবেন না, তা বলাই যায়।

দক্ষতা ও ধারাবাহিকতার মেলবন্ধন

গত মরশুমের আগে যখন সৌদি আরবের আল ওয়েহদা ক্লাব থেকে তাঁকে নিয়ে আসে মোহনবাগান এসজি, তখন তিনি সেখানে এবং তার আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ওয়েস্টার্ন সিডনিতেও খেলতেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। ভারতে এসে তাঁকে বিশেষজ্ঞ ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলা শুরু করতে হয়। কিন্তু এই ভূমিকায় মানিয়ে নিতে বেশি সময় নেননি পেট্রাটস।

আইএসএলে প্রথম ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে দলের একমাত্র গোলে অ্যাসিস্ট করেন তিনি এবং দ্বিতীয় ম্যাচেই কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে দলকে ৫-২-এ জেতান। তাও আবার কোথায়? কোচিতে, ব্লাস্টার্সের ঘরের মাঠে, যেখানে গ্যালারির তুমুল আওয়াজে মাঠে থাকা খেলোয়াড়রাও একে অপরের কথা শুনতে পান না।

যদিও সে বার নিয়মিত গোল করতে পারেননি তিনি। ওই হ্যাটট্রিকের পর পাঁচটি ম্যাচে গোলহীন ছিলেন। তার পর বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে একটি গোল করে অ্যাওয়ে ম্যাচে দলকে জেতান। এর পর আবার তিনটি ম্যাচে গোল পাননি। বেঙ্গালুরুর ম্যাচের পর লিগপর্বের ১২টি ম্যাচে পাঁচটি গোল করেন ও দু’টিতে অ্যাসিস্ট করেন। সে বার মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের মোট গোলের সংখ্যাও অনেক কম ছিল। প্লে অফে অবশ্য তিনটি গোল করেন। যার মধ্যে ফাইনালেই তাঁর জোড়া গোল ছিল, দু’টিই পেনাল্টি থেকে। এর পর টাই ব্রেকারেও গোল করেন দিমি।

কিন্তু যত গোল করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ নষ্ট করেছেন তিনি, যে অভ্যাস এখনও পাল্টাতে পারেননি। গতবার ৬১টি গোলের সুযোগ তৈরি করে ১২টি গোল করতে পেরেছিলেন। এ বার এখন পর্যন্ত ৫০টি সুযোগ তৈরি করে ১০টি গোল করতে পেরেছেন।

তবে গত মরশুমে তিনি যেমন বেশিরভাগ ম্যাচেই গোল পাননি, লিগ পর্বে মাত্র ছ’টি ম্যাচে ও প্লে অফে দু’টি ম্যাচে গোল করেছিলেন, এ বার কিন্তু ছবিটা সে রকম নয়। এ বার তিনি অনেক ধারাবাহিক। যেমন পাঞ্জাব এফসি-র ম্যাচেই প্রথম গোল পান। তৃতীয় ম্যাচে চেন্নাইন এফসি-র বিরুদ্ধে ফের গোল করেন। এর পরের তিন ম্যাচে গোল পাননি। তার পর এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে একটি গোল করেন। তার পরের ম্যাচে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ফের গোলহীন, কিন্তু তার ঠিক পরের ম্যাচেই অর্থাৎ কলকাতা ডার্বিতে মরসুমের চতুর্থ গোলটি করে ফেলেন তিনি।

ডার্বির পরের ম্যাচ ছিল হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে, যেখানে গোল পাননি দিমি। কিন্তু তার পরের দুই ম্যাচেই একটি করে গোল পান গোয়া ও নর্থইস্টের বিরুদ্ধে। এর পর ওডিশা ম্যাচে আবার গোলহীন ছিল তাঁর পা। কিন্তু তার পরের দুই ম্যাচেই ফের গোল আসে তাঁর পা থেকে। এর মধ্যে ছিল ফিরতি ডার্বিও। তার পরের ম্যাচ ছিল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচেও গোল পাননি। গতবার যে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন দিমি, সেই ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে এ বার লিগে কোনও গোল করতে পারেননি।

ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ফিরতি ম্যাচে গোল না পেলেও তার পরের দুই ম্যাচে ফের গোল করেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার লিগের শেষ ম্যাচে ফের গোলহীন থেকে যান তিনি। অথচ এই ম্যাচেই সবচেয়ে বেশি (৯) সংখ্যক গোলের সুযোগ তৈরি করেন তিনি। একটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন। দল ৪-০-য় জিতলেও তিনি গোল পাননি। অর্থাৎ, এ বারের লিগে এখন পর্যন্ত ১৯টির মধ্যে দশটি ম্যাচে গোল পেয়েছেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস।

রয় বনাম দিমি

সবুজ-মেরুন বাহিনীর চার মরশুমের আইএসএল অভিযানে পেট্রাটসের সঙ্গে কি কারও তুলনা করা যায়? এ প্রশ্ন করলে উত্তরে একজনের নামই একডাকে মুখে চলে আসে, রয় কৃষ্ণা। যিনি কলকাতার আইএসএল ক্লাবে টানা তিন মরশুম খেলে হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ফুটবলারদের নয়নের মণি। এমনকী মোহনবাগান ছেড়ে তিনি বেঙ্গালুরুতে চলে যাওয়ার পরেও তাঁকে ছাড়া নিয়ে সমর্থকদের আফসোস যায়নি। সেই আফসোস অবশ্য অনেকটাই মিটিয়ে দিতে পেরেছেন দিমি।

এটিকে মোহনবাগানের হয়ে মোট ৩৯টি ম্যাচ খেলে গিয়েছেন রয়, ২১টি গোল করেছেন তিনি। ১২টি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে সবুজ-মেরুন বাহিনীর ৩৩টি গোলে অবদান ছিল তাঁর। সদ্য রয়ের সেই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছেন পেট্রাটস। সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে তাঁরও এখন পর্যন্ত ৩৩টি গোলেই অবদান রয়েছে। তবে গোলের সুযোগ তৈরির দিক থেকে রয়কে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন অস্ট্রেলীয় তারকা।

দুই মরশুম মিলিয়ে তিনি যেখানে ১১১টি (৬০+৫১) গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন, সেখানে রয় দু’মরশুমে ৪৮টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। মোট গোল ও অ্যাসিস্টের সংখ্যাতেও রয়কে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছেন দিমি। এটিকে মোহনবাগানের হয়ে রয়ের যেখানে ২১ গোল ও এক ডজন অ্যাসিস্ট, সেখানে ইতিমধ্যেই ২২ গোল করে ফেলেছেন এবং অ্যাসিস্টে রয়ের চেয়ে একধাপ পিছনে (১১) রয়েছেন দিমি। চোটআঘাত না পেলে এই পরিসংখ্যানে তিনি যে রয় কৃষ্ণাকে পিছনে ফেলে দেবেন, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

প্রতিপক্ষের ত্রাস

প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় যে ভাবে ত্রাস হয়ে উঠতেন রয় কৃষ্ণা, যে রকম আগ্রাসী ফুটবল খেলতেন তিনি, দিমিও অনেকটা সে রকমই। তবে এর সঙ্গে তিনি ফাইনাল থার্ডে বরাবরই কৌশলী এবং হিসেবিও। ফলে সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে প্রতিপক্ষের বক্সে রয় যেখানে ১৮৫ বার বল ছুঁয়েছেন, সেখানে এ পর্যন্ত সেখানে ১২৬ বার বল ছুঁয়েছেন দিমি। এ পর্যন্ত মোট ১৪৪টি শট মেরেছেন দিমি। রয়ের শটের সংখ্যা ১০২।

তবে শটকে গোলে রূপান্তরের ক্ষেত্রে দিমির চেয়ে এগিয়েই রয়েছেন রয়-ই। দিমির ক্ষেত্রে দুই মরশুমে এর শতকরা হার যেখানে ১৬.২২ ও ১৪.২৯ (চলতি মরসুমে) শতাংশ, সেখানে প্রথম মরশুমে রয়ের ২১.৮৮ শতাংশ ও দ্বিতীয় মরশুমে তাঁর ১৮.৪২ শতাংশ শট গোলে পরিণত হয়। আরও একটা ব্যাপারে রয়কে কয়েকশো মাইল পিছনে ফেলে দিয়েছেন দিমি এবং তা হল ক্রসের সংখ্যা। দুই মরশুমে দিমির ক্রসের সংখ্যা যেখানে ২৯৫, সেখানে রয় তাঁর দুই মরশুমে ৩৫টি ক্রস দেন। এর মধ্যে অবশ্য কর্নার থেকে তোলা ক্রসের হিসেবও ধরা হয়েছে।

এই পরিসংখ্যানগুলি দেখেই বোঝা যায় রয় কৃষ্ণা ছিলেন ‘গোলমেশিন’। প্রতিপক্ষের গোল এরিয়ায় তিনি ঢুকতেন গোল করার জন্য। বেশিরভাগ সময়েই সতীর্থরা তাঁকে গোলের পাস বা ক্রস বাড়াতেন আর তিনি শেষ কাজটা করে বেরিয়ে আসতেন। দিমিত্রিয়স পেট্রাটস শুধু যে গোল করেন তা নয়, অ্যাসিস্ট করেন, গোলের সুযোগ তৈরি করেন ও ঝাঁকে ঝাঁকে ক্রসও দেন। তাই রয়কে যদি ‘গোলমেশিন’ বলা হয়, তা হলে দিমিকে ‘গোলফ্যাক্টরি’ বললে বোধহয় একটুও ভুল হয় না।

গোল তৈরির ক্ষেত্রে রয় বেশিরভাগ সময়েই ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’ দিতেন। দিমি তার সঙ্গে গোলের কাঁচামাল সরবরাহ এবং ‘প্রসেসিং’-এও সবরকম ভাবে সাহায্য করেন। তাই কোনও কোচ যদি তাঁর দলের জন্য কোনও ইউটিলিটি অ্যাটাকার খোঁজেন এবং তাঁকে যদি রয় কৃষ্ণা ও দিমিত্রিয়স পেট্রাটসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলা হয়, তা হলে তিনি বোধহয় পরের জনকেই বেছে নেবেন।

এ রকম একজন ইউটিলিটি ফুটবলার দলের মধ্যে থাকতে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট কেন এ বারের লিগ শিল্ড জিতবে না, তার কোনও সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা কঠিন। কিন্তু ফুটবলে যে সব সময় দক্ষতা, ক্ষমতা, গতি, পারফেকশন দিয়েই সাফল্য পাওয়া যায়, তা নয়। লাগে আর একজনের সাহায্যও। তিনি ভাগ্যদেবতা। যিনি গতবার শেষ পর্যন্ত সবুজ-মেরুন শিবিরে টিকে থাকতে পারেননি। এ বার এখন পর্যন্ত তিনি দিমিদের সঙ্গে আছেন বলেই মনে হচ্ছে। সোমবার এবং তার পরেও ৪ মে পর্যন্ত তাঁকে ধরে রাখতে পারবে কি না তারা, সেটাই দেখার।