লিগ টেবলের একেবারে নীচে থাকা এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে কষ্টার্জিত জয় পেয়ে সেরা চারে ফিরে এল গতবারের চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি। মঙ্গলবার ফতোরদার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে দ্বিতীয়ার্ধে বিপিন সিংয়ের গোলে জিতল তারা। এই জয়ের ফলে ১৭ ম্যাচে ২৮ পয়েন্ট পেয়ে কেরালা ব্লাস্টার্সকে এক ধাপ নামিয়ে ছয় থেকে চার নম্বরে উঠে এল গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। তবে বুধবার কেরালা ব্লাস্টার্স যদি হায়দরাবাদ এফসি-কে হারাতে পারে, তা হলে তারা ফের মুম্বইকে প্রথম চারের বাইরে পাঠিয়ে সেরা চারে ফিরে আসবে। কেরালা হেরে গেলে অবশ্য মুম্বই সিটি এফসি চারেই থেকে যাবে। এখন প্রতি ম্যাচের সঙ্গেই লিগ টেবলের চেহারা এ ভাবে বদলে যাচ্ছে।

এ দিন ম্যাচের প্রথমার্ধে এসসি ইস্টবেঙ্গল রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেললেও একাধিক সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও সেগুলি কাজে লাগাতে পারেনি। প্রথম ৪৫ মিনিটেই অন্তত দু’গোলে এগিয়ে যেতে পারত কলকাতার দল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই নিজেদের খেলা পুরো পাল্টে ফেলে গোল পাওযার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মুম্বই সিটি এফসি এবং ৫১ মিনিটের মাথাতেই এগিয়ে যায়। এর পরেও ব্যবধান বাড়ানোর একাধিক সুযোগ পায় তারা। কিন্তু আহমেদ জাহু-হীন আক্রমণ বিভাগ আক্রমণে সেই ধার আনতে পারেনি।

এসসি ইস্টবেঙ্গলও দ্বিতীয়ার্ধে সমতা আনার ও ব্যবধান তৈরিরও একাধিক সুযোগ পায়। কিন্তু বারবার সেই সুযোগগুলি গোলে পরিণত করতে ব্যর্থ হয় তারা। এমনকী ছ’গজের বক্সের মধ্যে থেকে নেওয়া ব্যাকভলি থেকেও গোল করতে পারেননি রাজু গায়কোয়াড়। অবশ্য এর কৃতিত্ব দিতে হবে মুম্বইয়ের গোলকিপার মহম্মদ নওয়াজকেও। একাধিক নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে এ দিন দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি।

এ দিন ম্যাচের আগে শেষ মুহূর্তে দল থেকে বাদ পড়েন আন্তোনিও পেরোসেভিচ এবং সংশোধিত প্রথম এগারোয় তাঁর জায়গায় হাওকিপের নাম দেখা যায়। অন্যদিকে, আহত আহমেদ জাহুকে ছাড়াই এ দিন মাঠে দল নামান মুম্বইয়ের কোচ ডেস বাকিংহাম। তাঁর জায়গায় দেখা যায় এটিকে মোহনবাগানের প্রাক্তনী ব্র্যাড ইনম্যান। গতবারের চ্যাম্পিয়নরা যেখানে ৪-২-৩-১-এ দল সাজায়, সেখানে এসসি ইস্টবেঙ্গল ৪-৪-২-এ শুরু করে।   

শুরুতেই এ দিন আক্রমণের ঝড় তোলে এসসি ইস্টবেঙ্গল। শুরুর তিন মিনিটেই দু’টি গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায় তারা। প্রথমটির ক্ষেত্রে গোলের সামনে বলের নাগাল পাননি সেম্বয় হাওকিপ এবং দ্বিতীয়টিতে নাওরেম মহেশের গোলমুখী শট বাঁদিকে ডাইভ দিয়ে আটকে দেন মুম্বই গোলকিপার মহম্মদ নওয়াজ। আট মিনিটের মাথায় ফের হনামতে গোলমুখী হেড করেন, এ বারও সেভ করেন নওয়াজ। প্রথমার্ধের প্রথম কোয়ার্টারেই দু’টি শট গোলে রাখে লাল-হলুদ বাহিনী এবং দু’টি কর্নারও আদায় করে নেয় তারা। মুম্বই সিটি এফসি-র রক্ষণকে কোণঠাসা করে রাখার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে।

ক্রমশ বলের দখল বাড়িয়ে ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে মুম্বই সিটি এফসি। দুই উইং দিয়ে প্রতি আক্রমণেও উঠতে শুরু করে তারা। তবে এসসি ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণেও যথেষ্ট তৎপরতা দেখা যায় তাদের আটকানোর ক্ষেত্রে। তবে চাপে পড়ে চেষ্টা ছেড়ে দেননি তাদের অ্যাটাকাররা। ২৬ মিনিটের মাথায় মহেশের পাস থেকে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে কার্যত ফাঁকায় বল পেয়ে যান হাওকিপ। কিন্তু মুর্তাদা ফলের বাধায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যান তিনি। পেনাল্টির জন্য আবেদন করেও কোনও লাভ হয়নি। ৪৩ মিনিটের মাথায় ফ্রান সোতার দূরপাল্লার শট অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে চলে যায়।

এই ম্যাচ জিতলে যে তারা সেরা চারে ফিরতে পারবে, প্রথমার্ধে মুম্বইয়ের পারফরম্যান্স দেখে তা মনে হয়নি। মরিয়া ভাবের অভাব যেমন ছিল, তেমনই সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণেও সে ভাবে উঠতে পারেনি তারা। আহমেদ জাহুর অভাব খুব স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায়। ইগর অ্যাঙ্গুলো মাঠে থাকলেও যথেষ্ট সাপ্লাই ও সঙ্গতের অভাবে তিনি তাঁর সেরা ফর্মে আসতে পারেননি। বল পজেশনে (৫৬-৪৪) এগিয়ে থাকলেও সারা অর্ধে বিপক্ষের বক্সের মধ্যে চারটির বেশি টাচ করতে পারেননি তাঁরা। গোলে শট রাখে দু’টি। কিন্তু কোনও পক্ষই গোল করতে পারেনি।   

তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই সম্পুর্ণ অন্য চেহারায় দেখা যায় গতবারের চ্যাম্পিয়নদের। ম্যাচের প্রথম সুবর্ণ সুযোগটা তারা পায় দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই, যখন গোলের সামনে থেকে সিটার মিস করেন অ্যাঙ্গুলো। বাঁ দিক থেকে ছাঙতের ক্রসে হেড করে প্রায় গোল সাজিয়ে দেন বিপিন সিং। কিন্তু অ্যাঙ্গুলো বলে পা লাগাতে পারলেও তা গোলের ওপর দিয়ে চলে যায়।

এই সুযোগের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অসাধারণ দূরপাল্লার শটে গোল করে মুম্বই সিটি এফসি-কে এগিয়ে দেন বিপিন, যিনি গত মরশুমের ফাইনালে গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। ব্র্যাড ইনম্যানের পাস ধরে ডানদিকের উইং দিয়ে উঠে কাট-ইন করে বক্সের সামনে এসে সোজা গোলে শট নেন তিনি। বাঁ দিকে ডাইভ দিয়েও গোল আটকাতে পারেননি গোলকিপার শঙ্কর রায় (১-০)। এতটা সময়ে কোনও লাল-হলুদ ফুটবলারকে দেখা যায়নি তাঁকে বাধা দিতে। বিনা বাধায় গোল করে দেন বিপিন। এই নিয়ে চলতি মরশুমে ছ’টি গোল করা হয়ে গেল তাঁর। সেরা ভারতীয় স্কোরারদের মধ্যে লিস্টন কোলাসোর পরেই তিনি।

এই গোলের পাঁচ মিনিট পরেই তা শোধ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন ফ্রানিও পর্চে। ফ্রান্স সোতার মাপা ফ্রি কিকে হেড করেন পর্চে, যা গোলের সামনে ড্রপ করে অল্পের জন্য গোলের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সমতা আনার সম্ভাবনা বাড়াতে ৬৩ মিনিটের মাথায় ড্যারেন সিডোল ও জ্যাকিচন্দকে নামান কোচ। তুলে নেন সৌরভ দাস ও নাওরেম মহেশকে। অন্য দিকে, অ্যাঙ্গুলোর জায়গায় দিয়েগো মরিসিওকে নামান মুম্বইয়ের কোচ। মাঠে নামার পরেই কর্নার থেকে গোলমুখী হেড করেন মরিসিও, যা বিপক্ষের এক ডিফেন্ডারের গায়ে গিয়ে লাগে।

এসসি ইস্টবেঙ্গলও সমতা আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পরপর কয়েকটি দু্র্দান্ত সুযোগও পায় লাল-হলুদ বাহিনী। ৭০ মিনিটের মাথায় মরিসিওর পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বক্সের বাইরে থেকে সোজা গোলে শট নেন ফ্রান সোতা। কিন্তু সেই বলের দখল নিয়ে নেন নওয়াজ। ৮০ মিনিটের মাথায় ছ’গজের বক্সের মধ্যে থেকে গোলে ব্যাকভলি করেন রাজু গায়কোয়াড়, তা অসাধারণ দক্ষতায় সেভ করেন নওয়াজ। বক্সের মধ্যে ডান দিক থেকে ভাসানো ক্রস দিয়েছিলেন পর্চে।

অন্য দিকে, মুম্বইও ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ৮৩ মিনিটের মাথায় সামনে প্রায় ফাঁকা গোল পেয়েও বক্সের বাইরে থেকে বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন কাসিও গ্যাব্রিয়েল। শঙ্কর রায় অনেকটা এগিয়ে আসায় গোল প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর পরে আর ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পায়নি মুম্বই সিটি এফসি। এসসি ইস্টবেঙ্গল সমতা আনার সুযোগ পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি। স্টপেজ টাইমে মাপা ফ্রিকিকে গোলের সামনে বল রাখেন সোতা। কিন্তু তা চলে যায় সোজা নওয়াজের হাতে। 

এসসি ইস্টবেঙ্গল দল: শঙ্কর রায় (গোল), জয়নার লরেন্সো, রাজু গায়কোয়াড়, ফ্রানিও পর্চে, মহম্মদ রফিক (অ), সৌরভ দাস (ড্যারেন সিডোল),  লালরিনলিয়ানা হনামতে (সংপু সিংসিট), বিকাশ জায়রু (ওয়াহেংবাম লুয়াং), ফ্রান সোতা, সেম্বয় হাওকিপ, নাওরেম মহেশ (জ্যাকিচন্দ সিং)।

পরিসংখ্যানে ম্যাচ

বল পজেশন: মুম্বই সিটি এফসি ৫৩%  - এসসি ইস্টবেঙ্গল ৪৭% 

সফল পাস: ৩১৮/৪১২ (৭৭%) - ২৫৪/৩৪২ (৭৪%), গোলে শট: ৩-৫, ফাউল: ১০-১১, ইন্টারসেপশন: ১৪-১৫, সেভ: ৫-২, কর্নার: ৩-৬, হলুদ কার্ড: ০-০, ম্যাচের সেরা: বিপিন সিং